মঙ্গলবার ২৫ মার্চ, ২০২৫


ছবি: প্রতীকী।

তারপর অর্জুন জিজ্ঞাসুচিত্তে পরিপ্রশ্ন করবেন যে তুমি সকল কর্মত্যাগের উপদেশ দিচ্ছো, আবার নিষ্কাম কর্মের অভ্যাস করতে বলছো। হে সখা! এই দুয়ের মধ্যে কোনটি মঙ্গলপ্রদ তা নিশ্চিত রূপে জানতে চাই। কৃষ্ণ বলবেন, সন্ন্যাস ও কর্মযোগ উভয়-ই মঙ্গলপ্রদ। তবে সন্ন্যাসের তুলনায় নিষ্কাম কর্মযোগ মহত্তর।
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা এই প্রতর্কের উত্থাপন করে সাধক কিংবা যোগী, বীর অথবা কর্মী মানুষকে যে কথা জানাবেন তাতে সুবিদিত সমন্বয়, সমুচ্চয়ের ভাব আছে, আছে নির্দিষ্ট অধিকার, অধিকারী ও বিবিধ মার্গের অনুশাসনকে নিবিড় গভীর অধ্যবসায়ে আত্মস্থ করে নবীনতর মার্গদর্শন। ঈশোপনিষদের সুপ্রসিদ্ধ মন্ত্রে বিদ্যা ও অবিদ্যার সমুচ্চয়ে মৃত্যু ও অমৃত যুগপত্ সমাসীন হয়। বিদ্যা কিংবা স্বতন্ত্রচর্চায় যেখানে গভীর থেকে গভীরতর নিরালোকে নিশ্চিত পতন, সেখানে উভয়ের যৌথ অবলম্বনে পুরুষার্থলাভ। উপনিষদ কাকে বিদ্যা বা অবিদ্যা বলবেন, কী বা সেই মৃত্যু, অমৃতের স্বরূপ-ও বা কীদৃশ তা বেদান্তের নিবিড় পর্যালোচনা ও সাধনে প্রতিভাত হয়।
আরও পড়ুন:

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-২০: জ্ঞান ও অজ্ঞান

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১০৬: ভারতীয় পারিবারিক জীবনে স্নেহময় জ্যেষ্ঠর ভূমিকায় রামচন্দ্র কতটা আকর্ষণীয়?

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার ভাববস্তুতে যে সমুচ্চয়ের বার্তা তা কর্ম কিংবা কর্মত্যাগকে, জ্ঞান ও কর্মের ভেদ-কে, গৃহী অথবা সন্ন্যাসীকে কঠোর অনুশাসনে, আভিধানিক আক্ষরিকতায় বুঝতে বলে না। বরং, কর্মী মানুষ কর্মের অনুষ্ঠান করতে করতেই যদি দ্বন্দ্বদ্বেষাদি অতিক্রম করে বীতরাগ হন, যদি কর্মফলের প্রতি একান্ত অনুরাগ ও আকাঙ্ক্ষাকে অতিক্রম করতে পারেন, তবে ওই কর্মী সন্ন্যাসীই। দার্শনিক সূক্ষ্ম তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে একে আকাশকুসুম বলে মনে হতে পারে, তবে আপাতঃ দ্বন্দ্বের ভ্রম অপসৃত হলে এর মূলগত যাথার্থ্য উপলব্ধি করা যায়। চতুর্বর্গের চতুর্থ স্তরে যে মোক্ষের প্রস্তাবনা, তা একান্তই সন্ন্যাসীর, যেখানে সন্ন্যাস হল নিতান্ত বৈরাগ্য, সকল কর্মবাসনার ত্যাগ, জাগতিক আকর্ষণ, বস্তুনিচয় থেকে মুখ ফিরিয়ে ইন্দ্রিয়ের দ্বার রুদ্ধ করে অন্তরের গভীর থেকে গভীরতর লোকে অবগাহন, আত্মানুসন্ধান।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-৫৪: রবীন্দ্রনাথের ‘মুকুট’ ত্রিপুরার ইতিহাসাশ্রিত গল্প

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৯: সে এক স্বপ্নের ‘চাওয়া পাওয়া’

আবার, কর্ম সর্বথা নিষিদ্ধ হলে জগত্ বিপর্যয়ের মুখে পতিত হয়, একথাও অস্বীকার করার উপায় কোথায়? তাহলে, কর্ম স্বীকৃত; কর্মহীন, আসক্তিহীন সন্ন্যাস উপদিষ্ট, কর্মহীনতা নিন্দিত আবার নিষ্কাম কর্মের অভ্যাস নন্দিত।

তবে যে বীর কর্মী কর্মে প্রবৃত্ত হয়েও সেই কর্মের উদযাপনে বিনষ্টির আশঙ্কায় তাকে বিষবত্ ঘৃণা করে সরে আসতে চাইছেন, যিনি কিংকর্তব্যবিমূঢ়, উদ্ভ্রান্ত, তাঁকে গীতা এক সম্ভাবনার আলোকক্ষেত্রে আকৃষ্ট করেন, উদ্বোধিত করেন, সেখানে মহাসঙ্গীতের সুরে সুরে এক বিপুল অনন্তের সিম্ফনি অসম্ভবের ছন্দে বেজে উঠছে বারে বারে। কালাতীত এক কালপুরুষের ধ্রুব জীবনবোধের উত্থান ঘটছে ধীরে ধীরে। কিন্তু কোথাও যেন ছন্দ মিলবে না বলে মনে হবে, তবে তারপর তিনি মেলাবেন তা-ও। অক্লেশে বলে উঠবেন, যারা মাপে মাপে খাপে খাপে মেপে চলে, তাদের নবোদ্গত বুদ্ধির অতীত এই তত্ত্ব। মূঢ় অল্পজ্ঞ সাংখ্যযোগ ও কর্মযোগকে পৃথক্ পৃথক্ পদ্ধতি বলে মনে করেন, কিন্তু প্রকৃত পণ্ডিত বলবেন, উভয়ের যেকোনো একটির সুষ্ঠু অবলম্বন ও আচরণ-ই ফলপ্রদ হয়।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৯২: দুর্গা টুনটুনি

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১০৭: লুকাবো বলি, লুকাবো কোথায়?

ও এখানেই ঘটে সমুচ্চয়। আপাত দ্বিবিধ ও বিপরীত তত্ত্ব এখানে অভিন্ন হয়ে যেন নবীনতর ব্যঞ্জনা লাভ করে। একক যাপনের প্রতিপাদন, স্থিরলক্ষ্য ও দৃঢ়চেতার আত্ম-উন্মোচন, সীমায়িত জাগতিক স্বার্থের পাশেই অসীমের মাঝে আত্মবীক্ষণ, আত্মজাগরণ ও সংবেদনের বিবিধ পরিসরের মাঝেই সন্ন্যাস নামক এক দুরূহ, কৃচ্ছ্রসাধ্য, বৈরাগ্যনির্ভর ও প্রত্যক্ষতঃ আচারপ্রধান বিষয়টি নিষ্কাম কর্মযোগের তত্ত্বে সমতুল, সমফলপ্রদ হয়ে ওঠে। বোঝা যায় আচার বা বাহ্যিক আচরণের তত্ত্বপ্রধান অস্তিত্বের বাইরে দাঁড়িয়ে গীতা সেই সমন্বয়ের কথা বলবেন, যেখানে আন্তরিক আবেদন প্রধান।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৮: সকালবেলাই হাঁটতে হবে?

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৯o: মা সারদার কথায় ‘ঈশ্বর হলেন বালকস্বভাব’

বৈরাগ্য জেগে উঠলে বিশেষ আচার অবলম্বন করে ব্যক্তির জাগতিক অবস্থার পরিবর্তন-ই একমাত্র নয়, বরং তা আড়ম্বর হবে যদি বৈরাগ্যটিই যথার্থ না হয়। আর তা যদি যথার্থ হয়, তবে বৈরাগ্যের উদ্গমমাত্রেই কর্মত্যাগের যে ধারণা তাও সমীচীন নয়, কারণ কর্ম জীবের জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সন্ন্যাসীও কর্মহীন নন, তবে বৈরাগ্য যথার্থ হলে কর্মের অনুষ্ঠানেও তার প্রতিপালন সম্ভব। এখানেই গীতার নিষ্কাম কর্মের তত্ত্বটি সাকার হবে। জীবন এখানে হয়ে উঠবে সাধন। সরে যাবে একদেশদর্শিতার আবরক মেঘপুঞ্জ। গৃহী, সাধক, কর্মী বা বীরমাত্রের-ই অবলম্বনীয় কর্ম তখন নবতর সম্ভাবনায়, অর্থদ্যোতনায় প্রজ্ঞামণ্ডিত হয়ে ওঠে।
* * ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’ -এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন। বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন। ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না। গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content