শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


(বাঁদিকে) গিরাশাকের ঝোপ। (ডান দিকে) ফুল-সহ গিরাশাকের মেরিটিমা প্রজাতি। ছবি: সংগৃহীত।

 

গিরা শাক (Suaeda maritima / Suaeda nudiflora)

গিরা শাক নামটার সঙ্গে পরিচয় শৈশব থেকে। আমাদের গ্রামের গরিব মানুষজনকে দেখতাম প্রায়শই নদীর ধারে যেত গোরুর জন্য ধানি ঘাস আর নিজেদের খাওয়ার জন্য গিরা শাক আনতে। খাদ্য হিসেবে গিরা শাকের সঙ্গে খুব ছোটবেলায় পরিচয় না হলেও ১৩-১৪ বছর বয়সে সুযোগ আসে গিরা শাকের রান্না করা পদ খাওয়ার। আমার প্রয়াত বড় পিসিমার বাড়ি মুড়িগঙ্গা নদীর কাছাকাছি তেভাগা আন্দোলনখ্যাত বুধাখালি গ্রামে। সেই সময় বার দুয়েক আমার পিসতুতো দাদাদের তুলে আনা গিরা শাক পিসতুতো বৌদিরা রান্না করে খাইয়ে ছিল।

শাকের সঙ্গে আলু, বেগুন ও কুচো চিংড়ি দিয়ে চচ্চড়ি রান্না করেছিল। ভালোই লেগেছিল খেতে। তবে তখনই শুনেছিলাম গিরা শাকের তরকারিতে নুন দিতে হয় না। এমনকি শাক প্রথমে সেদ্ধ করে নেওয়ার পর তা নিংড়ে জল ফেলে দিতে হয়। নইলে তরকারি এত নোনতা হয়ে যায় যে খাওয়া যায় না। সত্যি বলতে কি গরিবের বন্ধু হল এই গিরা শাক। শোনা যায় প্রাক স্বাধীনতা পর্বে যখন মন্বন্তর হয়েছিল তখন সুন্দরবনবাসীকে প্রাণে বাঁচিয়েছিল এই গিরা শাক। পরবর্তীকালেও দারিদ্রপীড়িত সুন্দরবন অঞ্চলের মানুষের অন্যতম সহায় ছিল গিরা শাক।

গিরা শাক আজও সুন্দরবন অঞ্চলে নদী-খাড়ির দুপাশে নদীর চরে যথেষ্ট পরিমাণে জন্মায়। যদিও বর্তমানে খাদ্যযোগ্য সবজি হিসেবে মানুষের কাছে এর গ্রহণযোগ্যতা অনেক কমে গিয়েছে। তবু এখনও অনেক দরিদ্র মানুষ খাবার হিসেবে গিরা শাক পছন্দ করে। গিরা শাকের দুটি প্রজাতি সুন্দরবন অঞ্চলে দেখতে পাওয়া যায়। দুটি প্রজাতি সাধারণভাবে একই ধরনের বৈশিষ্ট্যযুক্ত হলেও কাণ্ড এবং পাতার রঙের ক্ষেত্রে ভিন্নতা রয়েছে। মেরিটিমা প্রজাতির গিরা শাকের পাতা সবুজ বা হলুদাভ সবুজ। এর পরিণত কাণ্ড এবং পাতার গোড়ার দিকে লালচে রংয়ের রেখা দেখা যায়। কিন্তু নুডিফ্লোরা প্রজাতির গিরা শাকের কাণ্ড এবং পাতা অপরিণত অবস্থায় সবুজ হলেও পরিণত অবস্থায় এর রং হয় গাঢ় লাল বা লালচে।

গিরা শাক হল ম্যানগ্রোভ সহবাসী বীরুৎ জাতীয় উদ্ভিদ। কচি অবস্থায় খাড়া থাকলেও যত বড় হতে থাকে নরম কাণ্ড হওয়ার কারণে এরা লতিয়ে যায়। একটি গাছ যত বড় হতে থাকে প্রচুর শাখা প্রশাখা জন্মায়। ফলে মাটির ওপরে একটি গাছ অনেকটা অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে থাকে। এরা বর্ষজীবী উদ্ভিদ অর্থাৎ প্রতিবছর ফুল ফল হওয়ার পর মারা যায়। এক একটা গাছ ৬০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। এদের পাতা অত্যন্ত রসালো। পাতাগুলো সরু ও লম্বাটে, আগার দিক সামান্য সরু তবে সূচালো নয়। পাতার বোঁটা থাকে না, একেবারেই কাণ্ডের গা থেকে জন্মায়। পাতার গা মসৃণ এবং বেশ শক্তপোক্ত।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬৩: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— কেরালি ও নোনা হাতিশুঁড়

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৭৭: যাজ্ঞসেনী স্বয়ংবরা দ্রৌপদী কি শুধুই প্রতিহিংসার বাতাবরণ বিনির্মাণ করেন?

গিরা শাকের প্রতিটি পাতার কক্ষ থেকে গুচ্ছাকারে ফুল জন্মায়। ফুলগুলো খুব ছোট। নডিফ্লোরা প্রজাতির ক্ষেত্রে মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে এদের ফুল ও ফল হয়। মেরিটিমা প্রজাতির ক্ষেত্রে ফুল ও ফল হয় সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর মাসের মধ্যে। গিরা শাকের বীজ চকচকে কালো রঙের হয়। জোয়ারের জলের সঙ্গে এই বীজ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে।

গিরা শাক এককভাবে বা ধানি ঘাসের সঙ্গে যৌথভাবে জোয়ার ভাটা খেলে এমন বৃক্ষহীন অঞ্চলে, নদী বা খাঁড়ির তীর, চড়া ইত্যাদি অঞ্চলে জন্মায়। আগেই বলেছি গিরা শাক সুন্দরবন অঞ্চলের দরিদ্র মানুষের সহায়। গিরা শাকের সবচেয়ে আকর্ষণীয় তথ্য হল এই শাক সকালে সংগ্রহ করে খেলে সামান্য টক স্বাদ হয় আর বিকেলে সংগ্রহ করে খেলে অসম্ভব নোনতা স্বাদ হয়। কারণটা হল এরা সালোকসংশ্লেষ পদ্ধতিতে খাদ্য তৈরি করার জন্য প্রয়োজনীয় কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস রাত্রিবেলা সংগ্রহ করে পাতার মধ্যে ম্যালিক অ্যাসিড হিসাবে জমা রাখে। তাই সকালে এই পাতা সংগ্রহ করে রান্না করলে তার স্বাদ হয় টক।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬৩: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— কেরালি ও নোনা হাতিশুঁড়

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৬:কোনও একটি দাবিতে বিরোধীরা জোট বাঁধুক কখনও চায় না শাসক

অপরদিকে সারাদিন ধরে এরা সালোকসংশ্লেষের জন্য প্রয়োজনীয় জল মাটি থেকে সংগ্রহ করে। বলা বাহুল্য এই জল অত্যন্ত লবণাক্ত। তাই বিকেলে সংগ্রহ করা গিরা শাকের স্বাদ হয় নোনতা। রান্না করার সময় সেদ্ধ করে জল ফেলে না দিলে তীব্র লবণাক্ততার কারণে খাওয়া মুশকিল। তাই লবণ ছাড়াই গিরা শাক রান্না করা হয়। এদের ঘন মূল অনেকদূর বিস্তৃত থাকে বলে ভূমিক্ষয় রোধেও গিরা শাক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

 

লৌকিক চিকিৎসা

প্রাচীন কাল থেকে সুন্দরবনের মানুষ নানা রোগের চিকিৎসায় গিরা শাক ব্যবহার করে আসছে। জন্ডিস অর্থাৎ হেপাটাইটিস রোগে গিরা শাকের পাতা রান্না করে খাওয়ানোর প্রচলন রয়েছে বহুকাল ধরে। লিভারের সুরক্ষায় গিরা শাকের গুণ গবেষণাগারে প্রমাণিত। এমনকি হৃদরোগ ও রক্তে কোলেস্টেরল সমস্যায় গিরা শাকের পাতার রস কার্যকরী বলে জানা গিয়েছে। বিজ্ঞানীরা গিরা শাকের পাতার ভাইরাস প্রতিরোধী গুণও লক্ষ্য করেছেন। হয়তো এই সব কারণেই সুন্দরবন অঞ্চলের মানুষ প্রাচীনকালে নানা ধরনের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করেছিল।

(বাঁদিকে) ফুলসহ যদু পালংয়ের শাখা। (ডান দিকে) ফল-সহ গিরাশাক।

 

যদু পালং (Sesuvium portulacastrum)

যদু পালং নামটা ভারি সুন্দর। পালং শাক সবার কাছে সুপরিচিত। সুস্বাদু শাকও বটে। পালং শাকের সঙ্গে যদু পালংয়ের আত্মীয়তা ও ঘনিষ্ঠতা না থাকলেও নামের সাথে কেন পালং কথাটা যুক্ত হল এবং কবে থেকে হল তা আমার অন্তত অজানা। যদু পালংও ম্যানগ্রোভ সহবাসী একপ্রকার বর্ষজীবী বীরুৎ জাতীয় উদ্ভিদ। নদীর চড়ায় যেখান পর্যন্ত জোয়ারের জল পৌঁছয় তার কিছু উপরে এরা ঠাসাঠাসি করে জন্মায়। কখনও কখনও ভরা জোয়ারে নিমজ্জিত হলেও এদের সমস্যা হয় না। তবে নদী ও খাঁড়ির তীরে এদের কম জন্মাতে দেখা যায়।

আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-৮: যেথা আমি যাই নাকো / তুমি প্রকাশিত থাকো

যদু পালং লতানে উদ্ভিদ। এর কাণ্ড নরম, মাটিতে লতিয়ে চলে, আর শাখা-প্রশাখা যুক্ত হয়ে বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। এদের শাখা ১২ সেন্টিমিটার থেকে ৩০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত উচ্চতা বিশিষ্ট হতে পারে। আর গোড়া থেকে ৮০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে। যদু পালংয়ের কাণ্ডের রঙ বাদামি সবুজ। কাণ্ড ভীষণই রসালো। এর পাতাও রসালো, সরু ও লম্বাটে। পাতার আগার দিক সামান্য গোল। পাতার রং তামাটে সবুজ বা বাদামি সবুজ। পাতার গোড়া, আগা ও কিনারার দিক বেশি লালচে হয়। পাতাগুলো খুব চকচকে, পুরু এবং ১.৫ সেমি থেকে ২ সেমি লম্বা। পাতায় কোনও বৃন্ত থাকে না।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩

দশভুজা, পর্ব-৩৬: মৃণালিনী— রবি ঠাকুরের স্ত্রী-র লেখকসত্তা

কাণ্ডের উপর থেকে সরাসরি দুটি পাতা প্রতি পর্বে মুখোমুখি জন্মায়। পাতার কক্ষ থেকে হালকা গোলাপি রঙের ফুল একক ভাবে জন্মায়। ফুলগুলোর পাপড়ি মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য ফোটে। পুরো শীতকাল ও গ্রীষ্মকাল জুড়ে যদু পালংয়ের ফুল ও ফল হয়। ফলগুলো ছোট ছোট ও গোলাকার। ফলের মধ্যে ছোট ছোট কালো রঙের বীজ থাকে। তবে এদের বীজ কিন্তু জলে ভাসে না। যদু পালংয়ের মূল খুব শক্তপোক্তভাবে নোনা বালিমাটিকে আঁকড়ে থাকে। তাই এই গাছ ভূমিক্ষয় রোধে খুবই পারদর্শী। আর সর্বোপরি গিরা শাকের মতো যদু পালংও সুন্দরবন অঞ্চলের গরিব মানুষের সহায়। এই উদ্ভিদ সুন্দরবন এলাকার বহু দরিদ্র মানুষ রান্না করে খায়।

(বাঁদিকে) ফুলসহ গিরাশাকের নুডিফ্লোরা প্রজাতি। (মাঝখানে) যদু পালংয়ের ঝোপ। (ডান দিকে) যদু পালংয়ের বীজ। ছবি: সংগৃহীত।

 

লৌকিক চিকিৎসা

সুন্দরবনের এই উদ্ভিদটি কোনও লৌকিক চিকিৎসায় ব্যবহার করা হত কিনা তা আজ সঠিক জানা যায় না। তবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের জনজাতির মধ্যে বৃক্কের রোগে ও বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণের চিকিৎসায় যদু পালংয়ের ব্যবহার প্রচলিত থাকায় মনে হয় অতীতে সুন্দরবনেও এই উদ্ভিদটির ব্যবহার ছিল। পরিপাকতন্ত্রের সমস্যা, বদহজম, ডায়রিয়া ইত্যাদি রোগে যদু পালংয়ের পাতার রস কার্যকরী। সামুদ্রিক মাছের বিষাক্ত কাঁটা ফুটে গেলে যদু পালং পাতা বেটে ক্ষতস্থানে লাগালে যন্ত্রণা কমে যায়। আবার পাতার রস ত্বকের সংক্রমণ সারাতেও ব্যবহৃত হয়। সুন্দরবনেও নিশ্চয়ই একসময় এই লৌকিক চিকিৎসা প্রচলিত ছিল।—চলবে।

* সৌম্যকান্তি জানা। সুন্দরবনের ভূমিপুত্র। নিবাস কাকদ্বীপ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা। পেশা শিক্ষকতা। নেশা লেখালেখি ও সংস্কৃতি চর্চা। জনবিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য ‘দ্য সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল ২০১৬ সালে ‘আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড’ এবং শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান লেখক হিসেবে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ ২০১৭ সালে ‘অমলেশচন্দ্র তালুকদার স্মৃতি সম্মান’ প্রদান করে সম্মানিত করেছে।

Skip to content