বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


রামকৃষ্ণদেব ও শ্রীমা।

ছোটবেলা থেকেই রাধুর শরীর রুগ্ন ছিল। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার অসুখও লেগেই থাকত। তার শরীর অসুস্থ হলে শ্রীমা খুব চিন্তায় থাকতেন। রাধুর জন্য ডাক্তারি, কবিরাজী, দৈব ঔষধ প্রয়োগ বা দেবতার কাছে মানত করা—এইভাবে একটার পর একটা প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতেন তাকে সুস্থ করার। একবার গ্রামীণ চিকিৎসায় ‘চণ্ড’ নামিয়ে তার প্রতিকার জানার জন্য ইরকোণা গ্রামে তিনি বিভূতিবাবুকে পাঠিয়েছিলেন।

একদিন শ্রীমা বললেন, ‘রাধুর অসুখের জন্য ঠাকুরকে বল্লুম, কিছু হল না। কত ডাক্তার, কবরেজ এসে গেল, তাদেরই সুবিধে হল’। নলিনী, সুশীলা আর রাধারানি, তিনজনেরই এখন পনের থেকে একুশের মধ্যে বয়স। কেউই সেইভাবে শ্বশুরবাড়ির ঘর করল না। রাধারানিও বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি কদাচিৎ যেত। এই বিষয়ে ১৩২২ সালে তেরই চৈত্র ঘারিন্দার নীরদবালা মজুমদারকে লেখা এক চিঠিতে শ্রীমা জানিয়েছেন যে, বিয়ে হয়ে যাওয়ায় রাধু জয়রামবাটিতে না থাকায় এখন তাঁর চিঠিপত্রের উত্তর দেবার অসুবিধা হয়। ১৩৫৫ সালের ১৮ বৈশাখ, শরৎ মহারাজ তাঁর দিনলিপিতে লিখেছেন, “Radharani came from Tajpur. Decided that Radhu will come to Calcutta with her husband in the month of Jaistha.”
রাধুর সঙ্গে দৈনন্দিন ব্যবহারে এক এক সময় মা সারদার মধ্যেও অপরূপ বালিকাভাব ফুটে উঠত। সুশীলা দত্ত বলেন যে, একদিন রাধু শ্রীমার কাছে এসে তার স্বামীর বিরুদ্ধে নালিশ করে যে বর তাকে চড় মেরেছে। শ্রীমা তার কারণ জানতে চাইলে রাধু বলে, সে বরকে গামছা ছুঁড়ে মেরেছে। এই শুনে শ্রীমা মন্মথের ওপর রেগে গিয়ে বলেন যে, একটা গামছা ছুঁড়ে মারলেই কি কেউ চড় মারতে পারে? সুশীলা দত্ত তখন মা সারদাকে বলেন, ‘রাধু যদি গামছা ছুঁড়ে মেরে থাকে, তাহলে বর তো এরকম করতেই পারে’। শ্রীমা শুনে তৎক্ষণাৎ বললেন, ‘তাই কি বৌমা? তোমাদের কি এরকম করে? ঠাকুরের সঙ্গে তো আমার এরকম ব্যবহার কখনও হয়নি, এসব জানি না। রাধুকে বললেন, ‘শোন্, তোরই তো দোষ তাহলে। এরকম কত্তে নেই’।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪৭: সারদা মা ও তাঁর রাধু

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫০: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—গরিয়া, গোলপাতা ও হেতাল

শ্রীমার নিজ দৃষ্টান্ত ও তাঁর উপদেশে সৎশিক্ষা দিয়ে রাধুকে মানুষ করা হলেও রাধুর ক্ষুদ্র আধারে সবটা গ্রহণ করার সামর্থ্য ছিল না। শ্রীমার আদর ও যত্নে তার চরিত্রের একগুঁয়ে ও আহ্লাদি ভাব আরও বেড়ে গিয়েছিল। তার ওপর নিজের মায়ের মস্তিষ্কবিকার রাধুর মধ্যেও সংক্রামিত হয়েছিল। তাই রাধুরও হাবভাবের পরিবর্তন হয়েছিল। খিটখিটে মেজাজ, যখন তখন কুকথা বলা তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। সে বিনা কারণে অনেক সময় শ্রীমার ওপর রেগে যেত, যথেচ্ছ গালি বর্ষণ করে উপস্থিত মা সারদার ভক্তদের মনে ব্যথা দিত। এমনকি মাথার বিকারে মাঝে মাঝে শ্রীমার প্রতি শারীরিক নির্যাতনও করত। এখনও রাধুর ছেলেপুলে হয়নি, তবে মা সারদা আঁচ করেন যে হতেও বেশি দেরি নেই।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৫: সুর হারানো হারানো সুর

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯০: সাহেবের বেশ না-পরে ফিরেছিলেন সাহেবের দেশ থেকে

শ্রীমার ভক্ত নগেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের কথা থেকে জানা যায় যে, রাধুর স্বামী মন্মথকে নিয়েও শ্রীমাকে অনেক সময়ে বিব্রত হতে হয়েছে। সে বড় ঘরের স্বেচ্ছাচারী, বিলাসী যুবক। নিজের শ্বশুরবাড়ি এসেও নিজ স্বভাব নিয়ন্ত্রণ করে চলতে পারতেন না। রাধুর অসুখের সময় সে মাঝে মাঝে কোয়ালপাড়ার মঠে এসে থাকলেও মঠের নিয়ম মানতেন না। মঠে একদিন ঠাকুরের আরতির সময় আড্ডা ও বৈঠকী গানে তাকে মত্ত থাকতে দেখে মঠাধ্যক্ষ মৃদু তিরস্কার করেছিলেন। মন্মথ রাগ করে তখনই গরুরগাড়ির ব্যবস্থা করে বাড়ির পথে যাত্রা করেন। শ্রীমা তা জানতে পেরে শীঘ্র লোক পাঠিয়ে তাকে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করেন।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২৪: অপরাজিতা রাধারাণী

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৩: এক্সপায়ারি ডেটের ওষুধ খাবেন?

জয়রামবাটি যাবার পথেই পড়ে কোয়ালপাড়া। সেখানে শ্রীমার নতুনবাড়ি তৈরি হওয়ায় নানাকর্ম শুরু হয়েছে। সেখানে জগদম্বা আশ্রমে ঠাকুরের মঠ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পরিবেশটি বেশ শান্ত। আশ্রম আর শ্রীমার বাড়ির মাঝে সামান্য ব্যবধান আছে। এই জগদম্বা আশ্রম কোতুলপুর ও দেশড়া সদর রাস্তার ওপরে আর শ্রীমার বসতবাটি এর থেকে দুশো গজ দূরে। চারদিক পাঁচিল দিয়ে ঘেরা, সিমেন্টের মেঝে। এছাড়া ঢেঁকি ও গোয়ালও আছে। কয়েতবেল আর তেঁতুলগাছে ছাওয়া। গাছপালার ছায়ায় ঢাকা, পাখি ডাকে, বেশ নির্জন-নিরিবিলি। এই নিবিড় নির্জনতাই রাধুর পছন্দ।
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩৩: এখনও সারেঙ্গিটা বাজছে

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬৪: প্রজাদের আনন্দ, স্বস্তি, আশ্রয় রাম—তাঁর কাছে প্রজাদের আনুগত্যের স্থান কোথায়?

১৩২৫ সালে রাধু অন্তঃসত্ত্বা হয়ে অসুস্থ হলে শ্রীমা তাকে কলকাতা থেকে কোয়ালপাড়ার নির্জনতায় নিয়ে যান। শ্রীমা তখন রাধুর জন্য অতি ব্যস্ত হয়ে পড়েন। সেবারে দীর্ঘকাল রাধু শয্যাশায়িনী থাকলেও মা সারদার অশেষ যত্নে নিরাময় হয়েছিল। নিজের শরীরের দিকে তাকাতে পারেননি মা সারদা। এখানে তাঁকে সাহায্য করার জন্য বউ ও মেয়ের অভাব নেই। তা ছাড়া বরদা আর রাজেন নামের ব্রহ্মচারী ছেলেদুটিও খুবই পরিশ্রমী এবং আন্তরিক। বরদা কলকাতায় থাকার সময়ে রাধুর অস্বাভাবিক মানসিকতার কথা জানে। রাধু কোনওরকম শব্দ সহ্য করতে পারে না। কলকাতার বাড়িতে শ্রীমা সব ধাতব জিনিসের ওপর কাপড় জড়িয়ে দিতেন। শীত চলে গিয়ে এখন গাছে ফুল ফুটেছে, সেই বনজ গন্ধে প্রকৃতি ভরপূর হয়ে উঠেছে। শ্রীমা এরই মধ্যে শুনতে পান যে দেশড়ার মাঠে নাকি এক ভালুক বেরিয়ে অম্বিকা চৌকিদারের মাকে মেরে ফেলেছে। এদিকে রাধুর ক্ষ্যাপামি কমার কোনও লক্ষণ নেই।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪৪: দুষ্টরা সুযোগ পেলেই যোগ্য ব্যক্তিকে সরিয়ে অধিকার কায়েম করে

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৬৭: মুখোমুখি প্রথমবার /২

মহেশ্বরানন্দ বলেন যে, প্রসবের বেশ পূর্ব থেকেই রাধু স্নায়বিক অবসাদে শয্যাশায়িনী হয়ে পড়ে। শরৎ মহারাজ রাধুর কোষ্ঠী দেখে বুঝেছিলেন যে তার সুখপ্রসব হবে না। অস্ত্রোপচার করতে হবে। তিনি তাই ধাত্রীবিদ্যায় অভিজ্ঞ সরলাকে পাঠিয়েছিলেন। মহেশ্বরানন্দকেও থাকতে বলেছিলেন। তবু রাধুর এরকম অবস্থাতেও সুপ্রসব হয়েছিল, যা সকলের অভিজ্ঞতার বাইরে। তিনি বলেন, ‘মার প্রভাব ছাড়া একে আর কি বলব’?

রাধুর প্রসবের জন্য ডাক্তার আনার আগে ইন্দুভূষণ সেনগুপ্তকে শ্রীমা বলেছিলেন, ‘কুকুর, শিয়াল যারা বনে থাকে তাদের কি আর প্রসব হয় না? কে দেখে? ঠাকুরই দেখবেন’। কোয়ালপাড়ার বনের মত জায়গায় জন্মেছিল বলে শ্রীমা রাধুর ছেলের নাম রাখেন বনবিহারী, সংক্ষেপে বনু। ১৩২৫ সালের ২৪ বৈশাখ তার জন্ম হ্য়। মা সারদা রোজ সকালে গান গেয়ে বনুর ঘুম ভাঙাতেন—“উঠ, লালজি, ভোর ভায় সুর-নর-মুনি-হিতকারী। স্নান করে দান দেহি গো-গজ-কনক-সুপারি। শ্রীমা বলতেন যে, মাতা কৌশল্যা এমনভাবে গান গেয়ে শিশু রামচন্দ্রকে ওঠাতেন।—চলবে।
* ড. মহুয়া দাশগুপ্ত, শিক্ষক এবং লেখক। রবীন্দ্রনাথের দেবলোক, জোড়াসাঁকোর জার্নাল, আমি নারী আমি মহীয়সী, কথানদীর কূলে, লেডিজ স্পেশাল, পথে পুরুষ বিবর্জিত, পরীক্ষায় আসবে না এবং ভুবনডাঙার বাউল তাঁর লেখা একক বই। বাংলা কথকতা নিয়ে একক ভাবে কাজ করছেন।

Skip to content