বুধবার ৪ ডিসেম্বর, ২০২৪


স্বামী বিবেকানন্দ ছবিতে মহাগুরু।

১৯৭৬-এ মৃগয়ার উত্থানের পর দো আঞ্জানে, মেরা রক্ষক পেরিয়ে তারানা, ডিস্কো ড্যান্সার, মুঝে ইনসাফ চাহিয়ে, কসম পয়দা করনে…, প্যার ঝুঁকতা নেহি, গুলামী, ড্যান্স ড্যান্স, প্যার কা মন্দির, ওয়ক্ত কি আওয়াজ, কম্যান্ডো অনেক হিট সুপারহিট ছবি তখন হয়ে গিয়েছে। একটা দুটো কথা হল! সারাদিন শুটিং করছেন সন্ধেবেলা আরও দুটো ছবির শুটিং বাকি। এর মধ্যেই ফ্লোরে ডাক এল।

তিনি চলেছেন। পিছনে অনেকের সঙ্গে আমিও। যাবার সময় দেখেছিলাম অনেক ছবির শুটিং চলছে। এখন দেখলাম সব শুটিং থমকে সেই বঙ্গসন্তানের যাবার পথ করে দিচ্ছেন তাঁরা। এবং হাতজোড় করে, কারও-বা কাঁধে হাত রেখে তিনি সেই সব কলাকুশলী অভিনেতাদের কৃতজ্ঞতা জানাতে জানাতে চলেছেন নিজের শুটিং জোনে।

শুটিং জোনে গিয়ে চক্ষু সার্থক হল। শোলে ছবির স্রষ্টা রমেশ সিপ্পি পরিচালক। ক্যামেরায় কে কে মহাজন। বুনিয়াদ এবং মৃণাল সেন এবং বাসু চট্টোপাধ্যায়ের অধিকাংশ ছবির ক্যামেরাম্যান। এই ছবির নাম ভ্রষ্টাচার। কৃত্রিম বৃষ্টি হচ্ছে। বাজের আলো ঝলসাচ্ছে। সেই দুর্যোগে কুচক্রী খলনায়ক, নায়িকা এবং তাঁর পরিবারকে আইনি নোটিস দিয়ে বাড়িছাড়া করছে। নায়ক গিয়ে তাদের আশ্রয় দিলেন। পরিচিতদের মধ্যে সে দৃশ্যে অভিনয় করেছিলেন বুনিয়াদ খ্যাত অভিনব চতুর্বেদী, রাজা মুরাদ, মিঠুন চক্রবর্তী, রেখা এবং আরও সহশিল্পীরা।
অনেকগুলি এক্টিভিটির মধ্যে সেই নাটকীয় দৃশ্যের বেশ কয়েকটি চিত্রগ্রহণ হল। ছবির দৃশ্যগ্রহণের শেষে পোশাক বদলে পরের ছবির শুটিং ফিল্মসিটির মধ্যেই একটু দূরে সেই শুটিং জোন। সহ শিল্পী শক্তি কাপুরের সঙ্গে মিঠুন চক্রবর্তীর একটি ফাইট সিকোয়েন্স শুটিং করা হল।

কাজ শেষ হতে আমি আবার সচিবের গাড়িতে গিয়ে বসেছি। আমায় তাজ হোটেলের কাছের একটি হোস্টেলে ফিরতে হবে। হঠাৎ সচিব এসে বললেন—
—দাদা বুলায়া!
অফিসের ব্যাগ রেখেই দেখা করতে যাচ্ছিলাম—
—ব্যাগ লেকে যাও!

আমি এসে জীবনের প্রথম কোনও ক্যারাভ্যানে চড়লাম। একটা লম্বা নিচু ভ্যানের পিছনের অংশটা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বিলাসবহুল লিভিংরুম বানানো হয়েছে। সেখানে বসার বিশ্রামের সব ব্যবস্থা রয়েছে। আজ হাতে মোবাইল থাকায় চটপট প্রামাণ্য ছবি তুলে রাখা যায়। ১৯৮৯-এ সেই সুযোগ ছিল না।
আরও পড়ুন:

ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-৩০: বাংলাতে রাজাদের চিঠিপত্র

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬৭: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— রামবাণ ও পানি তাঙ্কি

গোরেগাঁওয়ের ফিল্মসিটি থেকে অনেকটা রাস্তা। গাড়ি চালু হতে সোফায় বিশ্রাম করতে করতে তিনি আমাকে বললেন—
—ভাই বম্বেতে কি কাজে এসেছিস?
এতো আন্তরিক সে কথার সুর, যেন কত কতকালের পরিচিত। বললাম। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চাইলেন আমি কোথায় কী কাজ করি, কেন বম্বে এসেছি ইত্যাদি। পড়াশোনা কেমিস্ট্রি সংক্রান্ত আমার কাজও তাই। আমি বলছিলাম, তিনিও মন দিয়ে শুনছিলেন। তখন জানতাম না কিন্তু অনেক পরে জেনেছি স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে উনিও কেমিস্ট্রিতেই স্নাতক। তারপর পুণে ইন্সটিটিউট। কথায় কথায় বললেন, প্রথমবার যখন বম্বেতে পা রেখেছিলেন তখন তিনি জানতেনই না বম্বেতে মূল স্টেশনের নাম ভিক্টোরিয়া টারমিনাস। একথা সেকথার পর কি মনে হতে ওঁর বন্ধু বাদলদাকে বললেন—
—মৃণালদার ফোন নম্বরটা জোগাড় কর! কথা বলব!
জিজ্ঞেস করেছিলাম—
—মৃণাল সেন?
—হ্যাঁ! নম্বর আছে তোর কাছে?
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৯: শাসক বেকায়দায় পড়লেই প্রতিপক্ষকে সন্ধির প্রতিশ্রুতি দেয়, যদিও রাজনীতিতে সে সব মানা হয় না

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৬২: সত্যজিৎ রায় রুপটান শিল্পীকে বলেছিলেন, উত্তমকুমারের কোনও মেকআপ করার

সৌভাগ্যক্রমে একটু-আধটু কাজের সুবাদে আমার ডিজিটাল ডায়েরিতে বেশ কয়েকজন বিখ্যাত মানুষের ফোন নম্বর ছিল, বাদলদাকে দিলাম।
মিউজিক সিস্টেমে মৃদুভাবে গান চলছে। হঠাৎ প্রশ্ন—
—ভাই তুই যাবি কোথায়?
বললাম।
—যাবি কি করে?
আমি রোজ ভিটি (এখন সিএসটি-ছত্রপতি শিবাজি টার্মিনাস) থেকে হারবার লাইনে সিউরি স্টেশন থেকে কর্মস্থলে পৌঁছই। অফিস থেকে খার রোড স্টেশনের কাছে ওঁর বাড়ি যেতে দাদর এসে ওয়েস্টার্ন লাইনের ট্রেন ধরতে হতো। ফিরতি পথে খার রোড থেকে ট্রেনে চার্চগেট পৌঁছে সেখান থেকে গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়ার কাছে আমার হোস্টেল। বম্বের লাইফলাইন লোকাল ট্রেনের রুটটা তখন মোটামুটি সড়গড় হয়ে গিয়েছিল। সেদিন আমাদের চলার রুট ওয়েস্টার্ন লাইন জেনেই ফস করে বলে বসলাম—
—বান্দ্রা থেকে ট্রেনে চলে যাবো।
খার রোডের পরের স্টেশন বান্দ্রা। মানে আমার জন্য ওঁকে বাড়ি ছেড়ে আরও খানিকটা এগিয়ে যেতে হবে।
ইন্টারকমে ততক্ষণে উনি ড্রাইভারকে বলেছেন গাড়ি বান্দ্রা স্টেশন দিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য স্পিকারে চালক জানিয়েছেন, ওখানে জ্যাম হবার সম্ভাবনা। আর গাড়িতে উনি আছেন জানলে প্রচুর ভিড় হয়ে যাবে। উনি হিন্দিতে জানিয়ে দিলেন প্রথমবার এসেছে এই ছেলেটি। বম্বে ভালো করে চেনেও না। বান্দ্রা নামলে ওর সুবিধে হয়। ওখান দিয়েই চল।

বান্দ্রাতে তখনও স্কাইওয়াক হয়নি। রাস্তা থেকে একটা ওভারব্রিজে ওঠার লম্বা সিঁড়ি ছিল। আমাকে নামিয়ে উনি বললেন—
—রাস্তা ক্রস করে উল্টোদিকে ওই সিঁড়ি দিয়ে উঠে যাবি!
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩

মুভি রিভিউ: মামুটির মাল্টিস্টারার ছবি ‘সিবিআই ৫: দ্য ব্রেন’ গতানুগতিক থ্রিলার

আমি ব্যস্ত রাস্তা এক-দুবারের চেষ্টায় টপকে গিয়ে সিঁড়িতে পা রেখে ফিরে দেখি, রাস্তার উল্টোদিকে সেই রাজকীয় ক্যারাভ্যান তখনও দাঁড়িয়ে পিছনের জানলা একটু নামিয়ে একটা হাত নেড়ে তিনি আমাকে বিদায় জানাচ্ছেন। আমি হাত নাড়লাম গাড়ি চলে গেল। আমি সেই মুহূর্তে একজন সুপারস্টার নয়, দেশের অন্যতম সেরা অভিনেতা নয়, তাঁর মধ্যে একজন বড় মাপের বড় মনের মানুষকে খুঁজে পেয়েছিলাম। কী অসাধারণ অনুভুতি! হস্টেলে ফিরে চিঠিতে বাবাকে জানিয়েছিলাম। তখন একমাত্র পৌঁছনো সংবাদ ছাড়া ঘনঘন এসটিডি করার মতো সুযোগ ছিল না। এরপর কখনও ওঁর সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ হয়নি। আমারও চেষ্টা করা হয়ে ওঠেনি। তাই আমার কৃতজ্ঞতা জানাবারও কোন সুযোগ ঘটেনি। অথচ আরও একবার তাঁকে কৃতজ্ঞতা জানানোর সুযোগ হয়েছিল আমার কলকাতা ফেরার সময়।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৮১: তথাকথিত পরিচয়হীন প্রতিভার মূল্যায়ন কী শুধুই সাফল্যের নিরিখে সম্ভব?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

বম্বে মেলের ওয়েটিং লিস্ট টিকিট দিয়েছিলেন অফিসের অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ডিপার্টমেন্ট। সুনিশ্চিত গাফিলতি কিন্তু তখন অভিজ্ঞতা ছিল না। তাই টু-এসি-র সেই লটারি টিকিট হাতে বিনা বাক্য ব্যয়ে মালপত্র নিয়ে স্টেশনে এসেছিলাম। অনেকগুলো দিন বম্বে কাটিয়ে ভালোও লাগছিল না! কিন্তু লটারি লাগল না। পীযূষদাকে জানিয়েছিলাম, আমার ওয়েটিং লিস্ট টিকিট কনফার্ম হবে কিনা বুঝতে পারছি না। উনি বলেছিলেন, কোনও সমস্যা হলে ফোন করতে। জানালাম ওঁকে। উনি বললেন, ভিক্টোরিয়া টার্মিনাস স্টেশনের আরপিএফ-এর হেডের সঙ্গে গিয়ে দেখা করতে।

মালপত্র ঘাড়ে করে গেলাম।কিন্তু সান্ত্রীরা তো ঢুকতেই দেবেন না অফিসে। তবু কাকুতিমিনতি করে আধিকারিকের সামনে গিয়ে বললাম সমস্যার কথা। মিঠুন চক্রবর্তী আমার পরিচিত শুনে তিনি হাহা করে হাসতে শুরু করলেন। হিন্দিতে মশকরা করে পাশের জনকে বললেন, যত বাঙালি আছে সকলে বলে মিঠুন চক্রবর্তী তার চেনা।

আমি বুঝিয়ে বললাম আমি মিথ্যে কথা বলছি না, আমাকে একটা ফোন করতে দিন। নিতান্ত অনিচ্ছায় ফোন এগিয়ে দিলেন। আবার পীযূষদাকে ফোন করে বললাম উনি আমার কথা বিশ্বাস করছেন না। পীযূষদা ফোন চেয়ে নিয়ে ঠিক কী বলেছিলেন জানতে পারিনি। কিন্তু পরমুহূর্তেই যাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য আমাকে প্রায় হাতে-পায়ে ধরতে হয়েছিল, তিনি নিজে আমাকে নিয়ে বম্বে মেলের প্লাটফর্মের দিকে ছুটে চললেন। আর যাঁরা দরজা টপকে আমাকে অফিসে ঢুকতে দিচ্ছিলেন না, সেই সান্ত্রী দু’জন আমার মালপত্র নিয়ে পিছনে পিছনে ছুটে আসছেন।

(বাঁদিকে) শ্রীরামকৃষ্ণের ভূমিকায় মিঠুন।

ট্রেন ছাড়তে তখন পাঁচ মিনিট মতো বাকি। ওয়ান এসি-র চিফ টিকিট কালেক্টরকে গিয়ে আরপিএফ-এর বড়কর্তা আমাকে দেখিয়ে কিছু বললেন, তিনি অবাক হয়ে আমাকে দেখলেন তারপর মুহূর্তের মধ্যে আমার মালপত্র ওয়ান এসি-তে তুলে দেওয়া হল। আরপিএফ-এর বড়কর্তা বললেন, টু-এসি তে কোনও জায়গা নেই। তবে নাগপুরে জায়গা পাওয়া যাবে। বম্বে থেকে নাগপুর ওয়ান এসি টিকিটের অতিরিক্ত ভাড়া আমাকে দিয়ে দিতে হবে। আমি তখন যেকোনও মূল্যে ট্রেনে উঠতে তৈরি। তাঁকে এবং সান্ত্রী দু’জনকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাতে আরপিএফ-এর বড়কর্তা নিজেই প্রাথমিক ভুল বোঝাবুঝির জন্য দুঃখপ্রকাশ করলেন।

আরপিএফ কর্তা বললেন, তিনি নিজে পীযূষদাকে ফোন করে জানিয়ে দেবেন যে আমাকে ট্রেনে তুলে দিয়ে গিয়েছেন। এসি ওয়ানের চিফ টিকিট কালেক্টর আমার যথেষ্ট খেয়াল রেখেছিলেন। বলেছিলেন, পরদিন নাগপুর পৌঁছেও টু-এসি থেকে এসে আমি ওয়ান-এসির ঝাঁ-চকচকে ওয়াশরুম ব্যবহার করতে পারি। কলকাতা ফিরতে ফিরতে ভেবেছিলাম, সেই সময়ে একজন সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক মানুষের সাফল্য কোথায় গিয়ে পৌঁছলে তাঁর কোনও উপস্থিতি বা সরাসরি অনুরোধ ছাড়াই শুধু পরিচিতির সূত্রে সম্পূর্ণ অচেনা একজন মানুষ এ ভাবে কারও উপকার করতে পারেন। আজ ভারতীয় চিত্রজগতের সর্বোচ্চ সম্মান দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারে ভূষিত মিঠুন চক্রবর্তীর জন্য রইল আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম, আর আমার কাছে গত ৩৫ বছর সযত্নে রাখা এই কৃতজ্ঞতাপূর্ণ স্মৃতিকথা। —শেষ।
* জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। ‘বুমেরাং’ চলচ্চিত্রের কাহিনিকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’। এখন লিখছেন বসুন্ধরা এবং…এর ৩য় খণ্ড।

Skip to content