‘শাস্তি কি শান্তি’র অভিনয়ে অর্থাগম সম্বন্ধে আশানুরূপ ফল গিরিশচন্দ্র পাননি। তখন আবার নতুন নাটক লেখার প্রয়োজন হল। কিন্তু কি লেখা যায়? এটি তো একটা বড় সমস্যা যে কোনও নাট্যকারের পক্ষে। ঐতিহাসিক নাটক লিখতে গেলে পুলিশ অনুমোদন করবে কিনা সেখানে অনেক বাধা রয়েছে। তবে ধর্মপ্রাণ ভারতে ধর্ম কখনওই অনাদৃত হবে না। এখানেও একটা অন্তরায় রয়েছে। বাংলা ভক্তি প্রধান দেশ ও ভক্তিমূলক নাটক এখানে অনেক রচিত হয়েছে। এই বিষয়ের পুনরাবর্তন অনেকের ভালো নাও লাগতে পারে। গিরিশচন্দ্র ভাবতে লাগলেন একবার জ্ঞানমার্গ ধরে নাটক লিখলে কেমন হয়? কিন্তু বিষয় বড় নীরস। যে উন্মাদনা নাটকের প্রয়োজন তা ভক্তিতে আছে, অদ্বৈত মার্গে তো নেই। তবু বেদান্ত বিষয়ে অবলম্বন করে অদ্ভুত কৌশলে তাতে মানবীয় সহানুভূতি মিশিয়ে গিরিশচন্দ্র শংকরাচার্যের জীবন নিয়ে নাটক লিখতে ব্রতী হলেন। নাটক যখন সমাপ্ত হয়েছে লেখা, তখন এর সাফল্য সম্বন্ধে গিরিশচন্দ্রের মনে প্রথমে অত্যন্ত সন্দেহ হয়েছিল। কিন্তু স্বামী সারদানন্দের কথায় তাঁর সেই দ্বিধা দূর হল।
নাটকের সম্পূর্ণ শিক্ষাদান তিনি করতে পারেননি। কারণ তাঁর শরীর খারাপ থাকার জন্য তিনি কাশীধামে ছিলেন। রাধামাধব কর এবং হরি ভূষণ ভট্টাচার্য শিল্পীদের অভিনয় শিক্ষা দিলেন। শুধু দানী বাবু অর্থাৎ গিরিশ বাবুর ছেলে কাশীধামে গিয়ে শঙ্করাচার্যের ভূমিকা বাবার কাছ থেকে শিক্ষা করে এসেছিলেন।
আরও পড়ুন:
পর্ব-৫৮: মিনার্ভার জন্য গিরিশচন্দ্র লিখেছিলেন সামাজিক নাটক ‘শাস্তি কি শান্তি’
জিৎ সত্রাগ্নি’র গল্পে এবার জিৎ-রুক্মিণীর ছবি ‘বুমেরাং’
মিনার্ভা থিয়েটারে ‘শংকরাচার্য’ নাটকের প্রথম অভিনয় হয় ১৯১০ সালের ১৫ জানুয়ারি। এতে অভিনয় করলেন সুরেন্দ্রনাথ ঘোষ দানীবাবু (শঙ্করাচার্য), সতীশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (মহাদেব), হীরালাল চট্টোপাধ্যায় (ব্রহ্মা), নৃপেন্দ্রনাথ বসু (জগন্নাথ), সাতকড়ি গঙ্গোপাধ্যায় (শিউলি), রাজবালা (মহামায়া), সরযুবালা (গঙ্গা), নিরদাসুন্দরী (সরমা), সুহাসিনী (কুমারী), তিনকড়িদাসী (শিউলিনি)।
আরও পড়ুন:
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৩: বাবু ডাক্তার ও ‘ডাক্তারবাবু’
ভোটস্য পরিবেদনা
এই নাটকের সংগীত শিক্ষক ছিলেন দেবকণ্ঠ বাগচি। নৃত্য শিক্ষক ছিলেন নৃপেন্দ্রচন্দ্র বসু। আর মেকাপের দায়িত্বে ছিলেন ধর্মদাস সুর ও কালীচরণ দাস। রিহার্সাল যখন চলছে শঙ্করাচার্য নাটকের তখন শিল্পীরা একপ্রকার হতাশ হয়ে পড়েছিলেন এবং বিপুল অর্থ ব্যয় সাজসরঞ্জাম ও ধর্মদাস বাবুকে দিয়ে দৃশ্যপটাদি প্রস্তুত করতে স্বত্বাধিকারী বিশেষভাবে চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু নাটক যখন মঞ্চস্থ হতে শুরু করল এবং জনাকীর্ণ মঞ্চে যখন এ নাটক অত্যন্ত অভিনন্দন পেতে শুরু করল, জয়ধ্বনি হল, তখন সকল দুঃখ দূর হল। তাতে বিশ্বাস ও আনন্দের সীমা রইল না।
আরও পড়ুন:
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৯: বাইনাচ-গানেরও কদর ছিল ঠাকুরবাড়িতে
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২৩: তরু দত্ত— এক আনন্দ বিষাদের তরুলতা
চৈতন্যলীলার মতো শংকরাচার্য নাটকও নাট্যজগতে যুগান্তর সৃষ্টি করেছিল। বেদান্ত প্রচারক নীরস শঙ্কর চরিত্র গিরিশচন্দ্রের অমৃতময়ী রচনায় এমন সরস হয়ে উঠেছিল যে এই বঙ্গের আবালবৃদ্ধবনিতা শংকরাচার্য নাটক দেখবার জন্য উন্মত্ত হয়ে উঠেছিলেন। নাটকের সব চরিত্রই নতুন ছাঁচে ঢালা। তার মধ্যে মহামায়া ও জগন্নাথের চরিত্র বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। জগন্নাথ চরিত্র সম্বন্ধে স্বামী ব্রহ্মানন্দ গিরিশচন্দ্রকে বলেছিলেন “মায়িক ভালোবাসায় যে মুক্তির অধিকারী হইতে পারে এ চরিত্র, গিরিশ বাবু, তুমি মহাগুরুর কৃপায় চিত্রিত করেছ।”
শংকরাচার্যের অভিনয় দর্শন করার পর প্রখ্যাত সমালোচক বিহারীলাল সরকার বঙ্গবাসী পত্রিকায় লিখলেন, “যিনি জ্ঞানযোগী শংকরাচার্যের চরিত্রাবলম্বনে নাট্য রচনা করিতে পারেন, আর সেই নাট্য রচনার অভিনয়ে যিনি বঙ্গের লক্ষ লক্ষ লোককে মুগ্ধোন্মক্ত করিয়া তুলিতে পারেন, ধন্য তাঁহার লেখনী।”
নাটকটি গিরিশচন্দ্র উৎসর্গ করেছিলেন তাঁর যৌবনের বন্ধু এবং একসময় ডিকেন্সন কোম্পানির সর্বময়কর্তা স্বর্গীয় কালিদাস ঘোষকে—”আনন্দময় সহচর আনন্দধামবাসি কালীপদ ঘোষ। ভাই আমরা উভয়ে একত্রে বহুবার শ্রীদক্ষিণেশ্বরে মূর্তিমান বেদান্ত দর্শন করেছি। তুমি এখন আনন্দধামে। কিন্তু আমার আক্ষেপ তুমি নরদেহে আমার শংকরাচার্য দেখলে না। আমার এ পুস্তক তোমায় উৎসর্গ করলেম, তুমি গ্রহণ করো। গিরিশ”।
কাশীধাম থেকে ফিরে এসে গিরিশচন্দ্র কয়েক রাত্রি শিউলির চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। এর ফলে নতুন আকর্ষণ হওয়ায় শংকরাচার্যের বিক্রয় যেন আরও আরও বেড়ে গিয়েছিল।—চলবে।
নাটকটি গিরিশচন্দ্র উৎসর্গ করেছিলেন তাঁর যৌবনের বন্ধু এবং একসময় ডিকেন্সন কোম্পানির সর্বময়কর্তা স্বর্গীয় কালিদাস ঘোষকে—”আনন্দময় সহচর আনন্দধামবাসি কালীপদ ঘোষ। ভাই আমরা উভয়ে একত্রে বহুবার শ্রীদক্ষিণেশ্বরে মূর্তিমান বেদান্ত দর্শন করেছি। তুমি এখন আনন্দধামে। কিন্তু আমার আক্ষেপ তুমি নরদেহে আমার শংকরাচার্য দেখলে না। আমার এ পুস্তক তোমায় উৎসর্গ করলেম, তুমি গ্রহণ করো। গিরিশ”।
কাশীধাম থেকে ফিরে এসে গিরিশচন্দ্র কয়েক রাত্রি শিউলির চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। এর ফলে নতুন আকর্ষণ হওয়ায় শংকরাচার্যের বিক্রয় যেন আরও আরও বেড়ে গিয়েছিল।—চলবে।
* নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের সন্ধানে (Girish Chandra Ghosh–Actor –Theatre) : ড. শঙ্কর ঘোষ (Shankar Ghosh) বিশিষ্ট অধ্যাপক ও অভিনেতা।