সোমবার ৮ জুলাই, ২০২৪


মা সারদা।

মা সারদা বলতেন যে, দেবতার চোখ থেকে জ্যোতি বেরিয়ে নিবেদিত ভোজ্যদ্রব্য চুষে দেখে বা তার সূক্ষ্মাংশ গ্রহণ করে, তাঁর অমৃতস্পর্শে সেই দ্রব্য আবার পরিপূর্ণ হ্য় বলে কমে না। নৈবেদ্য যখন দেবতার প্রসন্নতায় পরিণত হয়, তখনই তা সকলের প্রসাদ হয়ে ওঠে। শ্রীমার কথায়, যেমন সরল বিশ্বাস ও ভক্তির ঐকান্তিকতায় নিবেদিত অন্নাদি ঠাকুর স্থূলভাবেও গ্রহণ করতেন।
স্নেহলতা সেনকে মা সারদা একটি গল্প শুনিয়েছেন, ‘এক ব্রাহ্মণ বাড়ী থেকে বেরনোর সময় নিজের পাগলাটে ছোট ছেলেকে বলেন, “তুই আজ ঠাকুরের পুজো করিস, ভোগ দিস কেমন, পারবি তো?” ছেলেটি বলল যে সে খুব পারবে। পুজো শেষ হলে তার মা থালায় ভোগ বেড়ে ঠাকুরের সামনে রেখে চলে যান। ছেলেটি তখন দরজা বন্ধ করে জোড়হাতে ঠাকুরকে খেতে বলে। অনেকক্ষণ ধরে, খাও ঠাকুর, খাও ঠাকুর, বলা সত্ত্বেও গোপালঠাকুর কিছুতেই খান না দেখে তার রাগ হয়। সে তখন লাঠি হাতে করে বসে বলল, “ঠাকুর, খাবে তো খাও, তা নাহলে এই লাঠি দিয়ে তোমার মাথা ভেঙে দেব”। তখন গোপাল একটি বালকের রূপ ধরে মূর্তি থেকে বেরলেন এবং আসনে বসে খেতে লাগলেন। সমস্ত ভোগ নিঃশেষে ভোজন করে বললেন, “আমি যে খেয়েছি, কাকেও বলিসনি, বললে ভাল হবে না”। একথা বলেই মূর্তির মধ্যে মিলিয়ে গেলেন। দরজা খুলতেই ছেলেটির মা জানতে চাইলেন, “কিরে, ঠাকুরকে খাইয়েছিস?” ছেলে বলল, “হ্যাঁ, এবার আমায় খেতে দাও”। ব্রাহ্মণী দেখলেন যে, ভোগের থালায় কিছুই অবশিষ্ট নেই। তিনি ভাবলেন, পাগল ছেলে ঠাকুরঘরে বসেই ঠাকুরের সব ভোগ খেয়েছে। তিনি মনে মনে ভয় পেলেন আর খানিকবাদে ব্রাহ্মণ ফিরতেই তাকে সব কথা জানালেন। তাই শুনে ব্রাহ্মণ ছেলের কাছে জানতে চাইলেন যে, সে ঠাকুরকে ভোগ খাইয়েছে কিনা। ছেলে বলল, “হ্যাঁ,খুব ভাল করে খাইয়েছি”। ধমক দিয়ে ব্রাহ্মণ বললেন, “ঠাকুরকে খাইয়েছিস, না নিজে খেয়েছিস?” ছেলেটি তখন নিরুপায় হয়ে বলল, “না বাবা, আমি খাইনি, ঠাকুর নিজে খেয়েছেন, কাকেও বলতে মানা করেছেন। মূর্তি খেকে বেরিয়ে খেয়ে আবার মূর্তিতে ঢুকে গেছেন”। একথা বলা মাত্র রক্তবমন করে ছেলেটি মারা গেল। তখন ব্রাহ্মণ ঠাকুরের কাছে পড়ে বলতে লাগলেন, “আমার একমাত্র ছেলেটিকে নিলে ঠাকুর”। তিনি অনেক কান্নাকাটি করলেন কিন্তু কোন ফল হল না। শ্রীমা বলেন যে, ভগবান যখন আসেন, তখন শিশু ও গরীবের ভিতর দিয়েই আসেন’।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫০: ঠাকুরের ছবি শুধু ছবি নয়

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৩: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—খলসি ও করঞ্জা

শ্রীমার নিকট আত্মীয়দের মধ্যে তাঁর বড়ভাজ সুবাসিনী দেবী, সুশীলা, রাধু ও তার স্বামী মন্মথ, ভাইপো ভূদেব ও তার স্ত্রী তাঁর মন্ত্রশিষ্য ছিলেন। সুবাসিনী শ্রীমাকে জানান যে, তিনি যে মন্ত্র দিয়েছেন, সাধনভজন কিছুই না জানায় জপে মন বসে না। শ্রীমা বলেন, ‘তুমি এই যে কাজ কচ্চ, এতেই সাধনভজন করা হচ্ছে, এর চেয়ে আর কি সাধনভজন? ঠাকুরকে জানাও, আমার যেন ভক্তিলাভ হয়’।

সুবাসিনীর কথা থেকে জানা যায় যে, একদিন বিকালে শ্রীমার ঘরের ঝুল ঝেড়ে পরিষ্কার করা হচ্ছিল, তখন পুরোন কাগজপত্রের সঙ্গে পঞ্চাশ-ষাট টাকার একতাড়া নোটও ফেলে দেওয়া হয়। তিনি সেই নোট পেয়ে শ্রীমাকে এনে দেন। মা সারদা তার চিবুক ধরে চুমা খেয়ে বলেন, ‘গৌরদাসী এটি আমাকে দিয়ে গিয়েছিল। গৌরদাসী সেয়ানা আছে কিনা! আমি মন্ত্র দিতে চাই নি, ধরে মন্ত্র দেব নি, গৌরদাসী বললে, “তা হোক মা, একটি তোমার বলতে থাক’।

সুবাসিনী বলেন, ‘মায়ের পরিবারকে কাকেও তো বিশ্বাস নাই, একদিন স্নান কত্তে গিয়েচি, ফিরে এসে দেখি, নলিনী বাক্সের চাবি খুলে দেখচে’। মা সারদা তাঁর নিজের পরিবার ও শ্বশুরবাড়ির সকলের জন্য সর্বদা চিন্তা করতেন। যাঁরা তাঁর সবথেকে বেশি কাছের ও কৃপাধন্য তারাই তাঁকে অনেকসময় উপলব্ধি করতে পারেননি। একবার সুরবালা মাজটে গ্রামে বাপের বাড়িতে যায়। তার বাবা তার কাছ থেকে একশ টাকা ধার নিয়ে কতগুলো রূপোর গয়না বন্ধক দেয়। সুরবালার নিজস্ব গয়নাও অনেক ছিল। সেগুলো একটা বাক্সে নিয়ে সন্ধ্যার সময় সে ফুলুই গ্রামে আসে। এখানে ভানুপিসির ভাসুরপোরা তাকে যত্ন করে রাখে। কিন্তু তাদের যত্ন থেকে পাগলী মামীর সন্দেহ হয় যে, এত যত্ন কেবল তার অলঙ্কারগুলো নেবার জন্য! তখনই সে ‘ওরে বাবারে, আমাকে মারলে রে’ বলে চিৎকার শুরু করে দিল। তার চিৎকার শুনে গ্রামের লোক জড়ো হয়ে তাকে বাপের বাড়ীতে রেখে এল। আর সেইসঙ্গে শ্রীমাকেও খবর পাঠানো হল। সুরবালার বাবা মেয়ের অলঙ্কারগুলো আত্মসাৎ করে পরে অস্বীকার করল।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৭০: পাভেল কোথায়?

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪৯: রসিক স্বভাব মা সারদা

মা সারদা মহা চিন্তায় পড়ে লোক পাঠিয়ে পাগলীর বাবাকে জয়রামবাটিতে নিয়ে এসে অনেক অনুনয় করলেন। এমনকি, পায়ে হাত দিয়ে বললেন, ‘আমাকে আপনি এ বিপদ থেকে উদ্ধার করুন’। কিছুতেই কিছু হল না। শ্রীমা সকল ঘটনা জানিয়ে কলকাতায় চিঠি পাঠালেন। চিঠি পেয়ে মাস্টারমশাই ও ললিত চাটুজ্যে জয়রামবাটি আসেন। ললিতবাবু সঙ্গে করে পুলিশের উপরওয়ালা একজনের চিঠি নিয়ে এসেছিলেন। তিনি পেন্টালুন পরে পালকি চেপে বদনগঞ্জ থানায় পৌঁছতেই তাঁর চেহারা ও পোষাক দেখে থানার দারোগা থেকে সকলেই ভয়ে অস্থির হল। মাস্টারমশাইকে শ্রীমা বিশেষ করে বলে দিয়েছিলেন যে, ব্রাহ্মণের যেন হাতে হাতকড়ি না লাগে। পুলিশ গিয়ে একটু ধমক দিতেই সব অলঙ্কার আদায় হয়ে গেল। আর সেদিন ব্রাহ্মণকে জয়রামবাটিতে এনে ধৃতরাষ্ট্র সাজিয়ে সকলেই আনন্দ করলেন।

এদিকে ব্রাহ্মণের যদি কোন অপমান হয়, এই চিন্তা করতে করতে শ্রীমার শরীর খারাপ হল, সমস্ত রাত ঘুম হল না, মাথা ঘুরতে লাগল। কমলা ঘোষের কথা থেকে জানা যায়, একদিন শ্রীমার বড়ভাজ আর পাগলী মামীর মধ্যে ঝগড়া লাগে। তা দেখে প্রসন্ন শ্রীমার কাছে এসে বলে, ‘দিদি, এর একটা কিনারা করে দাও’। এমন সময় দুই ভাজও সেখানে এসে উপস্থিত হয়। আর সঙ্গে সঙ্গেই পাগলী শ্রীমাকে কুবাক্য বলতে শুরু করে। মা সারদা বলেন, ‘দেখ, যতক্ষণ আমি আছি ততক্ষণ ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর ঘরে বাঁধা; আমিও সরে পড়ব, তোদেরও দুর্দশার শেষ থাকবে নি’।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪৬: রাজার নিয়ন্ত্রণহীন অনুচরেদের কুকর্মের দায় রাজাকেই নিতে হয়

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩৪: পুণ্য আষাঢ়ের প্রথম দিবসে

কলকাতায় খাকার সময় শ্রীমার ভক্ত চন্দ্রমোহন দত্ত একবার শুনতে পান, পাগলি মামি বিড়বিড় করে শ্রীমাকে কটুকথা বলছেন। মা সারদা তখন পুজো করছিলেন। পুজো শেষ করে পাগলির দিকে চেয়ে বলেন, ‘কত মুনি ঋষি তপস্যা করেও আমাকে পায় না, তোরা আমাকে পেয়ে হারালি’। কাশীতে একদিন সকালবেলায় মা সারদা বলছেন, ‘কাল সারা রাত ছোটবৌ আমাকে গাল দিয়েছে, বলেচে, “ঠাকুরঝি মরুক”, ছোটবৌ জানে না যে আমি মৃতুঞ্জয় হয়েচি’। এমনই টান শ্রীমার শ্বশুরবাড়ির প্রতিও ছিল। স্বামী তন্ময়ানন্দ একবার জয়রামবাটিতে গিয়ে দেখেন, শ্রীমা চিন্তান্বিত হয়ে বসে আছেন। প্রণাম করতেই তিনি বললেন,’ কামাপুকুরে রামলালের অসুখ। রামময়কে দেখতে পাঠিয়েচি, সে এখনো ফিরে আসে নি, কি জানি, অসুখ বেশি হল কিনা’। এই হলেন স্নেহময়ী মা, যে রামলাল, ঠাকুরের সঙ্গেও কখনো খারাপ আচরণ করেছে, ঠাকুর স্নেহের ভাইপোকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। আর ঠাকুর ইহলোক ত্যাগ করার পর তো খাজাঞ্চির সঙ্গে শলা করে শ্রীমার জন্য ঠাকুরের প্রাপ্য মাসোহারা বন্ধ করিয়ে দেয়। তারই অসুস্থতায় শ্রীমা আকুল হয়েছেন। শ্রীকৃষ্ণকেই কি বিদুর ও তাঁর পত্নী ছাড়া ধৃতরাষ্ট্র, দুর্যোধন সেভাবে চিনতে পেরেছেন। অথচ, পাণ্ডবদের মতন তাঁরাও তো শ্রীকৃষ্ণকে কাছ খেকেই দেখেছেন। তাও সম্যক্ উপলব্ধি করার তাঁদের সামর্থ্য ছিল না।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯২: মহর্ষিদেব নাতজামাইকে দিয়েছিলেন সোনার কলম

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬৭: পাঞ্চালদেশে যাত্রাপথে পাণ্ডবদের বিচিত্র অভিজ্ঞতায় কিসের ইঙ্গিত?

শুধু কি নিজের কাছের লোকজনকে শ্রীমা তাঁর করুণা দিয়েছেন, তা তো নয়। গ্রামবাসীদের সকলেরই তিনি ঘরের সংবাদ রাখতেন। অসময়ে তাদের সাহায্য করতেন। তারা জানত যে, শ্রীমার কাছে এসে বলতে পারলেই শোকে সান্ত্বনা পাবে। অসুখে তাদের ঔষধপথ্যের ব্যবস্থা হবেই। তারা অনেকবার দেখেছে যে, গ্রামে শ্রীমা থাকায় অন্যত্র দুর্ভিক্ষ হলেও এখানে অন্নাভাব হয় না। তাঁর উপস্থিতিতে অনাবৃষ্টি দূর হয়ে যায়। একবছর বাঁকুড়ার রিলিফের কাজ থেকে ফিরে বরদানন্দ লোকের অন্নাভাবজনিত দুর্গতির কথা বলতে থাকলে শ্রীমা চারদিকে হাত ঘুরিয়ে দেখিয়ে বলছেন, ‘দেখ বাবা, মা সিংহবাহিনীর কৃপায় এইটুকুর মধ্যে ওসব কিছু নেই। বাঁকুড়াবাসীর চারপো হয়েচে, ভাগ্যবান তারা যে, ঠাকুর তাদের শীঘ্রি ক্ষয় করিয়ে দিলেন’। শুনে বরদানন্দ বললেন, ‘মা, আপনি আছেন বলেই এখানে কিছু নেই, সিংহবাহিনী তো বুঝি না’। মা সারদা একথার কোন উত্তর দিলেন না।—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।

Skip to content