বৃহস্পতিবার ৩০ জানুয়ারি, ২০২৫


গিরিশচন্দ্রের অত্যন্ত স্নেহভাজন শ্রীশচন্দ্র মতিলাল অনেকদিন থেকে গিরিশচন্দ্রকে ‘বিশ্বামিত্র’ নাটক লিখতে অনুরোধ করেছিলেন। এই নিয়ে গিরিশচন্দ্রের সঙ্গে মতিলালের যখনই দেখা হতো তখনই তিনি এই অনুরোধটা করতেন। গিরিশচন্দ্র কাশীধামে অবস্থানকালে সেই অনুরোধটি কার্যে পরিণত করেছিলেন। রামকৃষ্ণ সেবাশ্রম লাইব্রেরি থেকে এনে মন দিয়ে রামায়ণ পড়ে নিয়ে গিরিশচন্দ্র তপোবল নাটকটি লিখতে আরম্ভ করলেন। তখন গিরিশচন্দ্র অসুস্থ ছিলেন বলে একটু সময় লাগলো এই নাটকটি মঞ্চস্থ হতে। অবশেষে মিনার্ভা থিয়েটারে ১৯১১ সালের ১৮ নভেম্বর প্রথম অভিনীত হল নাটকটি।
এতে মুখ্য চরিত্রগুলিতে অভিনয় করলেন সুরেন্দ্রনাথ ঘোষ (বিশ্বামিত্র), হরি ভূষণ ভট্টাচার্য (বশিষ্ট), সত্যেন্দ্রনাথ দে (ব্রহ্মা), সুন্দরী (বেদ মাতা), তারা সুন্দরী (সুনেত্রা), তিন করিদাসী (বদরী), সরোজিনী দেবী (মেনকা) এবং চারুশীলা দেবী (রম্ভা)। স্বত্বাধিকারীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন মহেন্দ্রকুমার মিত্র। অধ্যক্ষ অবশ্যই গিরিশচন্দ্র ঘোষ। এই নাটকে অভিনয় শিক্ষা দিয়েছিলেন শিল্পীদের গিরিশচন্দ্র ঘোষ এবং হরি ভূষণ ভট্টাচার্য সম্মিলিতভাবে। সংগীত শিক্ষক দেবকণ্ঠ বাগচী। নৃত্য শিক্ষক ছিলেন সাতকড়ি গঙ্গোপাধ্যায়। মেকাপের দায়িত্বে ছিলেন কালীচরণ দাস।
আরও পড়ুন:

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৪২: আর যাহা খাও বাপু বিষমটি খেয়ো না

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৪৩: ইউ এফ ও

ইতিমধ্যেই কোহিনুর থিয়েটারে বিশ্বামিত্র নাম নিয়ে একটি নতুন নাটকের অভিনয় চলছিল। সুতরাং মিনার্ভা থিয়েটারে যখন তপোবল নাটকটি শুরু হল তখন বিষয়ের মধ্যে নতুনত্ব ছিল না ঠিকই, তবে তপোবলের অভিনবত্বে দর্শকগণকে অপর্যাপ্ত আনন্দদানের সমর্থ হয়েছিল। বিশ্বামিত্র, বশিষ্ট, সুনেত্রা, বদরী প্রমুখ প্রত্যেকটি চরিত্রই দর্শকদের হৃদয়স্পর্শী লেগেছিল। তার প্রধান কারণ গিরিশচন্দ্র ঘোষ অসুস্থ থাকলেও নিজের বাড়িতে বসে শিল্পীদের শিক্ষাদান করিয়েছিলেন এবং সেখানে তাঁকে হরিভূষণ বাবুও যথেষ্ট সহায়তা করেছিলেন।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫৩: মহীয়সী গৃহস্থনারী মা সারদা

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৪: জোড়াসাঁকোয় পাগল-যাচাই

নাটকের রস এবং ঘটনা আবর্তিত হয়েছে দারুণ ভাবে। একদিকে বিশ্বামিত্র যেমন ক্ষত্রিয় তেজ চঞ্চল, অন্যদিকে বশিষ্ট তেমন ব্রাহ্মণ্য মহিমায় স্থির-ধীর। বিশ্বামিত্র এবং বশিষ্ট ছাড়া নাটকে প্রায় অন্যান্য সকল চরিত্রই বলতে গেলে অভিনব।

আরেকটি জিনিস এই নাটকের লক্ষণীয় তা হল গিরিশচন্দ্রের পূর্বে আর কোন নাট্যকার বঙ্গ সাহিত্যে নতুনভাবে অপ্সরা চরিত্র অঙ্কন করতে পারেননি, যেমন করে মেনকা, রম্ভাকে আঁকা হয়েছে তাঁর এই তপোবল নাটকের মধ্যে। তপোবল কবি প্রতিভার শেষ দীপ্তি। তপোগৌরব এবং ব্রাহ্মণ্য মহিমা এই নাটকের মূলিভূত বিষয়। গিরিশচন্দ্র নাটকে রামায়ণ থেকে মূল কাহিনী সংগ্রহ করলেও অভিনব সৃষ্টি চাতুর্যে এবং নৈপুণ্যে একে একটি সম্পূর্ণ নতুন নাটক বললে অত্যুক্তি হয় না।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-১: টলস্টয় ও সোফিয়া—প্রেম ও বিবাহ/১

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৫: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— আমুর ও গোশিঙা

গিরিশ প্রতিভার শেষ দীপ্তি হলেও এতে তাঁর মাহাত্ম্য গৌরবে নাটকটি গৌরবান্বিত। তপোবল নাটকের শেষ দৃশ্যের কল্পনা যেমন নূতন তেমনি অতুলনীয়। ভাবে, ভাষায়, উচ্চতায়, রসবৈচিত্র্যে, চরিত্রের ক্রমবিকাশে ‘তপোবল’ গিরিশচন্দ্রের প্রথম শ্রেণির নাটকের সমকক্ষ।

এই নাটক তিনি উৎসর্গ করেছিলেন ভগিনী নিবেদিতাকে। উৎসর্গ পত্রে তিনি লিখছেন, “পবিত্রা নিবেদিতা, বৎস! তুমি আমার নূতন নাটক হইলে আমোদ করিতে। আমার নূতন নাটক অভিনীত হইতেছে, তুমি কোথায়? কাল দার্জিলিং যাইবার সময়, আমায় পীড়িত দেখিয়া স্নেহ বাক্যে বলিয়া গিয়াছিলে, ‘আসিয়া যেন তোমায় দেখিতে পাই’। আমি তো জীবিত রহিয়াছি, কেন বৎসে, দেখা করিতে আইস না? শুনিতে পাই, মৃত্যু শয্যায় আমার স্মরণ করিয়াছিলে, যদি দেবকার্য্যে নিযুক্ত থাকিয়া এখনও আমায় তোমার স্মরণ থাকে, আমার অশ্রুপূর্ণ উপহার গ্রহণ করো।”—চলবে।
* নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের সন্ধানে (Girish Chandra Ghosh–Actor –Theatre) : ড. শঙ্কর ঘোষ (Shankar Ghosh) বিশিষ্ট অধ্যাপক ও অভিনেতা।

Skip to content