মা সারদা।
গ্রামবাসীদের সুখ-দুঃখের খবর রাখার সঙ্গে সঙ্গে শ্রীমা স্বদেশ ও বিদেশের খবর নানাস্থান থেকে তাঁর কাছে আসা মানুষজনের কাছে জিজ্ঞাসা করে জানতেন। কখনও বা পত্রিকা পড়িয়ে শুনতেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন তিনি অনেকদিন এইভাবে পত্রিকা পড়িয়ে খবর শুনতেন। নারীদের ও দেশসেবায় ব্রতী তাঁর ভক্তশিষ্য ও ব্রহ্মচারী ছেলেদের নিয়ে পুলিশের লাঞ্ছনার কথা, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করার কথা শুনলে মা সারদা বিচলিত হয়ে পড়তেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় সুরমাদেবী দেশের পরাধীনতার জন্য অত্যাচার, শোষণ, মানুষের দুর্গতি, দুর্ভিক্ষ, বিধবার চোখের জল ইত্যাদি বর্ণনা করে দেশের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে মা সারদার কাছে জানতে চান। শ্রীমা তখন বলেন যে, ঠাকুর যখনই আসেন, তখনই এমন হয়। আরও কত কী হবে, ওদের ধ্বংস হবে আর নিজেদের রাজ্য নিজেদের হবে। পূর্ববঙ্গ থেকে আসা ব্রহ্মচারী ও মঠের সাধুদের নিয়ে পুলিশের বেশি সন্দেহ ছিল। তারা মনে করত যে, স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত কিছু সন্দেহভাজন ছেলেরা পরিচয় গোপন করে জয়রামবাটি ও কোয়ালপাড়ায় আশ্রয় নেয়। কিছুদিন আগেই কাটিহার থেকে জ্ঞান মহারাজ জয়রামবাটি আসায় পুলিশ আরও তৎপর হয়ে ওঠে। আর নিরপরাধ ছেলেদের পুলিশের হাত থেকে বাঁচানোর দায়িত্ব শ্রীমা নিজের কাঁধে তুলে নিতেন। এ জন্য তাঁকেও অযথা ঝামেলা সহ্য করতে হয়েছে।
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫১: জয়রামবাটির যথার্থ রক্ষয়িত্রী
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৩: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—খলসি ও করঞ্জা
চৌকিদার অম্বিকাদাদা সকালবেলা বাড়ি এসে খবর দিয়ে গেল যে দারোগা আসছে বাড়িতে। মা সারদা শুনে অবাক হলেন, বললেন যে তাঁর বাড়ি তো আশ্রম। সেখানে দারোগা-পুলিশ কি চায়! অম্বিকাদাদা সারদা মাকে বলে যে, কাটিহার থেকে শ্রীমার কাছে জ্ঞান মহারাজ যিনি এসেছেন, তিনি নাকি পুলিশের খাতায় ফেরারি আসামী। কাটিহার থেকে পালিয়ে শ্রীমার কাছে লুকিয়ে আছেন। শুনে মা সারদা বলেন যে, জ্ঞান তো ভক্ত ছেলে। তিনি শুনেছেন যে, জ্ঞানের ভাই নাকি স্বদেশী না বিপ্লবী কাজের সঙ্গে যুক্ত। শ্রীমা বললেন, ‘জ্ঞান কাটিহারে ডাক্তার অঘোরনাথ ঘোষের বাড়িতে ম্যালেরিয়া জ্বরে পড়েছিল। আমার অসুখ শুনে ছুটে এসেছে’। অম্বিকা চৌকিদার বলে যে, পুলিশের এখন ‘পাগল কুকুরের’ অবস্থা। তাই জ্ঞানবাবুকেই তাঁর ভাই মনে করে ছুটে আসছে।
আরও পড়ুন:
রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৭১: সাইকেল ও জীবন
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২৮: জ্ঞানদানন্দিনী দেবী—উনিশ শতকের বলিষ্ঠ লেখক এবং সমাজসংস্কারক
সব শুনে মা সারদা শান্ত থাকেন। দারোগা, পুলিশ হলেও তারাও তো মানুষ। তাদের বোঝাতে হবে, কোয়ালপাড়া আশ্রম আর তাঁর ভূমিকা। যাতে কোনওভাবে আশ্রমের শান্তি ভঙ্গ না করে পুলিশদের বোঝানো যায়, আর ছেলেদেরও বাঁচানো যায় তার ব্যবস্থাই করলেন। মা সারদা আরামবাগ থেকে তাঁর শিষ্য উকিল মণীন্দ্রনাথ বসুকে খবর দিয়ে জয়রামবাটিতে নিয়ে এলেন। তাকে সব ঘটনা জানিয়েও রাখলেন। দারোগা যখন এল খোঁজখবর নিতে তখন মণীন্দ্রনাথই তার সঙ্গে কথা বললেন। শেষকালে, শ্রীমা মায়ের মতন অতি সাধারণভাবে দারোগা ও পুলিশদের জন্য জলখাবারের আয়োজন করলেন। সকলকে স্নেহের সঙ্গেই পরিবেশনও করলেন। সাহেব দারোগা আর পুলিশরাও যে শ্রীমার কাছে পর নয়, তারাও সন্তান। শ্রীমাকে দেখে ও তাঁর আচরণে দারোগাও অবাক হয়ে ভাবলেন যে, কার কাছে এসেছে, কার গৃহে তদন্ত করছে তারা। বিনম্র শ্রদ্ধায় অবনত হয়ে শ্রীমার শ্রীচরণে মাথা ঠেকিয়ে সম্পূর্ণ পরিতৃপ্ত হয়ে ফিরে গেলেন তারা।
আরও পড়ুন:
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪৭: মূর্খকে উপদেশ দিলে সেটা তার রাগের কারণ হয়
ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩৫: কী যে করি করি ভেবে মরি মরি
এদিকে মা সারদার নিজের গ্রামের মোড়লস্থানীয় লোকেরা চেষ্টা করে যেত কীভাবে তাঁকে বিপদে ফেলা যায়। একবার জগদ্ধাত্রী পুজোর দিন শ্রীমার সেজভাই বরদাপ্রসাদ যখন সকলকে ভোগ পরিবেশন করছিলেন, আশুতোষ মিত্র তাঁর কপালে হোমের ফোঁটা দেন। খাওয়া শেষ হলে গ্রামের মুখ্য যোগেন্দ্র বিশ্বাস বললেন, ‘উইলসনের হোটেলে খাওয়া হল। আর কি জাতফাত রইল’? এই নিয়ে আন্দোলন চলতে থাকে। স্থির করা হল, শ্রীমাকে এর জন্য তিরিশ টাকা অর্থদণ্ড দিতে হবে। শ্রীমা সেই টাকা দিয়ে দেন। সেই টাকা দিয়ে তারা যাত্রাগান শুনেছিল। মা সারদার কাছে সহজেই টাকা আদায় করতে পারা যায় দেখে তারা ছল করে প্রায় আন্দোলন করত আর শ্রীমা তাদের টাকাপয়সা, গরদের কাপড় প্রভৃতি দিয়ে সন্তুষ্ট রাখতেন।
আরও পড়ুন:
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৩: মৃণালিনীর মৃত্যু হয়েছিল কীসে?
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬৮: আনন্দের নির্বাসন থেকে উত্তরণের উপায়?
একদিন তিনি বলেছিলেন, ‘আমি এসব সহ্য কচ্চি, আমার ছেলেরা করবে না। তিনি যখন কোয়ালপাড়ার জগদম্বা আশ্রমে ছিলেন, সেখানকার সেবকরা ঠাকুরের উৎসব করার ইচ্ছা জানালে তিনি তাদের হাতে পাঁচটি টাকা দেন। সেই উৎসবে কীর্তন, বাদ্য ও প্রসাদের ব্যবস্থা করা হয়েছিল শুনে শ্রীমা বলেছিলেন, ‘আমি থাকতে থাকতে এত জাঁকজমক কেন রে বাপু? আমাকে মত্তে তর দে’। মা সারদা অহেতুক আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠান পছন্দ করতেন না।—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।