সোমবার ৮ জুলাই, ২০২৪


শ্রীমা।

সেই যুগে শিক্ষিত মেয়েদেরও অবিবাহিত জীবনযাপন কল্পনাতীত ছিল। মা সারদা মানসিক দিক থেকে সময়ের চাইতে অনেক এগিয়ে ছিলেন। তাই তিনি শুধু উপদেশ দিয়ে নয়, নিজেও দৃঢ়ভাবে তা কার্যে পরিণত করেছেন। সন্ন্যাসিনী গৌরীপুরী মাতার পালিতা কন্যা দুর্গাকে সকলের অমত সত্ত্বেও তিনি ইংরাজি শিখতে পাঠান। তাই নয়, পুরুষ সাধু, ব্রহ্মচারিরাও যাতে পাশ্চাত্য দেশের সঙ্গে ভাব বিনিময় করতে পারেন, তার জন্য ইংরাজি শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা করে গিয়েছিলেন।
পারুল মুখোপাধ্যায় নামে একটি মেয়ে অল্পবয়সে গৃহত্যাগের পর নিবেদিতার সহকারী সুধীরাদির আশ্রয়ে আত্মগোপন করে। সে শ্রীমার অত্যন্ত স্নেহের পাত্রী ছিল। শ্রীমা তার নতুন নাম দেন সরলা। এই সরলাদেবীই পরবর্তী কালে হন সারদা মঠের প্রথম অধ্যক্ষা, সন্ন্যাসিনী প্রব্রাজিকা ভারতীপ্রাণা। এই ব্রাহ্মণকন্যাকে শ্রীমা পাঠিয়েছিলেন লেডি ডাফরিন হসপিটালে ধাত্রীবিদ্যা ও শুশ্রুষা শেখার জন্য। তৎকালীন সমাজে নার্সিং কাজটা ছিল অচ্ছুত, বারজাতের ছোঁয়াছুঁয়ির ব্যাপার। তাও এ যে খিষ্টানদের ম্লেচ্ছ হাসপাতাল। শ্রীমার স্ত্রীভক্তদের এটা ভাল লাগেনি।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪৪: সারদা মায়ের মানসিক দৃঢ়তা

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৭: কবির জন্মদিনে প্রিয়জনের উপহার

গোলাপমা সাহস করে শ্রীমাকে বললেন, “হিন্দু ঘরের বামুনের মেয়ে হাসপাতালে ছত্রিশ জাতের সেবা করবে? সে আবার কি গো? এরপর ওর হাতে আমরা খাব কি করে? যত সব অনাসৃষ্টি।” মা সারদা শুনে শান্তস্বরে বললেন, “সে কি গোলাপ, ও ফিরে এসে তো আমাদেরই সেবা করবে”। সরলাদেবীর শিক্ষা শেষ হতে চারবছর লাগে। তিনি ফিরে এসে কেবল শ্রীমায়ের নয়, অনেক মাতৃভক্তেরই সেবা করেন। প্রয়োজনের সময় শ্রীমা যে কিরূপ কঠোর হতে পারতেন, সেই বিষয়ে স্বামী সারদানন্দ বলেছেন, “স্বামীজির কাজের উদ্দাম আবেগের রাশ অনেক সময় মা টেনে ধরতেন। যেমন কলকাতায় প্লেগ মহামারীর সময় সেবাকার্যে প্রয়োজনীয় অর্থের অভাব ঘটায় স্বামীজী বেলুড়মঠ বিক্রির ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। প্রস্তাবটি মায়ের কাছে উত্থাপন করা হলে তিনি তৎক্ষণাৎ বললেন, “সে কি বাবা, বেলুড়মঠ বিক্রি করবে কি? মঠ স্থাপনায় আমার নামে সংকল্প করেছ এবং ঠাকুরের নামে উৎসর্গ করেছ। তোমার ওসব বিক্রি করার অধিকারই বা কোথায়?”
আরও পড়ুন:

ইতিহাস কথা কও, পূর্বোত্তরে ইতিহাস ঐতিহ্যে হাতি

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৭: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—বাইন ও গর্জন

সেসময় স্বামীজীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস তাঁর কোনও গুরুভাইদেরও ছিল না। একমাত্র মা সারদাই পারতেন। শ্রীমার দৃঢ়তার জন্যই সেদিন রক্ষা পেল শ্রীরামকৃষ্ণ মিশনের প্রাণকেন্দ্র আজকের বেলুড়মঠ। এইভাবে শ্রীমা তাঁর ভক্তসন্তানকে প্রয়োজনে শাসন করতে দ্বিধা করেননি। গিরীশ ঘোষ একবার তাঁকে প্রশ্ন করেন, “আচ্ছা, তুমি কেমন মা?” সারদা মা বলেন, “আমি সত্যিকারের মা। গুরুপত্নী নয়, পাতানো মা নয়, কথার কথা মা নয়, সত্য জননী।”

তথাকথিত শিক্ষার আলো না পাওয়া এই মহীয়সী অতি সহজ, সুন্দর উপমা দিয়ে নানা প্রশ্নের নিরসন করেছেন। কোনও ভক্ত যদি জানতে চায়, “তত্ত্বজ্ঞান লাভ কি করে হয় মা?” শ্রীমা বললেন, “যেমন ফুল নাড়তে নাড়তে ঘ্রাণ বের হয়, চন্দন ঘষতে ঘষতে গন্ধ, তেমন ভগবৎ কথা আলোচনা করতে করতেই তত্ত্বজ্ঞান লাভ হয়।” একজনের জিজ্ঞাসা হল, প্রারব্ধ ক্ষয় কিভাবে হবে, শ্রীমা বলেন, “আকাশের চাঁদটি মেঘে ঢেকেছে। ক্রমে হাওয়ায় মেঘটি সরে যাবে, তবে তো চাঁদটি দেখতে পাবে। ফস করে কি যায়? এও তেমনি”। নলিনী জানতে চান, “কাশীতে মরলে কি মুক্তি হয়?”
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩২: কে বলে ঈশ্বর গুপ্ত?

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৩: বাবু ডাক্তার ও ‘ডাক্তারবাবু’

শ্রীমা বলেন যে, নির্বাসনা হলে এখনই মুক্তি হবে। আর বাসনা থাকলে জীবের যাতায়াত ফুরোয় না। বাসনা হল সূক্ষ্ম বীজ। যেমন বটের বীজ থেকে প্রকাণ্ড বৃক্ষ হয়। কামনা থাকলে পুনর্জন্ম হবেই’। আবার একদিন স্বামী অরূপানন্দ একটি বটের বীজ দেখিয়ে বলেন, “মা দেখুন, লালশাকের বীজের চাইতেও ছোট, এ থেকে অত প্রকাণ্ড গাছ! কি আশ্চর্য!” উত্তরে শ্রীমা বলেন, “তা হবে না? এই দেখ না, ভগবানের নামের বীজ কতটুকু! তা থেকেই কালে ভাব, ভক্তি, প্রেম, কত কি হয়।”
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬১: মহাভারতের রাক্ষসরা কী আজও বর্তমান? প্রসঙ্গ— বকরাক্ষসবধ

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২২: সরলাদেবী, এক পণ্ডিত মানুষ

সাধক-সন্ন্যাসীদের তিনি বলছেন, “সূর্য থাকে আকাশে আর জল থাকে নিচুতে। জলকে কি ডেকে বলতে হয়, ওগো সূর্য, তুমি আমাকে উপরে তুলে নাও। সূর্য আপনার স্বভাব থেকে জলকে বাষ্প করে উপরে তুলে নেয়।” আবার জপধ্যান অভ্যাস করা নিয়ে সারদা মা বলেন, “মন না বসলেও জপ ছাড়বে না। নাম করতে করতে মন আপনি স্থির হবে, ঠিক বায়ুহীন দীপশিখার মতো।” এখানে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার যোগীর নিরুদ্ধচিত্তের কথা স্মর্তব্য— “যথা দীপো নিবাতস্থো নেঙ্গতে।” অর্থাৎ বায়ুরহিত স্থানে যেমন দীপ কাঁপেনা। ভাবলে বিস্ময় জাগে যে শ্রীমার কাছে গীতার বাণীও অজ্ঞাত ছিল না। —চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।

Skip to content