শনিবার ৯ নভেম্বর, ২০২৪


(বাঁদিকে) নোনা হাতিশুঁড় গাছ ফুল-সহ। (মাঝখানে) নোনা হাতিশুঁড়ের পুষ্পমঞ্জরী। (ডান দিকে) নোনা হাতিশুঁড়ের ঝোপ। ছবি: সংগৃহীত।

 

কেরালি (Cryptocoryne ciliate)

বিদ্যাধরী নদীর চড়ায় যে অংশে নিয়মিত জোয়ার ভাটা খেলে সেখানে এক ধরনের বীরুৎ জাতীয় উদ্ভিদ ঠাসাঠাসি করে ঘন ঝোপের মতো জন্মাতে দেখেছি। কখনও কখনও সুন্দরবনের বিভিন্ন খালের ধারেও এদের ঠাসাঠাসি করে জন্মাতে দেখেছি। এর নাম কেরালি। দূরে থেকে দেখলে মনে হবে আদা গাছের বাগান। এর কান্ড আদার মতো মাটির নিচে হয়। আর ওই কন্দ থেকে মাটির ওপরে গুচ্ছাকারে পাতা জন্মায়। পাতার আকারও অনেকটা আদা গাছের মতো। লম্বা সামান্য চওড়া পাতার আগার দিকটা ক্রমশ সূচালো। এদের ফুল হয় অনেকটা কচু ফুলের মতো। আসলে এরা কচু জাতীয় গোত্রের উদ্ভিদ। কচুর পুষ্পমঞ্জরীর বাইরে হলুদ রঙের একটা আবরণ থাকে যাকে চমসা বা স্পেদ বলে। কেরালি গাছের পুষ্পমঞ্জরীতেও অনুরূপ চমসা দেখা যায়। তবে এর রং হালকা বেগুনি। এই চমসা বেশ ঋজু এবং চমসার কিনারায় বেগুনি রঙের সারিবদ্ধ রোম দেখা যায়।

কেরালি উদ্ভিদের কয়েকটি ভ্যারাইটি বাহারি উদ্ভিদ হিসেবে বাগানে বা টবে বা অ্যাকোয়ারিয়ামে প্রতিপালন করা হয়। এদের পুরো চমসার রং হয় বেগুনি বা গোলাপি। চমসার আকার বাদ্যযন্ত্র ট্রাম্পেট এর মতো দেখতে হয় বলে ইংরেজিতে এই উদ্ভিদকে বলে ওয়াটার ট্রাম্পেট। এরা পুরোপুরি ম্যানগ্রোভ নয়, ম্যানগ্রোভ সহযোগী উদ্ভিদ। তবে এরা তীব্র লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬২: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— সুখদর্শন ও হুড়ো

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৭৯: সংশয় আর সন্দেহ

 

লৌকিক চিকিৎসা

সুন্দরবন অঞ্চলে এই উদ্ভিদটি পোড়া ঘা ও ফোঁড়ার চিকিৎসায় ব্যবহার করার প্রচলন রয়েছে। এই উদ্ভিদের কন্দ বেটে প্রস্তুত ক্বাথ পোড়া ঘা ও ফোঁড়ার ওপর দিনে দু’বার করে লাগালে উপকার হয়। তবে এই লৌকিক চিকিৎসার রীতি বর্তমানে অতি বিরল।

আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৫: পতন আসন্ন হলেই সবার বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়

দশভুজা, পর্ব-৩৬: মৃণালিনী— রবি ঠাকুরের স্ত্রী-র লেখকসত্তা

 

নোনা হাতিশুঁড় (Heliotropium curassavicum)

হাতিশুঁড় গাছের সঙ্গে অনেকেরই পরিচয় আছে। মাঠে রাস্তার পাশে যত্রতত্র এই গাছ জন্মায়। এদের পুষ্প মঞ্জরী দেখতে হাতির শুঁড়ের মতো বলে নাম হয়েছে হাতিশুঁড়। একই রকম পুষ্প মঞ্জরী দেখা যায় সুন্দরবনের আর এক বীরুৎ জাতীয় উদ্ভিদে। একই পরিবারভুক্ত এই উদ্ভিদের নাম তাই নোনা হাতিশুঁড়। এই উদ্ভিদটির আদি বাসভূমি আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়া মহাদেশ। তবে ভারতে কবে এর আগমন ঘটে এবং কীভাবে ঘটে তা জানা যায় না।

আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৬০: শ্রীমার রামেশ্বরম যাত্রা

নোনা হাতিশুঁড় হল লতানে বীরুৎ জাতীয় বর্ষজীবী উদ্ভিদ। প্রতিটি গাছ থেকে অনেক শাখা প্রশাখা তৈরি হয়ে মাটির ওপর অনেকটা জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে থাকে। এদের পাতাগুলো দেখতে হয় অনেকটা দই খাওয়ার কাঠের চামচের মতো। পাতাগুলি প্রায় ৩.৫ সেমি লম্বা ও ০.৬-০.৭ সেমি চওড়া হয়। পাতা রসালো এবং চকচকে মসৃণ। ফুলগুলো হাতির শুঁড়ের মতো বাঁকা মঞ্জরীদণ্ডের ওপর গায়ে গায়ে ঠাসাঠাসি করে সাজানো থাকে। ফুলগুলি ছোট ছোট এবং সাদা রংয়ের হয়। তবে ফুলের মাঝে হালকা হলুদ ও হালকা লাল দাগ থাকে। ফুলের পাঁচটি পাপড়ির অগ্রভাগ ভিতরের দিকে সামান্য বাঁকানো থাকে। ফুল থেকে ২-৩ মিলিমিটার লম্বা ডিম্বাকার ফল সৃষ্টি হয়।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৯: হারিয়ে যাওয়ার ‘জীবন তৃষ্ণা’

সাধারণত যেখানে জোয়ারের জল পৌঁছয় তার থেকে উঁচু জায়গায় নোনা হাতি শুঁড় জন্মায়। নদী, খাঁড়ি ও খালের তীরে কিংবা চড়ায় ঠাসাঠাসি করে বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে একক প্রজাতি হিসেবে এদের জন্মাতে দেখা যায়। এদের লবণাক্ততা সহ্য করার ক্ষমতা মাঝারি ধরণের। এরা হল ম্যানগ্রোভ সহবাসী উদ্ভিদ। অনেক জায়গায় এই উদ্ভিদটিকে মানুষ খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে।

(বাঁদিকে) কেরালি উদ্ভিদের চমসা। (ডান দিকে) কেরালি গাছের ঝোপ। ছবি: সংগৃহীত।

 

লৌকিক চিকিৎসা

বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে উপকূলীয় জনজাতির মধ্যে ভেষজ উদ্ভিদ হিসেবে নোনা হাতিশুঁড়ের ব্যবহার দেখা যায়। সুন্দরবন অঞ্চলেও তাই প্রাচীনকাল থেকে এই উদ্ভিদ লৌকিক চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন ঋতুস্রাব ঘটিত সমস্যায় হাতিশুঁড় গাছের মূল সেদ্ধ করে চায়ের মতো সেই গরম জল পান করানোর প্রাচীন রীতি রয়েছে। স্ত্রীলোকের সাদা স্রাব হলে এই উদ্ভিদের নির্যাস পান করে সুফল পাওয়া যায়। এর পাতা শুকিয়ে গুঁড়ো করে ক্ষতস্থানে লাগালে দ্রুত ক্ষত নিরাময় হয়। ত্বকে ফুসকুড়ি, ঘা, টিউমার ইত্যাদি হলে এই উদ্ভিদের নির্যাস রোগ নিরাময়ে ব্যবহৃত হয়। অবশ্য সুন্দরবন অঞ্চলে এইসব লৌকিক চিকিৎসা বর্তমানে বিলুপ্তপ্রায়।—চলবে।

* সৌম্যকান্তি জানা। সুন্দরবনের ভূমিপুত্র। নিবাস কাকদ্বীপ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা। পেশা শিক্ষকতা। নেশা লেখালেখি ও সংস্কৃতি চর্চা। জনবিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য ‘দ্য সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল ২০১৬ সালে ‘আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড’ এবং শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান লেখক হিসেবে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ ২০১৭ সালে ‘অমলেশচন্দ্র তালুকদার স্মৃতি সম্মান’ প্রদান করে সম্মানিত করেছে।

Skip to content