নুনিয়া বা তরা (Aegialitis rotundifolia)
● সুন্দরবন অঞ্চলে নদীর মাঝে জেগে ওঠা কিছু কিছু চড়ায় এবং জঙ্গলের মধ্যে ৬ থেকে ৮ ফুট লম্বা এক সুন্দর দর্শন গাছ কোথাও কোথাও দলবদ্ধভাবে জন্মাতে দেখা যায়। দেখে মনে হবে যেন এই গাছেদের কোনও ‘জনসভা’ শুরু হয়েছে। মূলত গুল্ম জাতীয় গাছ, কিন্তু দেখে মনে হবে কোনও বৃক্ষের ক্ষুদ্র সংস্করণ। প্রতিটি গাছের গুঁড়ির ভূমি সংলগ্ন অংশ অনেকটা মোটা হয়। আর সেই অংশ থেকে চতুর্দিকে বেরিয়ে আসে অনেক মূল। দেখে মনে হবে যেন অধিমূলের ক্ষুদ্র সংস্করণ। মনে হবে গাছগুলো যেন সেই অধিমূলের ওপর ভর দিয়ে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অদ্ভুত সুন্দর দর্শন এই গাছগুলিকে স্থানীয় মানুষ নুনিয়া নামে ডাকে। অবশ্য কোথাও কোথাও এই গাছকে তরা নামেও ডাকা হয়।
নুনিয়া বা তরা হল পুরোপুরি ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ। বহুবর্ষজীবী এই গাছ সারা বছর সবুজ পাতায় ভরা থাকে। গাছের বাকল বেশ মসৃণ। রং হয় লালচে বাদামি। তবে বাকলের ভেতরের দিকে রং ফ্যাকাসে গোলাপি। এদের হালকা বাদামি রঙয়ের কাঠ খুবই পলকা। প্রায় গোলাকার পাতাগুলো ঝকঝকে সবুজ রঙের। পাতার বৃন্তগুলি হয় বেশ লম্বা আর গোড়ার দিকে ক্রমশ চওড়া। পাতার মধ্যশিরার রং উজ্জ্বল হলুদ। সবুজ পাতার মধ্যে হলুদ শিরার কম্বিনেশন নুনিয়া গাছের রূপকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে। গাছ থেকে বৃন্তসহ পাতা ভাঙলে ক্ষতস্থান থেকে আঠালো তরুক্ষীর নির্গত হয়। নুনিয়া গাছের ফুলে প্রচুর মকরন্দ থাকে, আর খুব সুগন্ধি হয়। ফুলগুলো গুচ্ছাকারে ফোটে। ফুলের পাপড়ির রঙ ধবধবে সাদা। ফুলগুলো থোকা হয়ে ফোটে বলে অনেকগুলো ফল গোছা হয়ে একসঙ্গে ঝোলে। ফলগুলো পাঁচ থেকে আট সেন্টিমিটার লম্বা এবং পাঁচটা শিরাযুক্ত। কাঁচা অবস্থায় ফলের রং সবুজ হলেও পেকে গেলে হালকা বাদামি রঙের হয়। পাকা ফল লম্বালম্বি ভাবে ফেটে যায়।
নুনিয়া বা তরা নদীর চড়ায় পলি মাটির উপরে বা যেখানে জোয়ার ও ভাটা খেলে এমন জায়গায় বেশ ঘন ভাবে জন্মায়। অবশ্য জঙ্গলের মধ্যে যেসব জায়গায় নিয়মিত জোয়ারের জল পৌঁছায় সেখানে হরগোজা, গরান, কেওড়া, গরিয়া, গেঁওয়া, খলসি ইত্যাদি গাছের সাথে যৌথভাবে জন্মাতেও দেখা যায়। জ্বালানি হিসেবে সুন্দরবনের মানুষের কাছে নুনিয়া গাছ বেশি ব্যবহৃত হয়। নুনিয়া গাছের বাকলে যথেষ্ট বেশি পরিমাণে ট্যানিন থাকায় দড়ি পচনরোধী করতে বাকলের নির্যাস এক সময় ব্যবহার করা হত। অনেকে বেড়া দেওয়ার কাজেও এই গাছ ব্যবহার করত।
লৌকিক চিকিৎসা
● অতীতে সুন্দরবন অঞ্চলের মানুষ বিষাক্ত পোকার দংশনে বা আঘাত লেগে কোথাও যন্ত্রণা হলে পাতো বেটে নির্যাস বা ক্বাথ লাগাত। অবশ্য বর্তমানে সুন্দরবন অঞ্চলে চিকিৎসার জন্য নুনিয়া গাছের ব্যবহার দেখা যায় না।
সিঙ্গরা (Cynometra ramiflora)
● কয়েক বছর আগে আমার এক ছাত্রী একটা অদ্ভুত দর্শন ফল এনে আমাকে স্কুলে দেখিয়ে জানতে চাইল, এটা কোন গাছের ফল। সত্যি বলতে কি ফলটা আগে আমি দেখিনি। ফলটা বাদামি রঙের। ফলটার বিশেষত্ব হল সারা গায়ে ছোট ছোট টিউমারের মতো উপবৃদ্ধি। কোনও ফলের এমন আজব গঠন আমি আগে দেখিনি। এর সাথে মেহগনি ফলের কিছুটা মিল খুঁজে পেলাম। কিন্তু মেহগনি ফলের গা মসৃণ। ফলটার আকারও অদ্ভুত। অনেকটা উপবৃত্তাকার। লম্বায় প্রায় তিন থেকে চার সেমি আর চওড়া দুই থেকে তিন সেমি। ফলত্বক কাঠের মত শক্ত, রোমশ ও খসখসে। ছাত্রীটিকে জিজ্ঞাসা করলাম, এ গাছ কোথায় পেলি? বলল, আমাদের বাড়ির কাছে গাছটা আছে। বেশ বড় গাছ। বললাম, একটা শাখা ভেঙে এনে দেখাবি। ছাত্রীটি পরের দিনই পাতাসহ একটা ছোট শাখা এনে আমাকে দেখাল। আমি এ গাছ আগে কোথাও দেখিনি। সুতরাং শুরু করলাম খোঁজখবর। বইপত্র ঘেঁটে উদ্ধার করলাম গাছটির নাম। গাছটির স্থানীয় নাম সিঙ্গরা।
সিঙ্গরা আসলে ম্যানগ্রোভ সহযোগী উদ্ভিদ। মাঝারি উচ্চতার এই গাছটি ১০-১২ মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। গাছের উপরের দিকে অনেক শাখা-প্রশাখা থাকে। বাকলের রং গাঢ় ধূসর বা খয়েরি, যদিও বাকলের ভেতরের দিকের রং বাদামি। কচি পাতার রঙ গোলাপি হলেও পাতা যত পরিণত হয় তত গাঢ় সবুজ হয়ে যায়। এদের পুষ্পমঞ্জরী গঠনের মাধ্যমে ফুল হয়। পুষ্পমঞ্জরীতে দুই থেকে ছয়টি ফুল একসঙ্গে ফোটে। কখনও কখনও ১০-১৫ টি ফুলও দেখা যায়। ফুলের বৃন্ত বেশ লম্বা, প্রায় আট সেন্টিমিটার। ফুলের পাপড়ির রং সাদা আর পাপড়ির সংখ্যা পাঁচটি। পাপড়িগুলোর প্রত্যেকটি বৃত্যংশের থেকেও সরু হয়।
সিঙ্গরা গাছের লবণসহন ক্ষমতা কম। আর তাই এরা সুন্দরবনের দ্বীপগুলোতে সমুদ্রের বিপরীত দিকে জন্মায় যেখানে লবণাক্ততার পরিমাণ কম। সিঙ্গরা গাছ সাধারণত সুন্দরী ও গেঁওয়া গাছের সাথে মিশে জন্মায়। তবে সুন্দরবনের পশ্চিমাংশে অর্থাৎ ভারতীয় সুন্দরবন অংশে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়ায় এই অঞ্চলে সিঙ্গরা গাছ খুব কম দেখা যায়।
সিঙ্গরা কাঠ মাঝারি ধরনের দৃঢ় হয় বলে খুঁটি, হালকা কাঠামো ও নানা সৌখিন কাঠের জিনিস তৈরি করতে ব্যবহৃত হয়। জ্বালানি কাঠ হিসেবেও এর বহুল ব্যবহার রয়েছে। সিঙ্গরা কাঠ থেকে বেগুনি রংয়ের রঞ্জক নিষ্কাশন করা যায়।
লৌকিক চিকিৎসা
● যেহেতু ভারতীয় সুন্দরবন অংশে সিঙ্গরা গাছ খুব কম দেখা যায় তাই লৌকিক চিকিৎসার জন্য এই গাছের বিভিন্ন অংশের ব্যবহার বর্তমানে আর দেখা যায় না। তবে জানা গিয়েছে, সুদূর অতীতে সুন্দরবনের মানুষ ত্বকের রোগে এবং রক্ত শোধনকারী হিসেবে সিঙ্গরা গাছের পাতা ও মূলের নির্যাস ব্যবহার করত। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের সুন্দরবন অঞ্চলের কিছু মানুষ ত্বকের রোগে এখনও এই গাছের পাতা, বাকল বা মূলের নির্যাস ব্যবহার করে। —চলবে।
* সৌম্যকান্তি জানা। সুন্দরবনের ভূমিপুত্র। নিবাস কাকদ্বীপ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা। পেশা শিক্ষকতা। নেশা লেখালেখি ও সংস্কৃতি চর্চা। জনবিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য ‘দ্য সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল ২০১৬ সালে ‘আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড’ এবং শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান লেখক হিসেবে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ ২০১৭ সালে ‘অমলেশচন্দ্র তালুকদার স্মৃতি সম্মান’ প্রদান করে সম্মানিত করেছে।