(বাঁদিক থেকে) শিকাররত রাতচরা। রাতচরা। (মাঝখানে) বাসায় রাতচরা দম্পতি। (ডান দিকে) ছবি: সংগৃহীত।
আমার শৈশবে সুন্দরবনের গণ্ডগ্রামে সন্ধে হলেই বেশ জোরে জোরে একটা শব্দ পিছনে পুকুরপাড় থেকে শোনা যেত। শব্দটা বাড়ির সামনে খালের দিক থেকেও শুনতে পেতাম। তারস্বরে কেউ বা কারা যেন ডেকে চলেছে—’ওয়াক ওয়াক ওয়াক’। বড়দের মুখে শুনতাম, এই ডাক হল রাতচরার ডাক। রাতচরা হল এক ধরনের বক, যারা সন্ধে হলে খাবারের সন্ধানে বেরোয়।
এদের ওই ডাক শুনে বাড়িতে বাইরের কোনও অতিথি এলে রীতিমতো ঘাবড়ে যেত। যে আগে কখনও রাতচরার ডাক শোনেনি প্রথম শুনলে ভয় পাবেই। তার সঙ্গে এই নাম রাতচরা! নাম শুনলেই অনেকটা ভুতুড়ে-ভুতুড়ে মনে হয়। তবে পাখিগুলোর ডাক শুনতাম, কখনও কখনও আলো-আঁধারিতে উড়ে যেতে দেখতাম, কিন্তু ভালো করে দেখতে পেতাম না। আলো-আঁধারিতে যতটুকু দেখেছি তাতে এদের চেহারা একেবারে বোঝা যেত না তা নয়।
আরও পড়ুন:
সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭৬: সুন্দরবনের পাখি—কুরচি বক
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০১: খামখেয়ালির গিরীন্দ্রনাথ
রাতচরার মাথা আর পিঠের রং কালো, অনেক সময় আলো আঁধারিতে নীলচে বলেও মনে হয়। বাকি গায়ের রঙ ধূসর। গাট্টাগোট্টা চেহারার ছোটখাট বক এরা। লম্বায় হয় ৩৬ থেকে ৩৮ সেন্টিমিটার। সাধারণভাবে বকদের ঘাড় লম্বা হলেও এদের ঘাড় কিন্তু ছোট। এদের চঞ্চুর রঙ হয় কালো। উপরের চঞ্চুর গোড়া থেকে চাঁদির কালো ছোপ পর্যন্ত কিছুটা অংশের রং হয় ধূসর। মাথার চাঁদি থেকে দুটো লম্বা পালক প্রজনন ঋতুতে তৈরি হয় পালক দুটো পিঠ পর্যন্ত বিস্তৃত ও পিঠের উপর নেতিয়ে থাকে।
আরও পড়ুন:
বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-১২: ক্যাথরিন ম্যান্সফিল্ড ও মিডলটন মারে, এক ভালোবাসাহীন বিবাহ
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪৫: ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা এবং চলচ্চিত্র
তবে কখনও কখনও উত্তেজিত হলে পালক দুটো সামান্য খাড়া হয়। এদের দু’পায়ের রং হলদেটে ধূসর আর চোখ দুটো হয় টকটকে লাল বলয় যুক্ত। চোখের চার ধারেও কিছুটা অংশে সাদা পালকের বলয় থাকে। চঞ্চু থেকে চোখ পর্যন্ত পালকহীন অংশের রং কালো বা গাঢ় ধূসর। পুরুষ ও স্ত্রী রাতচরা বাইরে থেকে দেখে বোঝা মুশকিল। তবে পুরুষ রাতচরা স্ত্রী রাতচরার তুলনায় সামান্য বড় হয়।
আরও পড়ুন:
সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭৬: সুন্দরবনের পাখি—কুরচি বক
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৩: হৃদয়পুরের লক্ষ্যপূরণ ‘কঙ্কাবতীর ঘাট’
রাতচরা বকের ইংরেজি নাম ‘Black crowned night heron’, আর বিজ্ঞানসম্মত নাম ‘Nycticorax nycticorax’। গ্রিক শব্দে ‘Nycticorax’ মানে হল রাতের কাক। যেহেতু এরা রাতে খাদ্য সংগ্রহ করতে বেরোয় এবং অনেকটা কাকের মতো তারস্বরে চিৎকার করে ডাকে তাই বিজ্ঞানসম্মত নামকরণের ক্ষেত্রে এই দুটি বৈশিষ্ট্য গ্রাহ্য করা হয়েছে। একে বাংলায় অনেক জায়গায় নিশিবক ও বাচকা নামেও ডাকা হয়। পরিণত রাতচরার পাগুলো ছোট এবং ঘাড়ও ছোট। এরা সন্ধের পর জলাশয়ের ধারে চুপচাপ স্থির হয়ে শিকারের জন্য অপেক্ষা করে। এদের খুব কম দৌড়োতে দেখা যায়। হাঁটার সময় মাথা আর ঘাড় নিচু করে রাখে। রাতচরা দিনের বেলায় কোনও পাতাবহুল গাছের শাখায় দলবল-সহ কিংবা একা থাকলে কোনও ঝোপের মধ্যে চুপচাপ বসে বিশ্রাম নেয়। বড় কচুরিপানার ঝোপের মধ্যে রাতচরাকে বিশ্রাম নিতে আমি দেখেছি। এদের প্রধান খাদ্য মাছ। তাছাড়া চিংড়ি, কাঁকড়া, শামুক, ব্যাঙ, জলজ পোকামাকড় ও ছোট ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণীও খায়।
আরও পড়ুন:
গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-১৪: আমি তাইতে কি ভয় মানি!
রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৪৬: আলাস্কার আকাশে অহরহ ব্যক্তিগত বিমান ওঠানামা করে
এরা একা একা অথবা দলবদ্ধভাবে কোনও বড় গাছের উঁচু ডালের ওপরে বাসা তৈরি করে। এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে এদের প্রজননের সময়। স্ত্রী ও পুরুষ রাতচরার জুটি স্থায়ী হয়, বহুগামিতা দেখা যায় না। অন্যান্য প্রজাতির বকের মতো এদের বাসাও চ্যাপ্টা, অগোছালোভাবে কাঠিকুটো দিয়ে তৈরি। স্ত্রী-পুরুষ মিলে বাসা তৈরি করে। স্ত্রী রাতচরা একবারে ৩-৪টি হালকা নীল রঙের ডিম পাড়ে। ২১-২২ দিন পর ডিম ফুটে বাচ্চা বেরোয়। বাচ্চাদের গায়ের রং হয় বাদামি, আর তার উপর সাদা ছিট থাকে। স্ত্রী ও পুরুষ রাতচরা মিলে বাচ্চার পরিচর্যার দায়িত্ব নেয়। দু’সপ্তাহ বয়স হলে বাচ্চারা বাসা ছেড়ে বেরোয়। তবে ৬/৭ সপ্তাহ পর তারা সম্পূর্ণভাবে বাসা ত্যাগ করে স্বাধীনভাবে বাঁচে। ২/৩ বছর বয়স হলে এরা প্রজনন ক্ষমতা অর্জন করে। আর এরা সাধারণত ১০/১৫ বছর বাঁচে।
(বাঁদিক থেকে) শিকার নিয়ে উড়ন্ত রাতচরা। শিকার করতে উদ্যত রাতচরা। (ডান দিকে) ছবি: সংগৃহীত।
ছোটবেলায় আমি যে পরিমাণ রাতচরা দেখেছি বা ডাক শুনেছি, এখন কিন্তু সুন্দরবন অঞ্চলে সেই পরিমাণ রাতচরার ডাক শোনা যায় না। ফলে সাধারণভাবেই বোঝা যায় যে সুন্দরবনে রাতচরাদের সংখ্যা কমেছে। যদিও আইইউসিএন জানাচ্ছে যে রাতচরা বিপন্ন প্রজাতি নয়। জলাভূমি ধ্বংসের কারণে খাদ্যাভাব হল এদের সংখ্যা কমে যাওয়ার প্রধান কারণ। রাতচরাদের রক্ষা করতে গেলে জলাভূমি রক্ষা করতে হবেই। —চলবে।
* সৌম্যকান্তি জানা। সুন্দরবনের ভূমিপুত্র। নিবাস কাকদ্বীপ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা। পেশা শিক্ষকতা। নেশা লেখালেখি ও সংস্কৃতি চর্চা। জনবিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য ‘দ্য সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল ২০১৬ সালে ‘আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড’ এবং শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান লেখক হিসেবে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ ২০১৭ সালে ‘অমলেশচন্দ্র তালুকদার স্মৃতি সম্মান’ প্রদান করে সম্মানিত করেছে।