(বাঁদিকে) বিশ্রামরত লাল কাঁক। (মাঝখানে) বাসায় শাবকসহ লাল কাঁক। (ডান দিকে) লাল কাঁকের মাছ শিকার। ছবি: সংগৃহীত।
লাল কাঁক নামক পাখিটার নাম শুনেছি খুব ছোটবেলা থেকে। সন্ধে নাগাদ কখনও কখনও দেখতাম বেশ বড় আকারের পাখি ডানা ঝাপটে উড়ে যাচ্ছে। আওয়াজ শুনতাম ‘কোয়ারাং’। জিজ্ঞাসা করলে কখনও বাবা, কখনও ঠাকুমার মুখে শুনতাম— এটা লাল কাঁক পাখি ডাকছে। একেবারে শৈশবে এই পাখিকে দিনের আলোয় চোখে দেখেছিলাম কিনা তা আজ আর মনে নেই। তবে জ্ঞান হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত এই লাল কাঁক পাখি দেখার সুযোগ হয়নি। শুনেছি জঙ্গল লাগোয়া কিছু জলা জায়গায় কেউ কেউ দেখেছে।
বাংলাদেশে এখনও এই পাখিটিকে যথেষ্ট পরিমাণে দেখা যায় বলে জানা গেছে। তবে পশ্চিম সুন্দরবন অংশে অর্থাৎ যেখানে জঙ্গল সাফ করে দ্রুত জনবসতি গড়ে উঠেছে গত দেড়শো বছরে সেখানে এদের আজকাল দেখা যায় না, আর এদের ডাকও শোনা যায় না। তবে এই পাখিটি যে একসময় পশ্চিম সুন্দরবন অঞ্চলে বহুল পরিমাণে দেখা যেত তা অতি বয়স্ক মানুষদের কাছ থেকে আজও জানা যায়।
এই কাঁক পাখিকে লাল কাঁক বলা হলেও ইংরেজিতে অবশ্য এই পাখিকে বলে পারপেল হেরন অর্থাৎ বেগুনি বক। সুন্দরবনের মানুষ কেন বলে লাল কাঁক? আসলে এদের গলা ও মাথার অংশ কিছুটা লালচে রঙের হয়। আবার পাখা ও পিঠের উপরের অংশ লালচে বেগুনি রংয়ের হয়। আর এরা আসলে বক জাতীয় পাখি। তাই ইংরেজিতে পারপেল হেরন। কাঁক শব্দের আভিধানিক অর্থ হল বকজাতীয় পাখি। সেই অর্থে এই পাখিটির স্থানীয় নাম হল লাল কাঁক।
বাংলাদেশে এখনও এই পাখিটিকে যথেষ্ট পরিমাণে দেখা যায় বলে জানা গেছে। তবে পশ্চিম সুন্দরবন অংশে অর্থাৎ যেখানে জঙ্গল সাফ করে দ্রুত জনবসতি গড়ে উঠেছে গত দেড়শো বছরে সেখানে এদের আজকাল দেখা যায় না, আর এদের ডাকও শোনা যায় না। তবে এই পাখিটি যে একসময় পশ্চিম সুন্দরবন অঞ্চলে বহুল পরিমাণে দেখা যেত তা অতি বয়স্ক মানুষদের কাছ থেকে আজও জানা যায়।
এই কাঁক পাখিকে লাল কাঁক বলা হলেও ইংরেজিতে অবশ্য এই পাখিকে বলে পারপেল হেরন অর্থাৎ বেগুনি বক। সুন্দরবনের মানুষ কেন বলে লাল কাঁক? আসলে এদের গলা ও মাথার অংশ কিছুটা লালচে রঙের হয়। আবার পাখা ও পিঠের উপরের অংশ লালচে বেগুনি রংয়ের হয়। আর এরা আসলে বক জাতীয় পাখি। তাই ইংরেজিতে পারপেল হেরন। কাঁক শব্দের আভিধানিক অর্থ হল বকজাতীয় পাখি। সেই অর্থে এই পাখিটির স্থানীয় নাম হল লাল কাঁক।
আরডেইডায়ি গোত্রের বক জাতীয় পাখি হল লাল কাঁক। বিজ্ঞানসম্মত নাম ‘Ardea purpurea’। পৃথিবীতে মোট চারটি উপপ্রজাতির লাল কাঁক বা পার্পেল হেরন দেখা যায়। ভারতে তথা সুন্দরবনে এই প্রজাতির যে উপপ্রজাতি পাওয়া যায় সেটি হল মানিলেনসিস (manilensis)। আফ্রিকা মহাদেশের মধ্যভাগে উত্তর ইউরোপে এবং এশিয়ার ভারত বাংলাদেশ ও নেপালে বেগুনি বক বা পার্পেল হেরন দেখা যায়। পার্পেল হেরন যদিও অনেক জায়গায় পরিযায়ী পাখি হিসেবে থাকে কিন্তু সুন্দরবনে এরা স্থায়ী পাখি। অগভীর জলাভূমিতে এদের বিচরণ। তবে সেই সব জলাভূমিতে অবশ্যই শর জাতীয় ঘাসের ঘন ঝোপ-জঙ্গল থাকা চাই।
পূর্ণবয়স্ক লাল কাঁক বা বেগুনি বক দৈর্ঘ্যে হয় প্রায় ৭৮ থেকে ১০০ সেন্টিমিটার। আর দাঁড়ানো অবস্থায় ৭০ থেকে ৯৫ সেন্টিমিটার উঁচু হয়। দু’দিকে ডানা ছড়ালে তা প্রায় ১২০ থেকে ১৫২ সেন্টিমিটার প্রসারিত হয়। আর ওজন হয় ৫০০ গ্রাম থেকে ১৩০০ গ্রাম। স্ত্রী ও পুরুষ দেখতে একই রকম হয়। স্থির অবস্থায় এদের গলা দেখতে হয় ইংরেজি ‘S’–এর মতো বাঁকা। পূর্ণবয়স্ক লাল কাঁকের মাথা থেকে দু’ দিকের চোখ হয়ে ঘাড়ের দু’ দিক দিয়ে দুটো কালো ডোরা নেমে আসে।
পূর্ণবয়স্ক লাল কাঁক বা বেগুনি বক দৈর্ঘ্যে হয় প্রায় ৭৮ থেকে ১০০ সেন্টিমিটার। আর দাঁড়ানো অবস্থায় ৭০ থেকে ৯৫ সেন্টিমিটার উঁচু হয়। দু’দিকে ডানা ছড়ালে তা প্রায় ১২০ থেকে ১৫২ সেন্টিমিটার প্রসারিত হয়। আর ওজন হয় ৫০০ গ্রাম থেকে ১৩০০ গ্রাম। স্ত্রী ও পুরুষ দেখতে একই রকম হয়। স্থির অবস্থায় এদের গলা দেখতে হয় ইংরেজি ‘S’–এর মতো বাঁকা। পূর্ণবয়স্ক লাল কাঁকের মাথা থেকে দু’ দিকের চোখ হয়ে ঘাড়ের দু’ দিক দিয়ে দুটো কালো ডোরা নেমে আসে।
আরও পড়ুন:
গল্পবৃক্ষ, পর্ব-১: হাতির মতো বুদ্ধি?
শারদীয়ার গল্প: তখন বিকেল/৩
তবে বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এই ডোরা তৈরি হয় না। এদের মাথার চাঁদির রং কালো হলেও গলার সামনের দিক হয় সাদা। বুকের নিচের দিকের পালকের রং হয় গাঢ় বাদামি। ডানার উপরের দিকের পালকের রঙ হালকা ধূসর হলেও ডানার নিচের দিকের পালকের রং গাঢ় বাদামি। এদের চঞ্চুর রঙ হয় হলুদ যদিও আগার দিকটা হয় বাদামি, ধারালো এবং সরু। আর চঞ্চুর নিচের দিকের রঙ লালচে।
অবশ্য প্রজনন ঋতুতে এদের চঞ্চুর রং হয় উজ্জ্বল হলুদ। বাচ্চাদের পিঠের দিকে সাদা ও বাদামি রঙের ছিট ছিট দাগ থাকে। আরও এক ধরনের কাঁক এখানে দেখা যায় যা ধূসর বক বা গ্রে হেরন নামে পরিচিত। তবে এদের থেকে লাল কাঁকের আকার সামান্য ছোট, গড়ন রোগাটে এবং পালকের রং অপেক্ষাকৃত গাঢ়। তাই সহজেই এই দুই ধরনের বকজাতীয় পাখিকে আলাদাভাবে চেনা যায়।
অবশ্য প্রজনন ঋতুতে এদের চঞ্চুর রং হয় উজ্জ্বল হলুদ। বাচ্চাদের পিঠের দিকে সাদা ও বাদামি রঙের ছিট ছিট দাগ থাকে। আরও এক ধরনের কাঁক এখানে দেখা যায় যা ধূসর বক বা গ্রে হেরন নামে পরিচিত। তবে এদের থেকে লাল কাঁকের আকার সামান্য ছোট, গড়ন রোগাটে এবং পালকের রং অপেক্ষাকৃত গাঢ়। তাই সহজেই এই দুই ধরনের বকজাতীয় পাখিকে আলাদাভাবে চেনা যায়।
আরও পড়ুন:
বাংলাকে ধ্রুপদী ভাষার স্বীকৃতি: বাংলা বুকের ভিতরে
পর্দার আড়ালে, পর্ব-৬২: সত্যজিৎ রায় রুপটান শিল্পীকে বলেছিলেন, উত্তমকুমারের কোনও মেকআপ করার
বেশিরভাগ সময় এরা একা একা ঘুরে বেড়ালেও প্রজনন ঋতুতে সাধারণত একটি পুরুষ ও একটি স্ত্রী লাল কাঁক জোড় বাঁধে। বর্ষাকাল হল এদের প্রজনন ঋতু। জোড় বাঁধার আগে চলে মন দেওয়া-নেওয়ার পালা। তখন পরস্পরের মন পাওয়ার জন্য নানা রকম ভঙ্গিতে প্রেম নিবেদন করতে দেখা যায়। বিভিন্ন রকম ভঙ্গির মধ্যে একটি ভঙ্গি ভারি সুন্দর—পুরুষ সঙ্গীটি স্ত্রী পাখির সামনে মাথাটাকে একবার নিচু করে সোজা উপরে তুলে ধরে আর তারপর স্ত্রী পাখি পুরুষ পাখিটির বুকে আলতো করে তার মাথাটি রেখে দেয়!
আগেই বলেছি, জলাভূমিতে শর জাতীয় গাছের প্রাধান্য যেখানে রয়েছে সেখানে এরা বাসা বাঁধে। কারণ এই গাছের ঝোপ ঘন না হলে ডিম ও বাচ্চাদের শিকারি প্রাণীর হাত থেকে রক্ষা করা মুশকিল। আর এরা সেই সব জলাভূমি পছন্দ করে যেখানে জল সাধারণত ০.৪ থেকে ১.৫ মিটার গভীর। অবশ্য একান্ত নিরুপায় হলে তখন জলাভূমির পাশে কোনও বড় গাছে বাসা বাঁধতে দেখা যায়। স্ত্রী ও পুরুষ মিলে খড়কুটো দিয়ে বাসা বাঁধতে প্রায় এক সপ্তাহ সময় নেয়।
আগেই বলেছি, জলাভূমিতে শর জাতীয় গাছের প্রাধান্য যেখানে রয়েছে সেখানে এরা বাসা বাঁধে। কারণ এই গাছের ঝোপ ঘন না হলে ডিম ও বাচ্চাদের শিকারি প্রাণীর হাত থেকে রক্ষা করা মুশকিল। আর এরা সেই সব জলাভূমি পছন্দ করে যেখানে জল সাধারণত ০.৪ থেকে ১.৫ মিটার গভীর। অবশ্য একান্ত নিরুপায় হলে তখন জলাভূমির পাশে কোনও বড় গাছে বাসা বাঁধতে দেখা যায়। স্ত্রী ও পুরুষ মিলে খড়কুটো দিয়ে বাসা বাঁধতে প্রায় এক সপ্তাহ সময় নেয়।
আরও পড়ুন:
বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩
মুভি রিভিউ: মামুটির মাল্টিস্টারার ছবি ‘সিবিআই ৫: দ্য ব্রেন’ গতানুগতিক থ্রিলার
সাধারণত ৫ থেকে ২০ মিটার দূরে দূরে লাল কাঁকেরা বাসা বাঁধে। প্রতিটি বাসা ৫ থেকে ১০ সেন্টিমিটার গভীর হয় এবং ব্যাস হয় ০.৫ থেকে ০.৮ মিটার। জল থেকে সাধারণত এক মিটার উচ্চতায় এরা বাসা বাঁধে। যদি জলের উচ্চতা হঠাৎ অনেকটা বেড়ে যায় বা কমে যায়, তাহলে এরা বাসা ত্যাগ করে অন্যত্র বাসা তৈরি করে। একটি স্ত্রী লাল কাঁক এক একবারে ৩ থেকে ৪ ডিম পাড়ে। স্ত্রী ও পুরুষ মিলে ডিমে তা দেয়। ২০ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে ডিম ফুটে বাচ্চা বেরিয়ে আসে। মা ও বাবা খাবার এনে অর্ধপাচিত খাবার উগরে দিয়ে বাচ্চাকে খাওয়ায়। ১০ দিন বয়স পর্যন্ত এইরকম চলে। তারপর অবশ্য সরাসরি খাবার খাওয়ায়। ৪০ থেকে ৫০ দিন বয়স হলে বাচ্চারা উড়তে সক্ষম হয়, আর প্রায় ৫৬ দিনে স্বনির্ভর হয়ে ওঠে। তবে জননে সক্ষম হতে হতে ওদের দু’বছর সময় লাগে।
আরও পড়ুন:
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৮১: তথাকথিত পরিচয়হীন প্রতিভার মূল্যায়ন কী শুধুই সাফল্যের নিরিখে সম্ভব?
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ
লাল কাঁক সর্বোচ্চ প্রায় ২৫ বছর বাঁচে। এদের খুব ভোরবেলা ও সন্ধেবেলা খাবার সংগ্রহ করতে দেখা যায়। দিনের বেলায় এরা সাধারণত নিষ্ক্রিয় থাকে। অন্যত্র পরিযায়ী স্বভাব দেখা গেলেও সুন্দরবনের লাল কাঁক স্থায়ী পাখি। বিপদ বুঝলে এরা এক ধরনের শব্দ সৃষ্টি করে শত্রুর দিকে তেড়ে যায়, আবার কখনও কখনও স্থির দৃষ্টিতে নিশ্চল হয়ে শত্রুর দিকে তাকিয়ে থাকে। এদের প্রধান খাবার হল মাছ তবে ব্যাঙ, সাপ, কাঁকড়া, চিংড়ি বা বিভিন্ন জলজ পোকামাকড়ও এরা খায়। এরা শিকার ধরার সময় খুব বেশি হাঁটাহাঁটি করে না। এক জায়গায় গলা ‘S’-এর মতো করে অনেকক্ষণ স্থির হয়ে থাকে, কিন্তু শিকার দেখলেই অত্যন্ত দ্রুত গলা লম্বা করে শিকার ধরে নেয়।
(বাঁদিকে) ঊড়ন্ত লাল কাঁক। (ডান দিকে) শিকার মুখে লাল কাঁক। ছবি: সংগৃহীত।
ভারতীয় সুন্দরবনের জনবসতি পূর্ণ অঞ্চলে লাল কাঁক আর দেখা যায় না। বিপুল পরিমাণে জলাভূমি ধ্বংস এবং সবুজ ধ্বংসের কারণে এরা এই অঞ্চল থেকে হারিয়ে গিয়েছে। অতীতে ধানের জমিতেও এদের মাছ সংগ্রহ করতে দেখা যেত। কিন্তু রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় ধানের জমিতে আর মাছ দেখা যায় না। স্বভাবতই বাসস্থানের অভাব ও খাদ্যাভাব এদের বিপন্ন করে দিয়েছে। যদিও কাকদ্বীপ এলাকায় এদের আর দেখা যায় না কিন্তু‘কাকদ্বীপ’নামের উৎপত্তির সঙ্গে এই কাঁক পাখির কোনও সম্পর্ক থাকতে পারে বলে আমার বিশ্বাস।—চলবে।
* সৌম্যকান্তি জানা। সুন্দরবনের ভূমিপুত্র। নিবাস কাকদ্বীপ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা। পেশা শিক্ষকতা। নেশা লেখালেখি ও সংস্কৃতি চর্চা। জনবিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য ‘দ্য সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল ২০১৬ সালে ‘আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড’ এবং শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান লেখক হিসেবে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ ২০১৭ সালে ‘অমলেশচন্দ্র তালুকদার স্মৃতি সম্মান’ প্রদান করে সম্মানিত করেছে।