
বুলবুলি দম্পতির ভালোবাসার পরশ। ছবি: সংগৃহীত।
“খোকা ঘুমাল পাড়া জুড়াল বর্গী এল দেশে
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেব কীসে”
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেব কীসে”
এই ছড়া মায়ের মুখ থেকে শুনে ঘুমোয়নি এমন বাঙালি সন্তান আছে কিনা সন্দেহ। বুলবুলি পাখির নামটা সেই ছোট থেকেই সব বাঙালির মনে গেঁথে গিয়েছে। আমিও তার ব্যতিক্রম নই। বুলবুলি কীভাবে চিনলাম তা আর আজ মনে নেই। নিশ্চয়ই বাবা, মা কিংবা ঠাকুমার কাছ থেকে খুব শৈশবে বুলবুলি পাখিকে চিনেছি। রোগাটে গড়নের ৭/৮ ইঞ্চি লম্বা পাখিটার মাথা আর গলা কুচকুচে কালো। পিঠ আর ডানার রং কালচে-বাদামি। লেজ বাদামি হলেও ক্রমশ গাঢ় বাদামি হয়ে গিয়ে শেষ প্রান্ত সাদা। ডানায় আর বুকের প্রত্যেকটা পালকের প্রান্তে সাদা দাগ থাকায় যেন আঁশ বলে মনে হয়। ডানা দুটো মেললে দেখা যায় পিঠের শেষ ও লেজের শুরুর কাছে ইংরেজি “V” আকৃতির সাদা দাগ। পেট ও লেজের তলার রং ফিকে সাদা।
এদের ঠোঁট দূর থেকে কালো বলে মনে হলেও কাছ থেকে ভালোভাবে দেখলে বোঝা যাবে রং নীল। তবে বুলবুলির সৌন্দর্য তার শরীরের দুটো জায়গায়—মাথায় আর লেজ ও পেটের সংযোগস্থলে। স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে এদের কালো মাথার ওপর একটা সুন্দর ঝুঁটি আছে। আর লেজের নিচে পেটের সাথে সংযোগস্থলটা অর্থাৎ অবসারণির চারপাশটা টুকটুকে লাল। এ জন্যই এদের ইংরেজিতে বলে ‘Red vented bulbul’।
ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি, খুব ছটফটে পাখি এই বুলবুল। আর ভয়ডরও খুব কম। সুন্দরবনের বসতি এলাকার সর্বত্রই এদের দেখা যায়। আমাদের গ্রামের বাড়িতে পুকুরঘাটের পাশে আম ও নিম গাছে প্রায়শই তীক্ষ্ণ ‘টিউ-টু-টুল’ ডাক শুনে জানালা দিয়ে দৃষ্টি গলিয়ে দেখেছি একজোড়া বুলবুলি এ-ডালে ও-ডালে লাফাচ্ছে। আমি বেশ বুঝতাম বুলবুলি জোড়ার একটা পুরুষ ও একটা স্ত্রী। কিন্তু কোনটা পুরুষ আর কোনটা স্ত্রী তা দেখে চিনতে পারতাম না। দুটোকেই একই রকম দেখতে।
ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি, খুব ছটফটে পাখি এই বুলবুল। আর ভয়ডরও খুব কম। সুন্দরবনের বসতি এলাকার সর্বত্রই এদের দেখা যায়। আমাদের গ্রামের বাড়িতে পুকুরঘাটের পাশে আম ও নিম গাছে প্রায়শই তীক্ষ্ণ ‘টিউ-টু-টুল’ ডাক শুনে জানালা দিয়ে দৃষ্টি গলিয়ে দেখেছি একজোড়া বুলবুলি এ-ডালে ও-ডালে লাফাচ্ছে। আমি বেশ বুঝতাম বুলবুলি জোড়ার একটা পুরুষ ও একটা স্ত্রী। কিন্তু কোনটা পুরুষ আর কোনটা স্ত্রী তা দেখে চিনতে পারতাম না। দুটোকেই একই রকম দেখতে।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১০৩: গ্রহের ফের

আমি আমার আমিকে চিরদিন এই বাংলায় খুঁজে পাই?
আমার মনে হয়, চেনা-জানা পাখিদের মধ্যে বুলবুলি খুব সাহসী। কিংবা হয়তো ওরা মানুষের সঙ্গ পছন্দ করে। অনেকবার দেখেছি, মা যখন দড়িতে জামাকাপড় মেলত তখন দড়ির একধারে দিব্যি বসে থাকত। আর আমি ঘরে যখন বসে থাকতাম দিব্যি জানালায় এসে বসে থাকত। শুনেছি, বুলবুলি নাকি পোষ মানে। আগেকার দিনে নাকি খাঁচায় বন্দি করে বুলবুলি পোষা ছিল অভিজাত সম্প্রদায়ের শখ। কলকাতার বাবু সম্প্রদায়ের মধ্যে ঘুড়ি ওড়ানো আর বুলবুলির লড়াই ছিল দুই জনপ্রিয় বাবুয়ানি। দক্ষিণ ভারতে বুলবুলির লড়াই প্রাচীনকাল থেকে একটা সাংস্কৃতিক প্রথা। একসময় হায়দরাবাদ ও লখনৌতে ধনী সম্প্রদায়ের মধ্যে মোটা অঙ্কের বাজি ধরা হত বুলবুলির লড়াইতে। ইরাক, ইরান ও আফগানিস্তানে নাকি এখনও বুলবুলির লড়াই চালু আছে। শুনেছি একটা স্ত্রী বুলবুলির দখল নিতে দুটো পুরুষ বুলবুলি লড়াই করে। তাই লড়াই ওদের রক্তে। আবার পুরুষ বুলবুলি স্ত্রী বুলবুলির মন জয় করতে তার সামনে দু’ডানা তুলে ধরে লেজটাকে খাড়া করে ধরে। মোগল সম্রাটদেরও নাকি বুলবুলি পোষার ও বুলবুলির লড়াইয়ের শখ ছিল।
আরও পড়ুন:

ঈশ্বর কী সাড়া দেন তামিলে, সংস্কৃতে?

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৮৮: সুন্দরবনের পাখি — শালিক
যাইহোক, বুলবুলিদের দেখেছি ভারি চঞ্চল পাখি। এক জায়গায় বেশিক্ষণ স্থির হয়ে বসতে পারে না। গাছে গাছে ঘুরে পোকামাকড় আর ফুলের মধু খেতেই বেশি পছন্দ। শীতকালে আমাদের খেজুর গাছে রস দেওয়া হত। সকালে গাছ থেকে রসের ভাঁড় নামিয়ে নেওয়ার পর নলি দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা রস নীচে গড়িয়ে পড়ত। আর বুলবুলিদের দেখতাম ওরা নলির উপরে বা পাশে বসে রস খাচ্ছে। চৈত্র-বৈশাখ মাসে মাঝে মাঝে ঝড়-বৃষ্টির পরদিন সন্ধ্যার ঠিক আগে বাদল পোকাদের খুব উড়তে দেখা যায়। এই সময় বুলবুলিদের মনের সুখে বাদল পোকাদের ধরে খেতে দেখেছি। কাপড় শুকানোর দড়িতে বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ করে উড়ে গিয়ে পোকা ধরে এনে ফের দড়িতে এসে বসত। তারপর ঠোঁট দিয়ে পোকাটাকে একটু ঝাঁকিয়ে মেরে দিয়ে টপ করে গিলে নিত। তারপর আবার একটা পোকার জন্য ঝাঁপ। তবে কোনও বুলবুলিকে কখনও ধান খেতে দেখিনি। এমনও হতে পারে আমার নজরে পড়েনি। আর ওদের কখনও মাটিতে হেঁটে বেড়াতেও দেখিনি। আসলে ওদের পা খুব ছোটো আর বেশ সরু। ফলে নিশ্চিতভাবেই বুলবুলির পা মাটিতে হাঁটার উপযুক্ত নয়।
বুলবুলি কিন্তু মূলত ভারত-সহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া মহাদেশের পাখি। যদিও পরবর্তীকালে ওদের এখান থেকেই নানা দেশে নিয়ে যাওয়া হয়েছে পোষার জন্য। তারপর সেখানে ওরা বংশবিস্তারও করেছে। বুলবুলির বিজ্ঞানসম্মত নাম ‘Turdus cafer’। পরবর্তীকালে এই নাম একটু সংশোধন করে হয়েছে ‘Pycnonotus cafer’। বুলবুলি নিয়ে আরও একটা মজাদার খবর শুনেছি। এরা ভিটামিন-সি হজম করতে পারে না। মলের সাথে ভিটামিন-সি বেরিয়ে যায়।
বুলবুলি কিন্তু মূলত ভারত-সহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া মহাদেশের পাখি। যদিও পরবর্তীকালে ওদের এখান থেকেই নানা দেশে নিয়ে যাওয়া হয়েছে পোষার জন্য। তারপর সেখানে ওরা বংশবিস্তারও করেছে। বুলবুলির বিজ্ঞানসম্মত নাম ‘Turdus cafer’। পরবর্তীকালে এই নাম একটু সংশোধন করে হয়েছে ‘Pycnonotus cafer’। বুলবুলি নিয়ে আরও একটা মজাদার খবর শুনেছি। এরা ভিটামিন-সি হজম করতে পারে না। মলের সাথে ভিটামিন-সি বেরিয়ে যায়।

(বাঁদিকে) জানালায় বুলবুলির বাসায় ডিম। (ডান দিকে) জানালায় বুলবুলির বাসায় সদ্য জন্মানো ছানারা। ছবি: লেখক।
হ্যাঁ, যে গল্প করছিলাম। আমাদের পুকুর পাড়ের পুরানো আমগাছটায় একটা কোটর ছিল। আমি তখন বোধহয় ক্লাস এইটে পড়ি। একদিন হঠাৎ নজরে এল, দুটো বুলবুলি ঠোঁটে করে ঘাস বয়ে এনে ওই কোটরে ঢুকছে। বুঝতে বাকি রইল না, বাসা বানানোর কাজ চলছে। স্ত্রী-পুরুষ বুলবুলি দুজনে মিলেই বাসা বানাচ্ছে। ক’দিন পর হঠাৎ একদিন সকালে নজরে এল তিনটে ছোটো পাখি আমগাছের কোটরের পাশে একটা ডালে টিউ-টিউ করে ডাকছে। চড়ুই পাখির মতো সাইজ, আর ছাতারে পাখির মতো ফ্যাকাশে রঙ। এরা আবার কী পাখি? ভাবতে ভাবতেই দেখি ওদের পাশে উড়ে এসে বসল একটা বুলবুলি। বুঝলাম, এগুলো বুলবুলির ছানা-পোনা। বড়োটা বাবা না মা কে জানে? সে ওদের কিছু কি বলল? পরক্ষণেই চারজন আগে-পরে উড়ে গিয়ে বসল নিচের একটা ডালে। তারপর সদলে উড়ে গিয়ে পাশের নিমগাছে। বুঝতে পারলাম, ওড়ার প্রশিক্ষণ পর্ব শুরু হয়েছে।
সেদিন ছিল ২০১৫ সালের ৮ জুন। সকাল সকাল আমার নির্মীয়মান বাড়ির কাজের তদারকি করতে সোজা দোতলায় উঠে করিডোরের কাছে আসতেই নজরে এল করিডোরের জানালার পাল্লায় একটা ছোট্টো বাসা। কিন্তু বাসায় বা ধারেকাছে কোনও পাখি দেখতে পেলাম না। বাড়িতে ফিরে এলেও মন কিন্তু পড়ে রইল সেই বাসায়। দুপুরে যখন শ্রমিকরা বিশ্রাম নিচ্ছিল তখন বাসার মালিক ও মালকিনকে চিনতে ফের চুপিচুপি হাজির হলাম। নীচে থেকে লক্ষ্য করলাম পাঁচ-দশ মিনিট পর পর একটা বুলবুলি মুখে কাঠি নিয়ে আসছে আর বাসা বানাচ্ছে। আমি বুঝে উঠতে পারলাম না, একটি না দুটি বুলবুলি মিলে এই বাসা বানাচ্ছে। আগেই বলেছি, বুলবুলির স্ত্রী ও পুরুষ একই দেখতে। আমি একসাথে দুটো বুলবুলিকে একবারের জন্যও দেখতে না পাওয়ায় আমার পক্ষে বোঝা সম্ভব হয়ে উঠল না। পরের দিন আবার সকালবেলা গিয়ে দেখি স্ত্রী বুলবুলিটা বাসার উপর বসে। মাঝে মাঝে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। আমি দেয়ালের আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে দেখছিলাম। হঠাৎই চোখাচোখি হয়ে গেল! সঙ্গে সঙ্গেই ফুরুৎ। ওকে ডিস্টার্ব করার জন্য নিজের উপর রাগ হচ্ছিল। লোভ সামলাতে পারলাম না। এগিয়ে গেলাম বাসার কাছে। ও মা! কী সুন্দর একটা ডিম! হালকা গোলাপি রঙের উপর মেরুন-খয়েরি ছিট ছিট দাগ। আমার মনটা আনন্দে ভরে গেল।
সেদিন ছিল ২০১৫ সালের ৮ জুন। সকাল সকাল আমার নির্মীয়মান বাড়ির কাজের তদারকি করতে সোজা দোতলায় উঠে করিডোরের কাছে আসতেই নজরে এল করিডোরের জানালার পাল্লায় একটা ছোট্টো বাসা। কিন্তু বাসায় বা ধারেকাছে কোনও পাখি দেখতে পেলাম না। বাড়িতে ফিরে এলেও মন কিন্তু পড়ে রইল সেই বাসায়। দুপুরে যখন শ্রমিকরা বিশ্রাম নিচ্ছিল তখন বাসার মালিক ও মালকিনকে চিনতে ফের চুপিচুপি হাজির হলাম। নীচে থেকে লক্ষ্য করলাম পাঁচ-দশ মিনিট পর পর একটা বুলবুলি মুখে কাঠি নিয়ে আসছে আর বাসা বানাচ্ছে। আমি বুঝে উঠতে পারলাম না, একটি না দুটি বুলবুলি মিলে এই বাসা বানাচ্ছে। আগেই বলেছি, বুলবুলির স্ত্রী ও পুরুষ একই দেখতে। আমি একসাথে দুটো বুলবুলিকে একবারের জন্যও দেখতে না পাওয়ায় আমার পক্ষে বোঝা সম্ভব হয়ে উঠল না। পরের দিন আবার সকালবেলা গিয়ে দেখি স্ত্রী বুলবুলিটা বাসার উপর বসে। মাঝে মাঝে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। আমি দেয়ালের আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে দেখছিলাম। হঠাৎই চোখাচোখি হয়ে গেল! সঙ্গে সঙ্গেই ফুরুৎ। ওকে ডিস্টার্ব করার জন্য নিজের উপর রাগ হচ্ছিল। লোভ সামলাতে পারলাম না। এগিয়ে গেলাম বাসার কাছে। ও মা! কী সুন্দর একটা ডিম! হালকা গোলাপি রঙের উপর মেরুন-খয়েরি ছিট ছিট দাগ। আমার মনটা আনন্দে ভরে গেল।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৮৬: এক সন্ধ্যায় মা সারদার বলা ভূতের গল্প

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৭: উত্তরণ-অবতরণ শেষে স্বপ্নের ‘সূর্যতোরণ’
কিন্তু আনন্দের পর পরই যে ভয়ানক টেনশন আসবে কে জানত! সেদিন রাতেই উঠল কালবৈশাখি ঝড়। আমার মন ব্যাকুল হয়ে উঠল ওই ডিমসহ বাসাটার জন্য। কিন্তু পরদিন দেখি আমার যাবতীয় আশঙ্কা মিথ্যে প্রমাণ করে দিব্যি রয়েছে বাসাখানি। আর তাতে আরও একটা ডিম। সামান্য দেখতে বাসাটা কী অসামান্য কৌশলে বানিয়েছে যে এত তীব্র ঝড়েও কোনও ক্ষতি হল না! আর সেই ঝড়ের রাতেই দ্বিতীয় ডিমটা পাড়ল মা বুলবুলিটা। স্বল্প সময়ের মধ্যে বাসাটাকে খুঁটিয়ে দেখলাম। তেমন কোনও বিশেষত্ব নেই। শুকনো ঘাস আর কাঠি দিয়েই বানানো। মাকড়সার জাল দিয়ে ঘাস ও কাঠিগুলোকে জুড়ে তৈরি করেছে একটা ছোটো বাটির মতো বাসা। বাসাটা যে জানালার সাথে জুড়ে আছে তেমনও নয়। আসলে বুদ্ধি ব্যবহার করেছে বুলবুলিটা। জানালার দুটো পাল্লার চারটে শিকের মাঝে বাসাটাকে তৈরি করায় যে কোনও দিক থেকে ঝড় হলে তা সহজে উড়ে যাবার নয়। তারিফ করতেই হয় বুদ্ধির! পরের দিন বিকেলে গিয়ে দেখি তিনটে ডিম!
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১০২: ভরতের মতো একমুখী লক্ষ্যে এগিয়ে চলা কী সম্ভব?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১১২: দারুণ এক গগনবিহারী খেলনা বানিয়েছিলেন গগনেন্দ্রনাথ
এক এক করে দিন পেরিয়ে চলেছে। বুলবুলিটা ইতিমধ্যে বেশ সাহসী হয়ে উঠেছে। নাগাড়ে তা দিয়ে চলেছে ডিমে। তিন-চার হাত দূরে দাঁড়ালেও সে আর আমাকে ভয় পায় না। ঘাড় বাঁকিয়ে শুধু দেখে। আমি প্রতিদিন সকাল-বিকেল দু’বেলা দেখে আসি। জানতাম, বুলবুলির ডিম ফুটে বাচ্চা বেরোতে ১৩/১৪ দিন লাগে। আর তাই অধীর আগ্রহে বুলবুলি ছানাদের দেখার জন্য কাউন্ট ডাউন শুরু করে দিলাম।
সেদিন ২২ জুন। বাসার দিকে তাকাতেই আমার চোখ ছানাবড়া! তিন তিনটে বাচ্চা জড়াজড়ি করে ঘুমোচ্ছে! এ কী করে সম্ভব? তিনটে ডিম পর পর তিন দিনে পেড়েছে। বিজ্ঞানের নিয়ম বলে পর পর তিন দিন তিনটে বাচ্চার জন্ম হওয়া উচিত। কিন্তু তা তো হল না! আবার ১৩/১৪ দিন পরেও নয়, প্রথম ডিম পাড়ার ১২ দিন পর, আর শেষ ডিম পাড়ার ১০ দিন পর ডিম ফুটে বাচ্চারা বেরিয়েছে। ব্যতিক্রম? না কি পরিবেশের কোনও প্রভাব? কয়েক মিনিট পরেই উড়ে এল মা, নাকি বাবা? মুখে কিছু খাবার। তিনটে বাচ্চা হাঁ করে খাবার চাইল। মা বুলবুলিটা প্রতিবার উড়ে যায় আর একটা করে খাবার এনে একটা বাচ্চাকে খাইয়ে যায়। আকারে-আচারে প্রজাতিরা আলাদা হলে কী হবে, সন্তানের প্রতি স্নেহের ক্ষেত্রে সব মা-ই তুলনাহীন।
সেদিন ২২ জুন। বাসার দিকে তাকাতেই আমার চোখ ছানাবড়া! তিন তিনটে বাচ্চা জড়াজড়ি করে ঘুমোচ্ছে! এ কী করে সম্ভব? তিনটে ডিম পর পর তিন দিনে পেড়েছে। বিজ্ঞানের নিয়ম বলে পর পর তিন দিন তিনটে বাচ্চার জন্ম হওয়া উচিত। কিন্তু তা তো হল না! আবার ১৩/১৪ দিন পরেও নয়, প্রথম ডিম পাড়ার ১২ দিন পর, আর শেষ ডিম পাড়ার ১০ দিন পর ডিম ফুটে বাচ্চারা বেরিয়েছে। ব্যতিক্রম? না কি পরিবেশের কোনও প্রভাব? কয়েক মিনিট পরেই উড়ে এল মা, নাকি বাবা? মুখে কিছু খাবার। তিনটে বাচ্চা হাঁ করে খাবার চাইল। মা বুলবুলিটা প্রতিবার উড়ে যায় আর একটা করে খাবার এনে একটা বাচ্চাকে খাইয়ে যায়। আকারে-আচারে প্রজাতিরা আলাদা হলে কী হবে, সন্তানের প্রতি স্নেহের ক্ষেত্রে সব মা-ই তুলনাহীন।

(বাঁদিকে) ফুলের মধু সংগ্রহে ব্যস্ত বুলবুলি। (ডান দিকে) বুলবুলি। ছবি: সংগৃহীত।
চার দিন দেখতে দেখতে কেটে গেল। মাঝে মাঝে লুকিয়ে-চুরিয়ে বাচ্চাগুলোকে দেখে আসছি। মা বা বাবা খাবার আনতে উড়ে গেলে সেই ফাঁকে মোবাইলে ছবিও তুলছি। বাচ্চাদের প্রতিদিন দেখতে না পেলে মনটা ভীষণ খুঁতখুঁত করে। পরের দিন গিয়ে দেখি, এ কী! বাসায় মাত্র একটা বাচ্চা? আশেপাশে প্রচুর কাক দেখেছি। ওরা খেয়ে নেয়নি তো? নাকি প্যাঁচা কিংবা বাজ? দাঁড়াশ সাপও হতে পারে। দুঃখে আমার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। পাখিদের চোখে অশ্রুগ্রন্থি নেই, তাই সন্তানহারা পাখি-মায়ের অশ্রু দেখা যায় না। কিন্তু কষ্টও কি হয় না? খাদ্য-খাদকের নিরন্তর সংগ্রামের মধ্যে দিয়েই ওরা পরিবেশে বাঁচে। কিংবা মরে।
এটাই প্রকৃতির নিয়ম। প্রকৃতির এই নিয়মের কাছে মানুষ যে কতখানি অসহায় তা আমি উপলব্ধি করলাম।
খুব টেনশনে কাটল রাতটা। পুবাকাশ রাঙা হতেই হাত-মুখ না ধুয়ে বেরিয়ে পড়লাম সাইকেল নিয়ে। গেটের তালা খুলে তরতর করে উঠে গেলাম দোতলায়! সর্বনাশ! শূন্য বাসা! একদলা কান্না আমার গলার কাছে যেন আটকে গেল। আমার পা দুটো যেন আটকে গেল ঘরের মেঝেয়। স্বপ্ন দেখেছিলাম তিন বুলবুলির বাচ্চাকে আমার নতুন বাড়ি থেকে নীলাকাশ দেখানোর, নীলাকাশে ওড়ানোর। হল না! খাদ্য-খাদকের অসম লড়াইয়ে এ যাত্রা খাদকই হল জয়ী। মা বুলবুলিটা নিশ্চয়ই অন্য কোনও স্থানে নতুন কোনও বাসা গড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। প্রস্তুতি নিচ্ছে নতুন করে সন্তান প্রতিপালনের। ওদের তো হতাশ হয়ে ভেঙে পড়লে চলে না। মনুষ্যেতর প্রাণীদের জীবনে হতাশার স্থান নেই। একটা ব্যর্থতায় ওদের স্বপ্ন ভেঙে পড়ে না। ওরা নতুন করে বাঁচে। প্রকৃতিকেও বাঁচায়। কিন্তু আমরা ওদের বাঁচানোর জন্য কতটা আগ্রহী?—চলবে।
এটাই প্রকৃতির নিয়ম। প্রকৃতির এই নিয়মের কাছে মানুষ যে কতখানি অসহায় তা আমি উপলব্ধি করলাম।
খুব টেনশনে কাটল রাতটা। পুবাকাশ রাঙা হতেই হাত-মুখ না ধুয়ে বেরিয়ে পড়লাম সাইকেল নিয়ে। গেটের তালা খুলে তরতর করে উঠে গেলাম দোতলায়! সর্বনাশ! শূন্য বাসা! একদলা কান্না আমার গলার কাছে যেন আটকে গেল। আমার পা দুটো যেন আটকে গেল ঘরের মেঝেয়। স্বপ্ন দেখেছিলাম তিন বুলবুলির বাচ্চাকে আমার নতুন বাড়ি থেকে নীলাকাশ দেখানোর, নীলাকাশে ওড়ানোর। হল না! খাদ্য-খাদকের অসম লড়াইয়ে এ যাত্রা খাদকই হল জয়ী। মা বুলবুলিটা নিশ্চয়ই অন্য কোনও স্থানে নতুন কোনও বাসা গড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। প্রস্তুতি নিচ্ছে নতুন করে সন্তান প্রতিপালনের। ওদের তো হতাশ হয়ে ভেঙে পড়লে চলে না। মনুষ্যেতর প্রাণীদের জীবনে হতাশার স্থান নেই। একটা ব্যর্থতায় ওদের স্বপ্ন ভেঙে পড়ে না। ওরা নতুন করে বাঁচে। প্রকৃতিকেও বাঁচায়। কিন্তু আমরা ওদের বাঁচানোর জন্য কতটা আগ্রহী?—চলবে।
* সৌম্যকান্তি জানা। সুন্দরবনের ভূমিপুত্র। নিবাস কাকদ্বীপ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা। পেশা শিক্ষকতা। নেশা লেখালেখি ও সংস্কৃতি চর্চা। জনবিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য ‘দ্য সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল ২০১৬ সালে ‘আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড’ এবং শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান লেখক হিসেবে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ ২০১৭ সালে ‘অমলেশচন্দ্র তালুকদার স্মৃতি সম্মান’ প্রদান করে সম্মানিত করেছে।