শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

বিশ্বায়নের যুগ এখন। ভারতে একটি অফবিট চলচ্চিত্র ‘ভিকি ডোনার’ মুক্তি পাওয়ার পর, সমগ্র ভারতে ‘স্পার্ম ব্যাংক’ শব্দটি জন-মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। আলোড়ন সৃষ্টি হয় অন্য কারণে, মানুষ ভাবতে থাকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কি ভেঙ্গে পড়বে? সাধারণ পণ্যের মতো সুস্থ বলিষ্ঠ পুরুষ কি বিক্রি হবে? শুক্রাণু বিক্রি বহুদিন ধরে বিদেশে আইনসিদ্ধ, সামাজিক স্বীকৃতি ও বহুল জনপ্রিয়।

মানব শিশুর জন্মের শুরুর কথা বলি। একজন পুরুষ উৎপন্ন করে শুক্রাণু ও একজন নারী উৎপন্ন করে ডিম্বাণু। প্রজননে শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর মিলন ঘটে, তৈরি হয় জাইগোট, মানব শিশুর প্রথম কোষ, যা ক্রমে বিভাজনের মধ্য দিয়ে জন্ম নেয় এক পূর্ণাঙ্গ মানবশিশু। সেই শিশু বড় হয় মাতৃগর্ভে, জন্ম হয়, জন্মের পর বড় হয় মাতৃদুগ্ধ পান করে। মানে একজন শিশুর জন্য একজন পুরুষের দান শুধু একটি শুক্রাণু। আসলে মানুষের জীবনে তার মায়ের অবদান সর্বাপেক্ষা বেশি ও গুরুত্বপূর্ণ।
আজকের সমাজে জন্ম নিল একদল ‘ভিকি ডোনার’। টাকা, সোনা জমানোর মতো স্পার্ম জমানোর ব্যাংক, তৈরি হল ‘স্পার্ম ব্যাংক’। আমরা জানি গুজরাতে অনেক আগেই জন্ম নিয়েছিল ব্রেস্ট মিল্ক জমানোর ‘মিল্ক ব্যাংক’। আর ব্যাঙ্ক অভিধানে সদ্য জন্ম নিল ‘স্পার্ম ব্যাংক’। সুস্থ, সবল যুবকরা মানবকল্যাণে হোক অথবা পকেটমানির জন্যই হোক ব্যাঙ্ক গুলিতে দান করতে লাগলেন স্পার্ম। আর প্রয়োজন মতো সেই স্পার্ম কিনতে লাগলেন সন্তানকামী মহিলারা। যাঁদের স্বামীর সিমেন-এ মোট স্পার্ম সংখ্যা কম থাকে, তাঁদের সন্তান লাভের ইচ্ছা থাকলেও গর্ভে সন্তানের জন্ম হয় না, অথবা ‘সিঙ্গেল মাদার’রা স্পার্ম ব্যাংকের মুখাপেক্ষী হন। বর্তমানে বেশ কিছু শহরে স্পার্ম ব্যাংক গড়ে উঠেছে, কলকাতাতেও গড়ে উঠেছে এই প্রকার ব্যাংক।
আরও পড়ুন:

ইকিগাই কেবল থেরাপি নয়, এক জীবনদর্শনও

এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-৩: ত্রিপুরা সমৃদ্ধিতে রাজা বিজয় মাণিক্যের ভূমিকা অপরিসীম

এখন প্রশ্ন হচ্ছে কারা স্পার্ম দান করেন, তাদের কি ঠিকমতো ডাক্তারি পরীক্ষা হয়? সাধারণত যেকোন সুস্থ-সবল পুরুষ স্পার্ম দান করতে পারেন। তবে এই ধরনের ক্লিনিকগুলোর পছন্দ স্কুল-কলেজের যে কোনও যুবক, তবে তাদের হতে হবে রোগমুক্ত, বিশেষ করে যৌন রোগ। এই সংগ্রহীকৃত স্পার্ম সংরক্ষণ করা হয়, তরল নাইট্রোজেনে। এই পদ্ধতিতে পাঁচ থেকে সাত বছর পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখা হয় স্পার্মগুলিকে। স্পার্মের চলন ও গমন সংক্রান্ত সক্রিয়তা দেখার জন্য স্পার্ম মবিলিটি টেস্ট করা হয়ে থাকে। স্পার্ম সংগ্রহের পূর্বে ডোনারের থ্যালাসেমিয়া, এডস, হেপাটাইটিস ও তার সঙ্গে পূর্বে উল্লেখিত যৌন রোগেরও পরীক্ষা করা হয়। যদি ডোনারের কোনও অসুখ না থাকে, তবেই তার স্পার্ম সংগ্রহ করা হয়।

বিষয়টিকে জটিল তা নিয়ে কোনও প্রশ্ন নেই। যে মহিলা স্পার্ম গ্রহণ করবেন, সেই মহিলার শরীর সংক্রান্ত বিভিন্ন পরীক্ষা করা হয়। তারপর কৃত্রিম ইন্সেমিনেশন বা ইনভিট্রো ফার্টিলাইজেশন পদ্ধতিতে শুক্রাণুকে ফ্যালোপিয়ান টিউবের মধ্যে প্রবেশ করানো হয়, এবং প্রজনন প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করা হয়। তার পরেই তারা স্বাভাবিক নারীদের মতোই গর্ভধারণ করেন ও সন্তান প্রসব করেন।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১৬: কল্যাণী—অন্দরমহলের সরস্বতী

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৫০: অর্ধশতাব্দী ছুঁলো ‘অমানুষ’

আজকের সময় স্পার্ম ব্যাঙ্ক কতটা উপযোগী তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে! সমাজ বিষয়টিকে কতটা গ্রহণ করবে, তা নিয়েও তৈরি হয়েছে সংশয়। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ এবং তার মানসিকতার পরিবর্তন ঘটেছে। প্রথাগত নিয়মের বেড়াজালে বাধা পড়তে নারাজ অনেক আধুনিক মানবীরা। সিঙ্গেল মাদার হিসাবে তারা থাকতে চাইছে। এছাড়াও অর্থ সম্পন্ন ধনী ব্যক্তি, অথবা যে কোন সাধারণ মানুষ যাদের সন্তান লাভের ইচ্ছা আছে কিন্তু পুরুষত্বহীনতার জন্য তারা সন্তান লাভ করতে সক্ষম হচ্ছেন না, তাদের ক্ষেত্রে যে স্পার্ম ব্যাংক-এর ভূমিকা অবিস্মরণীয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আরও পড়ুন:

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৩৫: ঘুম ঘুম চাঁদ ঝিকিমিকি তারা

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩৮: অভিভাবিকা মা সারদা

সমগ্র ভারত জুড়ে অসংখ্য সরকারি, বেসরকারি ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা পরিচালিত অসংখ্য অনাথ হোম আছে, সেখানে মানুষ হচ্ছে লক্ষাধিক অনাথ শিশু। একটা সময় এই অনাথ শিশুদের সামাজিক স্বীকৃতি দিত এইসব সন্তানহীন দম্পতিরা। প্রায় সকল অনাথ শিশুই খুঁজে পেত তাদের নতুন পিতা-মাতাকে। ভারতে নানান সরকারি নিয়মকানুনও আছে এই অনাথ শিশুদের দত্তক নেবার জন্য। তাতে রয়েছে কিছুটা হলেও আইনি জটিলতা। আধুনিক এবং আধুনিকারা সেই সমস্যার মধ্যে যেতে চাইছেন না। তারা শরণাপন্ন হচ্ছে শহরের বড় বড় ক্লিনিকগুলোতে, যেগুলির সাথে সংযুক্ত আছে স্পার্ম ব্যাংক। এগুলির আইনি জটিলতা যেমন নেই, তার সাথে নারী অনুভব করছে তার নাড়ির টান ও তার একাত্মতা। ফলে জনপ্রিয়তা বাড়ছে এই নতুন ব্যাঙ্কগুলির।
আজ আমরা তাই এক বিশেষ অদ্ভুত পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছি। আমাদের সমাজে স্পার্ম ব্যাংক, না অনাথ শিশুদের পুনর্বাসন কোনটা বেশি জরুরি? এটি লাখ টাকার প্রশ্ন। যার উত্তর খুঁজতে দিশাহারা সমগ্র মানবজাতি।

বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে মানবপ্রজন্মের উন্নয়নকে আমরা অবশ্যই গ্রহণ করব কিন্তু তাতে সমাজের কোনো ক্ষতি না হয়, তাও দেখা দরকার। উভয় ব্যবস্থারই প্রয়োজন আছে। সম্পূর্ণরূপে কোন একটি ব্যবস্থার উন্নতি করতে গিয়ে, অন্য ব্যবস্থাকে নষ্ট করা উচিত নয়। তাহলে ভারতের লক্ষ লক্ষ অনাথ শিশুরা আরও অনাথ হয়ে পড়বে। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচ্যে।
* ড. উৎপল অধিকারী, সহ-শিক্ষক, আঝাপুর হাই স্কুল, আঝাপুর, জামালপুর, পূর্ব বর্ধমান।

Skip to content