দ্য লায়ন কিং মিউজিকাল, ১৯৯৪ এর ওয়াল্ট ডিজনির পৃথিবী বিখ্যাত অ্যানিমেশন ছবি দ্য লায়ন কিং-এর অনুপ্রেরণায় ডিজনি থিয়েট্রিক্যাল প্রোডাকশান প্রযোজিত একটি স্টেজ মিউজিক্যাল শো। ১৯৯৭ সালে জুলাই মাসে প্রথম এই সাড়াজাগানো মিউজিক্যাল শো-এর প্রিমিয়ার হয়েছিল আমেরিকার মিনেসোটা প্রদেশের মেনিয়াপলিস অরফিয়াম থিয়েটারে এবং অক্টোবরে নিউইয়র্ক সিটির ম্যানহাটান ব্রডওয়ের নিউ আমস্টারডাম থিয়েটারে অভিনয়ের পর ওই ব্রডওয়ে থিয়েটারপাড়ার মিনস্কফ থিয়েটারে আজও এই শো-এর দশ হাজারেরও বেশি পারফরম্যান্স চলছে। এই শো, এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ মুনাফাকারী ব্রডওয়ে প্রোডাকশন এবংবিশ্বব্যাপী ১১.২০ কোটির বেশি মানুষদ্য লায়ন কিং মিউজিকাল দেখেছেন।
এর ঠিক ২ বছর বাদে ১৯৯৯ সালের অক্টোবর মাসে লন্ডনে থিয়েটারের প্রাণকেন্দ্র ওয়েস্ট-এন্ডে’র লাইসিয়াম থিয়েটারে দ্য লায়ন কিং মিউজিকাল এর সূচনা হয়। এ পর্যন্ত সেখানে সাড়ে ন হাজারেরও বেশি শো হয়ে গিয়েছে। লন্ডনের ওয়েস্ট-এন্ড একেবারেই নিউইয়র্কের ব্রডওয়ের প্রতিরূপ। একসময় পেশাদারী থিয়েটারের স্বর্ণযুগে আমাদের শ্যামবাজার পাড়ায় অলিতেগলিতে যেমন স্টার থিয়েটার, রংমহল, বিশ্বরূপা, রঙ্গনা বা সারকারিনা ছিল ঠিক সেভাবেই লন্ডনের ওয়েস্ট-এন্ড পাড়ায় পরপর সেন্ট মার্টিন থিয়েটার, ডিউক অফ ইয়র্ক থিয়েটার, পিকাডিলি থিয়েটার, লাইসিয়াম থিয়েটার, ফরচুন থিয়েটার, অ্যাম্বাসাডার থিয়েটার-সহ অসংখ্য থিয়েটার হল। রয়েছে ২৩৫৯ আসন বিশিষ্ট সর্ব বৃহৎ লন্ডন কলোসিয়াম আর সাড়ে তিনশো আসনবিশিষ্ট ক্ষুদ্রতম আর্টস থিয়েটার।এই সেন্ট মার্টিন থিয়েটারে আরেক বিশ্বখ্যাত ৭২ বছর ধরে চলতে থাকা আগাথা ক্রিস্টি রচিত রহস্যনাট্য ‘মাউস স্ট্রাপ”-এর ২৯৬৯৭-তম মঞ্চাভিনয় দেখার সুযোগ পেয়েছি, পরবর্তী প্রতিবেদনে সেই অভিজ্ঞতা জানাবো।
আরও পড়ুন:
মুভি রিভিউ: স্ত্রী-২ ছবিতে স্কন্দকাটা দৈত্য আক্রমণ করছে আধুনিক নারীদের
শারদীয়ার গল্প: তখন বিকেল/৩
লন্ডনের এই রাজসিক লাইসিয়াম থিয়েটারে দ্য লায়ন কিং মিউজিক্যাল দেখার বিরল অভিজ্ঞতা হলো।এই মঞ্চগীতিনাট্যের অসাধারণ সঙ্গীত স্রষ্টা এলটন জন গীতিকার টিম রাইস। আড়াই ঘণ্টার এই নয়নাভিরাম মঞ্চবিস্ময়ের নির্দেশিকা জুলি টেমর। প্রায় ৬২ জন অভিনেতা অভিনেত্রী – এবং ব্যাকস্টেজে ১০০ জনেরও বেশী সহকারী নিয়ে এই অমানুষিক কর্মকাণ্ড প্রতিমুহূর্তে নতুন নতুন চমক সৃষ্টি করে।
আরও পড়ুন:
বাংলাকে ধ্রুপদী ভাষার স্বীকৃতি: বাংলা বুকের ভিতরে
পর্দার আড়ালে, পর্ব-৬২: সত্যজিৎ রায় রুপটান শিল্পীকে বলেছিলেন, উত্তমকুমারের কোনও মেকআপ করার
আফ্রিকার বন্যজীবন অবলম্বনে কল্পিত এ গল্প প্রায় সকলেই জানেন সিংহাসনের প্রকৃত উত্তরাধিকারী কিশোর যুবরাজ সিংহশাবককে বঞ্চিত করার জন্য জঙ্গলের রাজা সিংহকে তার কুচক্রী ভাই হায়নাদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে অন্যায়ভাবে হত্যা করে ক্ষমতাদখল করে। প্রাণ বাঁচাতে অপরিণত যুবরাজ দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় এবং নির্বাসনে বেড়ে ওঠার পর তার মাতৃভূমির অন্যায় দখলদারকে চ্যালেঞ্জ জানাতে ফিরে আসে এবং ঠগ প্রবঞ্চকের অত্যাচারী শাসনের হাত থেকে দেশকে উদ্ধার করে রাজত্বের দায়ভার নেয়। গল্পের কিছু অংশে সেক্সপিয়ারের হ্যামলেট-এর প্রভাব রয়েছে।প্রভাব রয়েছে বাইবেলের জোসেফ ও মুসার কাহিনির।
আরও পড়ুন:
বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩
মুভি রিভিউ: মামুটির মাল্টিস্টারার ছবি ‘সিবিআই ৫: দ্য ব্রেন’ গতানুগতিক থ্রিলার
অনবদ্য আলোকমায়া আশ্চর্য কল্পনা ও বাস্তবের মিলনে গড়ে ওঠা রংবেরঙের পোশাক ও সাজসজ্জার বিচিত্র সম্ভার, অবিশ্বাস্য সেট ডিজাইন ও তার সুনিপূণ ব্যবহার, সুবিশাল পাপেটের অটোমেশন এবং অভিনেতা ও নেপথ্য কলাকুশলীর অকল্পনীয় শারীরিক দক্ষতায় সিনেমায় দেখা অবিস্মরণীয় সব দৃশ্য মঞ্চেও প্রাণ পায়। সারা মঞ্চ জুড়ে জিরাফ হাতি চিতা ঘোরাফেরা করে। অসংখ্য অজস্র হায়নার পাল দৌড়ে আসতে থাকে ব্যাকস্টেজ থেকে ফ্রন্টস্টেজে। সারা অডিটোরিয়ামে উড়ে বেড়ায় পাখিরা।
একটি বিশেষ দৃশ্যে একসঙ্গে মঞ্চে ২৬ জন অভিনেতা অভিনেত্রী ছোটোছুটি করে নিমেষের মধ্যে একের পর এক কম্পোজিশন গড়ছেন ভাঙছেন, সে এক অবিশ্বাস্য অনুভূতি। নাট্যপ্রযোজনা ও মঞ্চ ব্যবহারের ক্ষেত্রে ন্যূনতম ধারণা থাকার সুবাদে আমি সেই মুহূর্তে তাদের অকল্পনীয় দক্ষতা থেকে মন সরিয়ে নিয়ে মঞ্চে উপস্থিত অভিনেতাদের সংখ্যা হাতে গুনেছি। মঞ্চের ওপর থেকে পাটাতনে স্লো মোশানে অবতরণের অবিস্মরণীয় দুটি দৃশ্য রয়েছে, যা এককথায় মনের মণিকোঠায় আজীবন আগলে রাখা অনুভূতি।
একটি বিশেষ দৃশ্যে একসঙ্গে মঞ্চে ২৬ জন অভিনেতা অভিনেত্রী ছোটোছুটি করে নিমেষের মধ্যে একের পর এক কম্পোজিশন গড়ছেন ভাঙছেন, সে এক অবিশ্বাস্য অনুভূতি। নাট্যপ্রযোজনা ও মঞ্চ ব্যবহারের ক্ষেত্রে ন্যূনতম ধারণা থাকার সুবাদে আমি সেই মুহূর্তে তাদের অকল্পনীয় দক্ষতা থেকে মন সরিয়ে নিয়ে মঞ্চে উপস্থিত অভিনেতাদের সংখ্যা হাতে গুনেছি। মঞ্চের ওপর থেকে পাটাতনে স্লো মোশানে অবতরণের অবিস্মরণীয় দুটি দৃশ্য রয়েছে, যা এককথায় মনের মণিকোঠায় আজীবন আগলে রাখা অনুভূতি।
আরও পড়ুন:
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৮১: তথাকথিত পরিচয়হীন প্রতিভার মূল্যায়ন কী শুধুই সাফল্যের নিরিখে সম্ভব?
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ
কী করে এসব সম্ভব হয় তার একটা ধারণা হয়েছিল শো-এর অনেকক্ষণ আগে। আশ্চর্যের বিষয় পৃথিবীর দুটি দেশে এই একই মিউজিকাল শো একই সঙ্গে একই প্রযোজনা সংস্থার অধীনে দুটি ভিন্ন দল অভিনয় করে। নিউ ইয়র্ক ব্রডওয়ের মিনস্কফ থিয়েটারে মঙ্গল থেকে শুক্র সন্ধ্যে ৭টা আর শনি রবি দুপুর দুটো ও রাত আটটায় দুটি করে শো। লন্ডনে সোমবার বাদ দিয়ে মঙ্গল থেকে শনি প্রতিদিন সন্ধে সাড়ে সাতটায় লাইসিয়াম থিয়েটারে এই শো থাকে। বুধ শনি ও রবি অতিরিক্ত শো থাকে দুপুরে আড়াইটা থেকে।
কোভেন্ট গার্ডেন টিউবস্টেশনের কাছেই কোভেন্ট গার্ডেন মার্কেট । তার পাশেই লাইসিয়াম থিয়েটার। এক ঢিলে দুই পাখি মারার মতো ১৬৩২খ্রিস্টাব্দে গড়ে ওঠা কোভেন্ট গার্ডেন মার্কেট বেড়ানো এবং পরে দ্য লায়ন কিং দেখার জন্য হাতে বেশ সময় নিয়ে বেরিয়েছিলাম। এই মার্কেটের স্থপতি ইনিগো জোন্স-এর ওপর ইতালিয়ান পিয়াজাস বা বাজারচত্বরের খুব প্রভাব ছিল। সেই আদলেই গড়া কোভেণ্ট গার্ডেন মার্কেট।
থিয়েটার হল ঠিক বাজারের কোন দিকে তা দেখার জন্য একবার গেলাম লাইসিয়াম থিয়েটার চত্বরে তখন সকাল ১১টা-দুপুর আড়াইটের সময় শো। যাবার সময় স্টেজ গেট খোলা ছিল, দেখা যাচ্ছে না তবে দাঁড়িয়ে শুনতে পেলাম সপ্তাহের সাতদিনে নটি শো-য়ে নিয়মিত অভিনয় করা অভিনেতা-অভিনেত্রী এবং পর্দার আড়ালে থাকা কলাকুশলীরা মঞ্চ দাপিয়ে এই শো-এর কঠিন অনুশীলনে ব্যস্ত। নিষ্ঠা নিয়মানুবর্তিতা আর শৃঙ্খলা এই শব্দগুলোর যেন নতুন করে অর্থ বুঝতে পারলাম।
খুব ভালো কিছুকে কী উপায়ে প্রতিদিন একইরকম ভালো করা যায় বা প্রতিনিয়ত আরও ভালোতে উন্নীত করা যায় তারই প্রচেষ্টা করছেন এইপৃথিবীখ্যাত মঞ্চাভিনয়ের দল।
থিয়েটার হল ঠিক বাজারের কোন দিকে তা দেখার জন্য একবার গেলাম লাইসিয়াম থিয়েটার চত্বরে তখন সকাল ১১টা-দুপুর আড়াইটের সময় শো। যাবার সময় স্টেজ গেট খোলা ছিল, দেখা যাচ্ছে না তবে দাঁড়িয়ে শুনতে পেলাম সপ্তাহের সাতদিনে নটি শো-য়ে নিয়মিত অভিনয় করা অভিনেতা-অভিনেত্রী এবং পর্দার আড়ালে থাকা কলাকুশলীরা মঞ্চ দাপিয়ে এই শো-এর কঠিন অনুশীলনে ব্যস্ত। নিষ্ঠা নিয়মানুবর্তিতা আর শৃঙ্খলা এই শব্দগুলোর যেন নতুন করে অর্থ বুঝতে পারলাম।
খুব ভালো কিছুকে কী উপায়ে প্রতিদিন একইরকম ভালো করা যায় বা প্রতিনিয়ত আরও ভালোতে উন্নীত করা যায় তারই প্রচেষ্টা করছেন এইপৃথিবীখ্যাত মঞ্চাভিনয়ের দল।
* জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। ‘বুমেরাং’ চলচ্চিত্রের কাহিনিকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’। এখন লিখছেন বসুন্ধরা এবং…এর ৩য় খণ্ড।