সোমবার ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


‘শংকরাচার্য’ নাটকের আশাতীত সাফল্য গিরিশচন্দ্রকে পুনরায় ধর্ম বিষয়ক নাটক রচনা করতে উৎসাহ প্রদান করেছিল। কিন্তু গিরিশচন্দ্রের বিশেষ প্রিয় পাত্র ছিলেন কুমুদ বন্ধু সেন। তিনি অনুরোধ করলেন গিরিশচন্দ্রকে অশোকের জীবন নিয়ে নাটক লিখতে। অশোক নাটকে দেখতে পাওয়া যায় যে সব চরিত্রেই মানবীয় সহানুভূতির (Human sympathy) অভাব। এতে পতিপত্নী সম্বন্ধ আছে কিন্তু তাতে যেন উন্মাদানা নেই। ভ্রাতৃস্নেহ পুত্রবাৎসল্য আছে তাতে কোনও আসক্তি নেই। নায়ক অশোক যেন অন্য জগতের মানুষ। মানবীয় সহানুভূতির বহু দূরে। এই জন্য সম্ভবত এই নাটক সাধারণ দর্শকের সহানুভূতি আকর্ষণ করতে তেমনভাবে সক্ষম হয়নি।
তবে নাটকটি নিবিষ্ট চিত্তে যদি পড়াশুনা করা যায় তাহলে বোঝা যায় যে গিরিশচন্দ্র এতে কি উচ্চাঙ্গের নাট্যকলার বিকাশ করেছেন। এখন প্রশ্ন হল, ‘অশোক’ কি ঐতিহাসিক নাটক? সে সময়ে অশোক সম্বন্ধে যা কিছু ঐতিহাসিক তথ্য আবিষ্কৃত হয়েছিল গিরিশচন্দ্র পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তার অনুসন্ধান করেছেন। তবে একথাও খেয়াল রাখতে হবে যে নাটক ইতিহাস নয়। ইতিহাসকে নাটকে পরিণত করতে যা কিছু আবশ্যক গিরিশচন্দ্র নিঃশঙ্ক চিত্তে সেসব গ্রহণ করেছেন। সাধারণ দর্শক এই নাটকের উচ্চরস গ্রহণ করতে না পারলেও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় এই নাটকটিকে বিএ, এমএ পরীক্ষার পাঠ্যপুস্তক রুপে নির্বাচন করে এর যথাযোগ্য স্থান নির্দেশ করে দিয়েছেন।

এই নাটকে ব্যবহৃত একটি গান সম্পর্কে গিরিশচন্দ্রের উচ্চ মার্গের দৃষ্টিটি ফুটে ওঠে:
“ক্রোধানল কেন হৃদয়ে জ্বালি
পরশ রতন দিব শান্তি ডালি
চিরশান্তি-শান্তি-শান্তি!
যত্ন করি ধরি হৃদয়ে অহি
কেন দংশন তাড়ন নিয়ত সহি
একি ভ্রান্তি-ভ্রান্তি-ভ্রান্তি!”
আরও পড়ুন:

নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের সন্ধানে, পর্ব-৫৯: চৈতন্যলীলার মতো শংকরাচার্য নাটকও যুগান্তর সৃষ্টি করেছিল

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯১: এক আলমারি বই : রাণুর বিয়েতে কবির উপহার

মিনার্ভা থিয়েটারে ‘অশোক’ নাটকটি প্রথম অভিনীত হয়েছিল ১৯১০ সালের ৩ ডিসেম্বর। প্রথম রজনীতে যাঁরা অভিনয় করেছিলেন তাঁরা হলেন; সুরেন্দ্রনাথ ঘোষ দানি বাবু (অশোক), অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় (বীতশোক), সুশীলাবালা (কুণাল), তারকনাথ পালিত (আকাল), ধর্মদাস মুখোপাধ্যায় (তক্ষশীলার দূত), মন্মনাথ বসু (পাটলিপুত্রের দূত), তারাসুন্দরী (পদ্মাবতী), ফিরোজা পালা (সংঘমিত্রা), তিনকড়ি দেবী (তৃষা), রাধারানী (চণ্ডাল পত্নী)।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫১: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—পশুর, ধুধুল ও হাবল

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪৯: রসিক স্বভাব মা সারদা

অভিনয় শিক্ষক হিসেবে এই নাটক যুক্ত ছিলেন হরিভূষণভট্টাচার্য এবং মহেন্দ্র কুমার মিত্র। সংগীত শিক্ষক ছিলেন দেবকণ্ঠ বাগচী। নৃত্য শিক্ষক ছিলেন সাতকড়ি গঙ্গোপাধ্যায়। মেকআপের দায়িত্বে ছিলেন কালীচরণ দাস। অশোকের ভূমিকা স্বয়ং দানীবাবু গ্রহণ করেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে অশোক চরিত্রটি দুটি ভাগে বিভক্ত। প্রথমে চণ্ডাশোক নিষ্ঠুর নির্দয় নির্মম দুরন্ত। রাজ্য লিপ্সায় তাঁর হৃদয় অধিকৃত সেখানে দাম্পত্য প্রেমের কোন স্থান নেই। তারপরে ধর্মাশোক। ত্যাগের মহিমায় মহান। আত্মজয়ের গৌরবে পরিপূর্ণ। চণ্ডাশোকের উদ্দেশ্য পরপীড়ন প্রভুত্ব স্থাপন। ধর্মাশোকের উদ্দেশ্য বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪৬: রাজার নিয়ন্ত্রণহীন অনুচরেদের কুকর্মের দায় রাজাকেই নিতে হয়

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৩: এক্সপায়ারি ডেটের ওষুধ খাবেন?

দানীবাবু এই দু’রকম ভূমিকাতেই যথেষ্ট কৃতিত্ব ও কলা কৌশল প্রদর্শন করেছিলেন। তবে অশোকের চরিত্রের থেকেও বীতশোকের চরিত্র দর্শকদের অধিকতর মর্মস্পর্শী লেগেছিল। সুপ্রসিদ্ধ নট ও নাট্যকার অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এর অভিনয়ে বিশেষ নৈপুণ্য দেখিয়েছেন। আকালের চরিত্রে তারকনাথ পালিতও যথেষ্ট সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন।—চলবে।
* নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের সন্ধানে (Girish Chandra Ghosh–Actor –Theatre) : ড. শঙ্কর ঘোষ (Shankar Ghosh) বিশিষ্ট অধ্যাপক ও অভিনেতা।

Skip to content