অলঙ্করণ: লেখক।
ফরাসি বিপ্লবের কথা মনে পড়ে? চোদ্দই জুলাই তারিখে বাস্তিল দুর্গের পতন, তারপর ইতিহাস বইয়ের সাদা-কালোয় এগিয়ে চলা কার্যকারণের খতিয়ান। জুলাই মাসের স্মরণীয় দিন, সতেরোশো ঊননব্বই সালের ঘটনা। বিপ্লব পৃথিবীতে বারবার আসে যায়। এই যেমন শিল্প বিপ্লব থেকে সবুজ বিপ্লব। পৃথিবীতে যেদিন প্রথম আগুন জ্বলে উঠেছিল কিংবা চাকা গড়িয়েছিল, স্বাধীনতা এসেছিল দেশে, মনে, মননে অথবা শরীরে, অথবা একটা রেনেসাঁস, নবজাগরণ সবই তো বৈপ্লবিক।
হালের ধরণী প্রযুক্তির বলে দ্বিধান্বিতা। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে দ্বৈত নাগরিত্বের তত্ত্ব জানা যায়। প্রযুক্তির পৃথিবীতেও দ্বৈত নাগরিকত্ব আছে। মাটির পৃথিবীর নাগরিকরা হাসে, কাঁদে, রাগে, বিদ্রূপ করে বা ঝগড়া করে পুরনো নিয়মে। যাঁরা মাটির পৃথিবীর পাশাপাশি নেট-নগরেও থাকেন, তাঁরা এখানে হাসেন কাঁদেন অন্য নিয়মে। লালন বাড়ির পাশেই আরশিনগরের কথা জানতেন। এই নেট দুনিয়া বাড়ির মধ্যেই। এ ভাবেই মানুষ বিশ্বপথিক হয়েছে বটে! এও এক বিপ্লব। এখানে ভাইরাল হওয়াটাও বিপ্লবের-ই অংশ বটে।
আরও পড়ুন:
হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৪৪, তারা বলে গেল ক্ষমা করো
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫৫: সঙ্গীত অনুরাগিণী মা সারদা
এই যে হাসিকান্নার হীরপান্না ফুটে ওঠে আন্তর্জালের আন্তর্জাতিক সমাজমাধ্যমে, তা-ও বিপ্লব ছাড়া কী! ইমোজি বা ইমোটিকন যেভাবে যতভাবে হাসতে বলে, কাঁদতে বলে, রাগতে বলে, আবদার করতে বলে ততটা হাসি, কান্না, ক্ষোভ, ক্রোধ বাস্তবেও বুঝতে বা বোঝাতে পারে মানুষ? কিন্তু ভার্চুয়াল জগতে বোঝে, সেই ভাষাতেই গান করে, ইমোজির হাত ধরে। ইমোজিই আজকাল আপনার ইমেজ আর ইমাজিনেশনের প্রতিনিধি। ই-দুনিয়ায় দুনিয়াদারির রাজা। নেটনাগরিকরাও ইমোজিতেই মজেছেন।
আরও পড়ুন:
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩১: হেমন্তবালা দেবী— রবি ঠাকুরের পত্রমিতা
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৭: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—বন লেবু ও টাগরি বানি
যাকে কোনওদিন হাসতে দেখেনি কেউ, সে ভার্চুয়ালি হাসে, যাকে নাচতে বললেও নাচে না সেও ভার্চুয়ালি…আসলে, ইমোজি আছে যে! লাইক, ডিসলাইক, অ্যাঙ্গার, কেয়ার পার হয়ে ইমোজির সংসারে মুখমণ্ডল থেকে পূর্ণাবয়ব শরীরের নানা মুদ্রার শোভা থরে থরে সাজানো, আপনি যা হতে চান তা-ই হতে পারেন, যা বলতে চান বা চান না, তা-ও অনায়াসে বলে দিতে পারেন। অনুভূতির নানা স্তরের নানা ছবি এখানে সাজানো, দেখলে মনে হতে পারে, এই তো, এটাই তো চাইছি!
আরও পড়ুন:
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৬: স্রোতস্বিনী পদ্মায় লাফিয়ে কবির কটকি চটি-উদ্ধার
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৭: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—বন লেবু ও টাগরি বানি
আহ্লাদে গদগদ থেকে আটখানা হতে বাধা নেই এখানে, সুখের সাগরে ভেসে যাওয়ার অনুভূতির চিত্ররূপ এখানে আপনারই অপেক্ষায়, দুঃখের দাবানলে পুড়ে যাওয়ার ভাবরূপের হাত ধরেই। আপনি বেছে নিন আপনি কী চাইছেন। কলম, পাখি, গাছ, মাছ, আলো, হাতি, বাড়ি, গাড়ি, কাঁচকলা সব আছে এখানে, স-অ-ব। ইমোজি যাবতীয় প্রতীক আর প্রতিকার নিয়ে হাসছে, কাঁদছে অথবা মোনালিসার মতোই রহস্যঘন হয়ে আছে। আপনি ভাবছেন যেমনটা, পাশের জনই তাকে অন্যরকম ভাবছে।
আরও পড়ুন:
গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-২: অসীম রোদন জগৎ প্লাবিয়া দুলিছে যেন?
বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-১৩: অদ্বিতীয় সম্রাট
তবুও তা আপনার মনের ভাষায় আপনার একান্ত আপন হয়ে উঠতে বাধা কোথায়! এভাবেই একটা পাঁজরের পাশেই একটা সেফটিপিন দিব্যি বসে থাকে। একটা মুখবন্ধ খামে হৃদয় পোরা থাকে, মাথায় পরমাণু বিস্ফোরণ ঘটে ভাবের-অভাবের, বেজার মুখের পাশেই মুখে কুলুপ আঁটা আপনি-আমি, বেড়াল তপস্বীর পাশেই চোখে চোখে কথা বলার হাতছানি, চোখের জলের সমুদ্দুরের পাশেই নানা রঙের ভালোবাসায় চোখে আগুন লাগে, লাগে ঘূর্ণিপাক, আমি আছি স্যার কিংবা জিভকাটা চোখ বোজা লজ্জা, ফাঁকা আওয়াজ থেকে ইউ টার্ণের নানা মেজাজ, নানা মর্জি আপনার তর্জনীর স্পর্শে বাস্তব হবে ভার্চুয়ালি, ভ্রূপল্লবে ডাক দেবে চন্দনের বনে, গলে গলে পড়বে রাগ, অভিমান, অনুরাগ, শক্ত হবে প্রতিজ্ঞা, ভীষণ হবে প্রতিবাদ; এভাবেই গড়ে উঠবে, উঠছে আমার-আপনার প্রতিবাদের, প্রতিরোধের, অপমানের, আবেগের, মৌনতার এক সমান্তরাল ভাষ্য, ভাষা… ইমোজির মধ্য দিয়ে। সতেরোই জুলাই, বিশ্ব ইমোজি দিবস ভাবের ঘরে আরেকটা বিপ্লব এনেছে।
* হুঁকোমুখোর চিত্রকলা : লেখক: ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।