(বাঁদিকে) প্রজননক্ষম (মাথা কমলা রং ও প্রজননে অক্ষম (সাদা) গো বক। (মাঝখানে) ডিম-সহ গো বক। (ডান দিকে) ডিমে তা দিচ্ছে গো বক, পাশে সঙ্গী। ছবি: সংগৃহীত।
আমার শৈশব ও কৈশোরকালে আমাদের বাড়িতে অনেক গোরু ছিল। সকালবেলায় গোরুগুলোকে মাঠে লম্বা দড়ি দিয়ে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে চরতে দেওয়া হত। আবার মাঠ থেকে ধান ও খেসারি কলাই তোলা হয়ে গেলে রাখাল ছেলেরা গোরুগুলোকে নিয়ে মাঠে চরাতে যেত। সেই সময় একটা দৃশ্যের সঙ্গে গ্রামের সমস্ত মানুষ পরিচিত ছিল। দৃশ্যটা হল যেখানেই গোরু রয়েছে সেখানেই ঘুরে বেড়াচ্ছে কিছু বক আর শালিক পাখি। শালিক পাখি যদি নাও থাকে বকের উপস্থিতি অবশ্যম্ভাবী। আর এই বকগুলো যে-সে বক নয়। হয় ধবধবে সাদা, নয়তো মাথা ঘাড় আর পিঠের দিকে কমলা রঙওয়ালা বক।
গোরুর পাল যখন চরত কিংবা অনেক গোরু যখন এক জায়গায় ছায়ায় বিশ্রাম নিত তখন তাদের গায়ের খুব কাছে ঘুরতে, এমনকি গায়ের ওপরেও এই বকদের উঠতেও দেখা যেত। দেখা যেত এরা গোরুর গা থেকে এঁটুলি খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে, এমনকি গোরুর কানের ভেতর থেকেও লম্বা ঠোঁট দিয়ে এঁটুলি বার করে খেতে দেখেছি। আজ আর আমাদের গোরু নেই। কিন্তু আজও যেখানেই গোরু চরতে দেখা যায় সেখানেই এক বা একাধিক এই বকদের উপস্থিতি দেখতে পাই। সুন্দরবন এলাকার জনবসতি তো বটেই, সারা ভারত জুড়ে এই বক দেখা যায় গোরু, মোষ, ছাগল, ভেড়া ইত্যাদি গবাদিপশুর গায়ের খুব কাছাকাছি। আর তাই বাংলায় এদের বলা হয় গোবক, ইংরেজিতে ক্যাটেল ইগ্রেট (Cattle egret)। বিজ্ঞানসম্মত নাম ‘Bulbulcus ibis’।
গোরুর পাল যখন চরত কিংবা অনেক গোরু যখন এক জায়গায় ছায়ায় বিশ্রাম নিত তখন তাদের গায়ের খুব কাছে ঘুরতে, এমনকি গায়ের ওপরেও এই বকদের উঠতেও দেখা যেত। দেখা যেত এরা গোরুর গা থেকে এঁটুলি খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে, এমনকি গোরুর কানের ভেতর থেকেও লম্বা ঠোঁট দিয়ে এঁটুলি বার করে খেতে দেখেছি। আজ আর আমাদের গোরু নেই। কিন্তু আজও যেখানেই গোরু চরতে দেখা যায় সেখানেই এক বা একাধিক এই বকদের উপস্থিতি দেখতে পাই। সুন্দরবন এলাকার জনবসতি তো বটেই, সারা ভারত জুড়ে এই বক দেখা যায় গোরু, মোষ, ছাগল, ভেড়া ইত্যাদি গবাদিপশুর গায়ের খুব কাছাকাছি। আর তাই বাংলায় এদের বলা হয় গোবক, ইংরেজিতে ক্যাটেল ইগ্রেট (Cattle egret)। বিজ্ঞানসম্মত নাম ‘Bulbulcus ibis’।
ছোটবেলা থেকে ভাবতাম এই গোবক দু’রকমের হয়। এক রকম হল ধবধবে সাদা, আর এক রকম হল কমলা রঙের মাথা, গলা আর পিঠ ওয়ালা। কিন্তু পরে পড়াশোনা করে জানলাম অ-প্রজনন ঋতুতে গোবকের রং হয় সাদা আর প্রজনন ঋতুতে মাথা, ঘাড় ও পিঠের রং হয় কমলা বা সোনালি হলুদ। শুধু তাই নয়, প্রজনন ঋতুতে গোবকের পা ও চঞ্চুর রং হয় কমলা। অ-প্রজনন ঋতুতে গোবকের পায়ের রং হয় হলদেটে ধূসর, আর চঞ্চুর রং হয় হলুদ। অপরিণত গোবকদের পালকের রং হয় সাদা, আর চঞ্চুর রং হয় কালো। এই রঙের পরিবর্তন স্ত্রী ও পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই ঘটে। সাদা চোখে স্ত্রী ও পুরুষ গোবক একই রকম দেখতে হলেও স্ত্রীর তুলনায় আকারে পুরুষ খুব সামান্য বড় হয়।
আরও পড়ুন:
সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭৩: সুন্দরবনের পাখি—কোঁচ বক
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৮: মংপুর কমলালেবু পেয়ে অসুস্থ কবি খুব আনন্দ পেয়েছিলেন
গোবক লম্বায় হয় ১৮ থেকে ২২ ইঞ্চি, আর ডানা প্রসারিত করলে তা ৩৪ থেকে ৩৮ ইঞ্চি প্রসারিত হয়। এদের ওজন হয় ২৭০ থেকে ৫০০ গ্রাম, গড়ে ৪০০ গ্রাম। এদের দেখলে মনে হবে যেন গো বেচারা কিন্তু এরা বেশ সাহসী ও মেজাজি হয়। শিকার করার ক্ষেত্রে এরা বেশ কৌশলী। মাটির ওপর বা ঘাসবনের ওপর লম্বা পা ফেলে মার্চ করার ভঙ্গিতে হাঁটতে দেখা যায়। আবার হাঁটতে হাঁটতেই মাটি থেকে কিছুটা উপরে উড়ন্ত পোকাকে জিমন্যাস্টের মত লাফিয়ে শিকার করতে ওস্তাদ। আগেই বলেছি গোরু, ছাগল, ভেড়া, মোষ ইত্যাদির গা থেকে পরজীবী এঁটুলি খুঁটে খেতে এরা খুব পছন্দ করে। গবাদি পশুর পায়ে, পেটে এমনকি নাকের মধ্যে জোঁক আটকে গেলে এরা জোঁক বার করে দেয়। যদিও এরা জোঁক খায় না। নাকের মধ্যে জোঁক ঢুকলে গোরু বকের সামনে নাক এগিয়ে হাঁচতে থাকে। তখন কাছাকাছি থাকা গোবক বুঝে যায় তাকে কী করতে হবে। এগিয়ে এসে গোরুর নাকে চঞ্চু ঢুকিয়ে জোঁক বার করে আনে। গবাদি পশুর সঙ্গে গোবকের এই অসাধারণ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয় প্রোটো কো-অপারেশন (Proto Co-operation)।
আরও পড়ুন:
রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৮৮: পালাবার কোনও পথ নেই
রহস্য উপন্যাস: হ্যালো বাবু!, পর্ব-৫৪: আততায়ী এক, নাকি দুই?
অনেক সময় রাস্তাঘাটে বা মাঠে গোরু বা মোষকে দেখা যায় পা ছড়িয়ে আরামে শুয়ে আছে, আর গোবক তার পেট, পা, কান, চোখের পাতা, শিঙের গোড়া বা গলকম্বল থেকে খুঁটে খুঁটে এঁটুলি খাচ্ছে। সুন্দরবনের জঙ্গলে বা নদীর চরে বুনো শুকর ও হরিণের সাথেও গোবকের এমন বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বন্যপ্রেমীদের দৃষ্টি এড়ায় না। তবে এরা যে খাবারের ব্যাপারে গবাদি পশুর ওপরে নির্ভর করে বাঁচে তা নয়। এদের প্রধান খাদ্য হল পোকামাকড়, মাছি, ফড়িং, গুবরে পোকা, মথ, মাকড়সা, গিরগিটি, ব্যাঙ, সাপের বাচ্চা, টিকটিকি ইত্যাদি। গোরু, মোষ যখন চরে বেড়ায় তখন খুরের আঘাতে মাটি ও ঘাসের মধ্যে থেকে পোকামাকড় বেরিয়ে আসে। তখন মহানন্দে এরা সেই পোকামাকড় শিকার করে। অতি সম্প্রতি একটা দৃশ্য নজরে এসেছিল – একটা গোরু একবুক জলে দাঁড়িয়ে ঘাস খাচ্ছে আর তার পিঠের ওপর বসে একটা গোবক। চলন্ত ট্রেন থেকে ছবি তুলতে পারিনি বলে আফশোস হচ্ছিল।
আরও পড়ুন:
বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-১০: ভার্জিনিয়া ও লিওনার্ড উলফ—উন্মাদনা ও সৃষ্টি /২
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫১: সেই ‘পৃথিবী আমারে চায়’
গোবক কিন্তু জলচর পাখি নয়। এরা মূলত স্থলেই ঘুরে বেড়ায়। তাই এদের দৃষ্টিশক্তিতে কিছু উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়েছে যা জলচর বকদের ক্ষেত্রে আলাদা। এদের দৃষ্টিশক্তি অনেকটা মানুষের মতো অর্থাৎ দুটি চোখ দিয়ে একটি বস্তু দেখতে পায়। আমাদের যেমন কোনও বস্তুর দিকে তাকালে দুটো চোখ সেই দিকেই ঘুরে যায় এদেরও তেমন হয়। এর সুবিধা হল অল্প আলোতে বা রাতে খুব কাছে থেকে শিকার ধরতে সুবিধে হয়। তাই এই বকদের খুব সকালে বা সন্ধ্যেবেলায় অল্প আলোতে সচ্ছন্দে শিকার করতে দেখা যায়। কখনও কখনও মেঘলা দিনে বা চাঁদনী রাতে শিকার করতেও দেখা যায়। আবার যেহেতু জলের মধ্যে মাথা ডুবিয়ে শিকার করে না তাই বাতাসে ও জলে আলোর প্রতিসরণ মানিয়ে নেওয়ার যে বৈশিষ্ট্য জলচর বকদের ক্ষেত্রে দেখা যায় তা এদের অনুপস্থিত।
আরও পড়ুন:
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৬৪ : অকারণে কেউ অন্যের ভালো করতে যায় না
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৭০: ভানুপিসি ও শ্রীমার ভক্ত
সকাল বা সন্ধেয় প্রায়শই এদের সারি বেঁধে উড়ে যেতে দেখা যায়। ওড়ার সময় এদের গলা ইংরেজি ‘S’-এর মতো বেঁকে দুই ডানার মাঝখানে ঢুকে থাকে। এরা জলের উৎসের কাছাকাছি কোনও বড় গাছে যেমন বাসা বাঁধতে পারে তেমনই জলাশয় থেকে দূরেও বাসা বাঁধতে পারে। এরা অন্যান্য প্রজাতির বক, সারস ও পানকৌড়িদের সঙ্গে গোষ্ঠীবদ্ধভাবে একই গাছে বাসা বানায়। প্রজনন ঋতুতে পুরুষ গোবক নানারকম ভঙ্গি করে স্ত্রী গোবকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায়। কখনও দেখা যায় সে গাছের ছোট্ট শাখাকে দোলাচ্ছে কিংবা আকাশের দিকে চঞ্চু তুলে কিছু বলার চেষ্টা করছে। একটি প্রজনন ঋতুতে স্ত্রী ও পুরুষ গোবক একবারই জোড় বাঁধে। এই জোড় চিরস্থায়ী নয়।
(বাঁদিকে) অ-প্রজনন ঋতুতে গো বক। (মাঝখানে) উড়ন্ত গো বক। (ডান দিকে) গোরুর সঙ্গে গো বক। ছবি: সংগৃহীত।
সাধারণত পুরুষ কাঠকুটো সংগ্রহ করে আনে এবং স্ত্রী বাসা বানায়। বাসা চেটালো এবং খুবই অগোছালো, অনেকটা কাকের বাসার মতো। বাসা বানানো শেষ হলে স্ত্রী গোবক তিন থেকে পাঁচটি নীলচে সাদা রঙের ডিম পাড়ে। তারপর স্ত্রী ও পুরুষ পালা করে ডিমে তা দেয়। ২০ থেকে ২৫ দিনের মধ্যে ডিম ফুটে ছানারা বেরিয়ে আসে। বাচ্চারা দু’সপ্তাহের মধ্যে বাসা ছেড়ে গাছের শাখায় বসতে শেখে। ৩০ দিন বয়সের মধ্যে ওরা উড়তে শিখে যায়। আর ৪৫ দিনের মধ্যে পুরোপুরি স্বাধীন হয়ে যায়। তবে দেখা গেছে সমস্ত বাচ্চা বাঁচে না। মূলত খাদ্যাভাবে এবং বাচ্চাদের মধ্যে খাবারের জন্য প্রতিযোগিতার কারণে অপুষ্টিতে ভোগা দুর্বল বাচ্চারা মারা যায়। খাদ্যের মধ্যে ব্যাঙ, টিকটিকি ইত্যাদি যদি খুব কম বা না থাকে তাহলে বাচ্চারা ক্যালসিয়ামের অভাবে ভোগে এবং তাদের হাড়ের গঠনে অস্বাভাবিকতা দেখা যায়। তাই গোবকদের মধ্যে শিশুমৃত্যুর হার অপেক্ষাকৃত বেশি।
প্রকৃতির এই নিরীহ সুন্দর প্রাণীটির সংখ্যা সুন্দরবনে আগে যে পরিমাণে দেখা যেত এখন সেই পরিমাণ দেখা যায় না। মনে হয় গবাদি পশুর সংখ্যা হ্রাস এবং জনবসতির চাপ অন্যতম কারণ। এরা অনেক ক্ষতিকর পোকামাকড় খেয়ে ফসল রক্ষায় যেমন সাহায্য করে তেমনই বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য বজায় রাখে। যদিও IUCN-এর তালিকায় এরা বিপন্ন নয় তবুও এই উপকারী পাখিটিকে রক্ষা করার দায় আমাদের।—চলবে।
প্রকৃতির এই নিরীহ সুন্দর প্রাণীটির সংখ্যা সুন্দরবনে আগে যে পরিমাণে দেখা যেত এখন সেই পরিমাণ দেখা যায় না। মনে হয় গবাদি পশুর সংখ্যা হ্রাস এবং জনবসতির চাপ অন্যতম কারণ। এরা অনেক ক্ষতিকর পোকামাকড় খেয়ে ফসল রক্ষায় যেমন সাহায্য করে তেমনই বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য বজায় রাখে। যদিও IUCN-এর তালিকায় এরা বিপন্ন নয় তবুও এই উপকারী পাখিটিকে রক্ষা করার দায় আমাদের।—চলবে।
* সৌম্যকান্তি জানা। সুন্দরবনের ভূমিপুত্র। নিবাস কাকদ্বীপ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা। পেশা শিক্ষকতা। নেশা লেখালেখি ও সংস্কৃতি চর্চা। জনবিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য ‘দ্য সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল ২০১৬ সালে ‘আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড’ এবং শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান লেখক হিসেবে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ ২০১৭ সালে ‘অমলেশচন্দ্র তালুকদার স্মৃতি সম্মান’ প্রদান করে সম্মানিত করেছে।