শ্রীরামকৃষ্ণ ও শ্রীমা।
গোলাপমা একদিন মা সারদার কাছে জানতে চান তাঁর বাড়ির খবর, সবাই ভালো আছেন কিনা। শুনে শ্রীমা বলেন যে, সংসারের কথা আর কি বলবেন। সবসময় কিছু না কিছু লেগে আছে। তাঁর বড় ভাইয়ের দুটি মেয়ে, নালু অর্থাৎ নলিনী আর সুশীলা, যার ডাকনাম মাকু। ওদের মা রামপ্রিয়া বড় ভোগে, তাই সেই দুটি নিজের ভাইজি তাঁর কাছেই আছে। শ্রীমা বললেন, ‘মানুষ করছি সব’। আবার ছোট ভাইয়ের বউ সুরবালাও থাকে, মেয়েটি ভাল, তবে মাঝে মাঝে তার বাই চাপে। তখন সামলাতে হয়।
শ্রীমার মেজভাই কালীর ছেলে ডূদেব আর বরদার ছেলে খুদি যখন তিনি জয়রামবাটি যান, তখন তারাও পিসিমার কাছেই থাকে। খুদিরামের নাম শ্রীমার শ্বশুরের নামে হওয়ায় তিনি তাকে ফুদি বলেই ডাকেন। এদিকে বড় ভাইজি নলিনীর বিয়ে হয়ে গেলেও সে শ্বশুরঘরে খাকতে না পেরে প্রায়ই চলে আসে তার পিসির কাছে। এবার ছোট ভাইজি মাকুরও বিয়ে দিতে হবে। শ্রীমার ছোটভাই অভয় তো তার পুরো সংসারের দায়িত্ব সারদা মাকে দিয়ে গিয়েছেন। বড়জামাই প্রমথ ভট্টাচার্য অনেকবার নলিনীকে নিতে এসে ফিরে গিয়েছেন।
শ্রীমার মেজভাই কালীর ছেলে ডূদেব আর বরদার ছেলে খুদি যখন তিনি জয়রামবাটি যান, তখন তারাও পিসিমার কাছেই থাকে। খুদিরামের নাম শ্রীমার শ্বশুরের নামে হওয়ায় তিনি তাকে ফুদি বলেই ডাকেন। এদিকে বড় ভাইজি নলিনীর বিয়ে হয়ে গেলেও সে শ্বশুরঘরে খাকতে না পেরে প্রায়ই চলে আসে তার পিসির কাছে। এবার ছোট ভাইজি মাকুরও বিয়ে দিতে হবে। শ্রীমার ছোটভাই অভয় তো তার পুরো সংসারের দায়িত্ব সারদা মাকে দিয়ে গিয়েছেন। বড়জামাই প্রমথ ভট্টাচার্য অনেকবার নলিনীকে নিতে এসে ফিরে গিয়েছেন।
সারদা মা জানেন, তার ভাইজি যেমন পিটপিটে, তেমনই শুচিবাই। তার ওপর ওর মা মারা যাওয়ার পর প্রসন্ন দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছে। এইসব ভেবে নলিনীদের প্রতি তাঁর দুর্বলতাও আছে। কিন্তু নলিনী তার ছোটমামি সুরবালাকে দু’ চোখে দেখতে পারেনা। বিয়ের পর শ্রীমার ভাইজি মাকুর একটি ফুটফুটে ছেলে হয়েছে, এখনও তার দুবছর হয়নি। তাকে ন্যাড়া বলে ডাকা হয়। সেও হামা দিয়ে কখনও বা টলমল পায়ে হেঁটে সারদা মার কোল দখল করে বসে। আর এদের সবার সঙ্গে শ্রীমার সবথেকে আপন ছোট ভাইজি রাধু তো প্রায় তাঁর মেয়ে।
নিবেদিতা ও অন্যান্য বিদেশিনী মেয়েদের সঙ্গে মা সারদার মা-মেয়ে সম্পর্ক। তাদের সঙ্গে একসাথে খাওয়া-দাওয়া, এসব সেযুগে ছিল কল্পনারও অতীত। হিন্দুদের কাছে সেই সময় মুসলমান, খ্রিষ্টান সবাই ছিল যবন তথা ম্লেচ্ছ। এমনকি সমাজের মধ্যে জাত-পাতের বিধান ছিল কঠোর নিয়মে বাঁধা। আর তার মধ্যেই জাত-পাত ভাঙা মাতৃপ্রতিমারূপিণী মা সারদা। ঠাকুরের চিকিৎসক ছিলেন শ্যামাদাস কবিরাজ। শ্রীমা রাধুকে বলতেন, ‘এঁকে প্রণাম করো’। অন্যরা যদি মনে করিয়ে দিত, উনি তো বৈদ্য। রাধু তো বামুনের মেয়ে। শ্রীমা বলতেন, ‘সে কি, কত বড় জ্ঞানী, উনি তো বামুনেরও শ্রেষ্ঠ’।
নিবেদিতা ও অন্যান্য বিদেশিনী মেয়েদের সঙ্গে মা সারদার মা-মেয়ে সম্পর্ক। তাদের সঙ্গে একসাথে খাওয়া-দাওয়া, এসব সেযুগে ছিল কল্পনারও অতীত। হিন্দুদের কাছে সেই সময় মুসলমান, খ্রিষ্টান সবাই ছিল যবন তথা ম্লেচ্ছ। এমনকি সমাজের মধ্যে জাত-পাতের বিধান ছিল কঠোর নিয়মে বাঁধা। আর তার মধ্যেই জাত-পাত ভাঙা মাতৃপ্রতিমারূপিণী মা সারদা। ঠাকুরের চিকিৎসক ছিলেন শ্যামাদাস কবিরাজ। শ্রীমা রাধুকে বলতেন, ‘এঁকে প্রণাম করো’। অন্যরা যদি মনে করিয়ে দিত, উনি তো বৈদ্য। রাধু তো বামুনের মেয়ে। শ্রীমা বলতেন, ‘সে কি, কত বড় জ্ঞানী, উনি তো বামুনেরও শ্রেষ্ঠ’।
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪২: শ্রীমার ভাইপো খুদি
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৫: সুন্দরবনের প্রকৃত ম্যানগ্রোভ ও ম্যানগ্রোভ-সহযোগীরা
একদিন রাতে রাঁধুনি আসেনি। বারুইদের মেয়ে সুশীলা সারদা মাকে খুব ভক্তি করত। সে বলল, ‘মা, আমি রাঁধব, খাবেন’? শ্রীমা বললেন, ‘তোমরা আমার মেয়ে, কেন খাব না’? দূর থেকে কেদারের মা কথাটা শুনতে পেয়ে মুখিয়ে ওঠে, ‘কি সাহস তোর, বারুই হয়ে…’ সুশীলা কেঁদে ফেলে। তাকে ফিরে যেতে দেখে শ্রীমা সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ‘ওদের কথা কানে নিও না’। শ্রীমার ভাইজি নলিনীর একেবারে বিপরীত স্বভাব। সে কথায় কথায় গঙ্গাজল মাথায় দেয়। একদিন শ্রীমা যখন পুজো করছিলেন, তাঁর ভক্ত ও মন্ত্রশিষ্য বিভূতি দেখা করতে আসেন। নলিনী জানতে চান, তাঁদের কি প্রয়োজন। বিভূতিবাবু পুজো দিয়ে মায়ের অনুমতি নিতে এসেছিলেন। কথা বলতে বলতে তিনি পাঁঠার পাটি বার করলেন। দেখে তো নলিনী ক্ষিপ্ত হয়ে বললে, ‘ছিছি, আপনারা মাংস নিয়ে এবাড়িতে এসেছেন’।
আরও পড়ুন:
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২০: মানকুমারী বসু—সাহিত্য জগতের উজ্জ্বল রত্ন!
পর্দার আড়ালে, পর্ব-৫২: সোনার কেল্লা’র শুটিংয়ে খাটের মধ্যে কাঁকড়াবিছে নিয়ে সে কি হুলস্থুল কাণ্ড!
মুহূর্তমধ্যে বিভূতিবাবু ও তাঁর সঙ্গে আসা পরিবারটি অপ্রস্তুত হয়ে বলে, ‘অন্যায় হয়ে গেল দিদি’? নলিনী বলে, ‘এখনও দাঁড়িয়ে আছেন আপনারা’? চিৎকার শুনে শ্রীমা বেরিয়ে আসতেই নলিনী বলে, ‘সরে যাও পিসিমা, দেখ দিকি, ভরদুপুরে একি অনাচার! পাঁঠার ঠ্যাং নিয়ে ঢুকেছে’। শ্রীমা বলেন, ‘ও তো প্রসাদী মাংস’। কঠিন চোখে নলিনীকে শাসন করেন সারদা মা, ‘অত শুচিবায়ুগ্রস্ত হলে তুই সরে যা, অমনভাবে বলতে নেই’। বিভূতিবাবু বলেন যে, তাঁরা সিংহবাহিনীর মন্দিরে পুজো দিয়েছেন। তাই মায়ের কাছে মাংসভক্ষণের অনুমতি নিতে এসেছেন। মুসলমান ডাকাতের কাহিনী ভাবা যাক, সে তো সামান্য ব্যাপার নয়। জয়রামবাটির কাছে শিরোমণিপুর নামে একটি মুসলমানপল্লী ছিল। একসময় সেখানে ভাল রেশমতুঁতের চাষ হত। কিন্তু বিলিতি রেশমের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় তারা পেরে উঠল না। তখন বৃত্তিহীন হয়ে সেই রেশমচাষিরা চুরি-ডাকাতির পথ বেছে নেয়। ফলে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে জেল খাটে। ছাড়া পাওয়ার পর কেউ তাদের ভয়ে কাজ দেয়না।
আরও পড়ুন:
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫৯: মহাভারতের বিচিত্র কাহিনিগুলিতে আছে মৃত্যুজয়ের অভয়বাণী
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪১: প্রতিকার না করেও রাজা যদি প্রজার দুঃখটুকুও শোনেন তাহলেও যথেষ্ট
কোনও পল্লীতে কাজের খোঁজে গেলে গৃহস্তরা আতঙ্কে দরজা বন্ধ করে দেয়। এক মুসলমান কয়েকটি কলা এনে মাকে বললে, ‘এগুলি ঠাকুরের জন্য এনেছি, নেবেন কি’? শ্রীমা হাত পেতে বললেন, ‘ঠাকুরের জন্য এনেছ, নেব বৈ কি’। তাই দেখে এক স্ত্রীভক্ত বলেন যে, এরা চোর, এদের আনা জিনিস ঠাকুরকে দেওয়া’! শ্রীমা বলেন, ‘কে ভাল, কে মন্দ, আমি জানি’। শ্রীমা তাদের মুড়ি-মিষ্টি দিলেন। এদেরই একজন ছিলেন ডাকাত আমজাদ। সেও রেশমচাষী ছিল, এখন জেল খেটে বেরিয়েছে। কাজের সন্ধানে ঘুরছে। ঘুরতে ঘুরতে সে সারদা মায়ের দরজায় গিয়ে হাজির হল। কিন্তু মায়ের দোর তাকে দেখে বন্ধ হল না। তিনি ডেকে নিজের ঘরের কাজে লাগালেন। লোকটা একটানা কাজ করছে।
আরও পড়ুন:
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৫: ভূপেনবাবুর ভূত
হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৩৭: ওরাল হেলথ
বেলা গড়াতেই শ্রীমার মনে হল, লোকটি ক্লান্ত, বোধহয়, না খেয়েই বেরিয়েছে। তিনি তাকে ডেকে যত্ন করে খাওয়াতে বসালেন। নলিনীকে ডেকে বলেন, তাকে পরিবেশন করতে। আঁতকে উঠে নলিনী বলে, ‘ও মা, ও তো ডাকাত, মুসলমান’। সারদা মা নলিনী ধমকে বলেন,’আমি জানি, তুই দে’। অগত্যা নলিনী ছোঁয়া বাঁচিয়ে দূর থেকে ছুঁড়ে খাবার দিতে লাগলেন। তাই দেখে সারদা মা বিরক্ত হয়ে বলেন যে, অমনভাবে দিলে মানুষের খেয়ে কি সুখ হয়। এবার তিনি নিজে কাছে বসে তাকে খাওয়ালেন। তারপর নিজহাতে তার এঁটো পরিষ্কার করলেন। তাই দেখে নলিনী তো তাজ্জব, ‘হিন্দু বামুনের বিধবা হয়ে কিনা মুসলমান ডাকাতের এঁটো ঘাঁটছ’। তাকে ধমক দিয়ে শ্রীমা বলেন, ‘শরৎ আমার যেমন ছেলে, আমজাদও আমার তেমন ছেলে।—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।