শ্রীমা।
শ্রীমায়ের বড়ভাই প্রসন্ন মিতভাষী হলেও বেশ হিসেবী। মেজভাই কালীকুমার সহজে রেগে গেলেও তার মনটা নরম, নিজেই মানিয়ে নেয়। প্রসন্ন রোজগারের জন্য কলকাতায় থেকে পৌরোহিত্য করে। আর ভিটেবাড়িতে সব সামলায় কালীকুমার ও বরদাপ্রসাদ। কালীকুমারের স্ত্রী সুবোধবালা এবং বরদার স্ত্রী ইন্দুমতী দু’ জনেরই দুই পুত্রসন্তান। সুবোধবালার ছেলে ভূদেব মাঝে মাঝে তার সারদাপিসির কাছেই থাকে। দশ-এগারো বছর বয়সে ইন্দুমতী যখন শ্বশুরবাড়ি আসেন, তখন সেখানে গোলাপমা, যোগীনমা, মাস্টার মশায়ের স্ত্রী নিকুঞ্জদেবী, সবাই ছিলেন।
ইন্দুমতী বলেছেন, তিনি শ্রীমার কাজ খুব করেন দেখে নিকুঞ্জদেবী বলেন, ‘মা, তুমি তো একটি ঝি বেশ ছোট পেয়েছ’। সারদা মা শুনে হেসে বলেছিলেন, ‘না বৌমা, ও ঝি নয়, ও যে আমার বরদার বৌ গো’। সকলে তখন খুব হাসতে লাগলেন। একদিন শ্রীমা ইন্দুমতীকে বলেন, ‘দেখ, তোরা ছেলেমানুষ, খুব সাবধান হয়ে কাজ করবি। আমার ঠাকুর হাত-পা-ওয়ালা, যদি অসাবধান হোস, তোদের অপরাধ হবে’। ইন্দুমতী স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘প্রথমদিকে মা রোজ রান্না করতেন। আমি ও নলিনী তখন ছোট, ভালভাবে রান্না করতে পারতাম না। মা বলতেন, আমার কাছে আয়, রান্না শেখ, আমি কি তোদের সংসারে বারমাস রান্না কত্তে পারব’? পরে শ্রীমা ইন্দুকে বলতেন, ‘তুই রেঁধে এবাড়ি আগে দিয়ে যাবি, ডুমুরের ডালনা তুই বড় ভাল রাঁধিস।
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩৮: অভিভাবিকা মা সারদা
এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-৪: উদয়পুর অভিযানে মগ সৈন্যরা ত্রিপুরা সুন্দরী মন্দিরের চূড়া ভেঙে দিয়েছিল
ইন্দুমতী দেবী জানান, শ্রীমা ডুমুরের ডালনা, আমরুল শাক, গিমে শাক, এসব খেতে ভালোবাসতেন। শ্রীমার ছোট ভাই অভয় যখন দেহরক্ষা করে, তাঁর স্ত্রী সুরবালা তখন গর্ভবতী। তিনি সেসময় নিজের বাপের বাড়িতে ছিলেন। শৈশবে মাতৃহারা সুরবালা তাঁর দিদিমা ও মাসিমার কোলে বড় হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর স্বামীর মৃত্যুর কিছুদিন বাদেই দিদিমা দেহ রাখেন। তাঁর মাসিমাও রোগে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। মৃত্যুর আগে অভয় শ্রীমাকে সুরবালা ও তার সন্তানকে দেখার ভার দিয়ে গিয়েছিলেন। ভাইয়ের শেষ কথা স্মরণ করে তিনি সুরবালাকে নিজের কাছে জয়রামবাটিতে নিয়ে আসেন। এর কিছুদিন বাদেই সুরবালার মাসিমার মৃত্যুসংবাদ আসে। উপর্যুপরি তিনটি গভীর শোক পেয়ে সুরবালার মস্তিষ্কবিকৃতি দেখা দেয়। মাঘমাসে সে সেই অবস্থাতেই এক ফুটফুটে কন্যা প্রসব করে। তার পক্ষে সন্তান পালন করা সম্ভব নয় বুঝে শ্রীমা চিন্তিত হন। এই সময় কাশী থেকে কুসুমকুমারী নামে এক স্ত্রীভক্ত এলে শ্রীমা তাঁর হাতে কন্যাটির প্রতিপালনের ভার দেন। কুসুমকুমারী দেবী ফাল্গুন থেকে জ্যৈষ্ঠ মাস অবধি জয়রামবাটিতে ছিলেন।
আরও পড়ুন:
পর্দার আড়ালে, পর্ব-৫০: অর্ধশতাব্দী ছুঁলো ‘অমানুষ’
ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩১: আমার মতে, তোর মতো কেউ নেই
১৩০৭ সালে শ্রীমা কলকাতায় এসে ষোলো নম্বর বোসপাড়া লেনের বাড়িতে কয়েক মাস থাকেন। নিবেদিতার বিদ্যালয় তখন সতের নম্বর বাড়িতে স্থানান্তরিত হয়েছে। ষোলো নম্বর বাড়ির পাশে একটা সরু গলি জায়গা ছিল। একদিন সেই গলি দিয়ে এক চোর এসে রান্নাঘরের জানলা ভেঙে ঢোকে। তখন শেষরাত, প্রদীপ হাতে বাইরে এসে সুরবালা রান্নাঘরে লোক দেখে আতঙ্কে চিৎকার করে উঠে জ্ঞান হারান। এর ফলস্বরূপ তার মস্তিষ্কের বিকার বেড়ে যাওয়ার কারণে সারদা মা তাকে নিয়ে দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নেন। যোগীনমা এবং আরও অনেক স্ত্রীভক্ত মাকে বলেন যে, সেখানে গিয়ে সুরবালার মেয়েকে দেখাশোনার জন্য কুসুমকুমারীর মতো একজন কাউকে রেখে দিলেই চলবে। তাঁরা একজন মহিলাকে রাখার ব্যবস্থাও করেন।
তাই তাঁরা চান, মেয়ে সহ পাগলী সুরবালাকে জয়রামবাটি পাঠান হোক আর শ্রীমা কলকাতাতেই থাকুন। কিন্তু সন্ধ্যার সময় জপ করতে বসে মানসচক্ষে মা সারদা দেখলেন যে, জয়রামবাটিতে মেয়েটি অযত্নে কষ্ট পাচ্ছে। তার পাগলীমা বিকৃতবুদ্ধির ফলে এমন যথেচ্ছভাবে তার পরিচর্যা করছে, তাতে যে কোন সময়ে তার প্রাণসংশয় হতে পারে। মা সারদা তা উপলব্ধি করে আর স্থির থাকতে পারলেন না। তিনি তখনই আসন ছেড়ে উঠে যোগীনমাকে ডেকে বললেন, ‘ও যোগেন, আমার জয়রামবাটি না গেলে চলবেনি। পাগলীর হাতে মেয়েকে দিয়ে আমি কিছুতেই স্থির থাকতে পারবনি’, এই বলে তিনি যা দেখেছিলেন জপে বসে, তা জানান। এরপর তিনি সুরবালাকে নিয়ে বাপেরবাড়ি চলে যান।
তাই তাঁরা চান, মেয়ে সহ পাগলী সুরবালাকে জয়রামবাটি পাঠান হোক আর শ্রীমা কলকাতাতেই থাকুন। কিন্তু সন্ধ্যার সময় জপ করতে বসে মানসচক্ষে মা সারদা দেখলেন যে, জয়রামবাটিতে মেয়েটি অযত্নে কষ্ট পাচ্ছে। তার পাগলীমা বিকৃতবুদ্ধির ফলে এমন যথেচ্ছভাবে তার পরিচর্যা করছে, তাতে যে কোন সময়ে তার প্রাণসংশয় হতে পারে। মা সারদা তা উপলব্ধি করে আর স্থির থাকতে পারলেন না। তিনি তখনই আসন ছেড়ে উঠে যোগীনমাকে ডেকে বললেন, ‘ও যোগেন, আমার জয়রামবাটি না গেলে চলবেনি। পাগলীর হাতে মেয়েকে দিয়ে আমি কিছুতেই স্থির থাকতে পারবনি’, এই বলে তিনি যা দেখেছিলেন জপে বসে, তা জানান। এরপর তিনি সুরবালাকে নিয়ে বাপেরবাড়ি চলে যান।
আরও পড়ুন:
ঠাকুরবাড়িতে দোলে আসত নাচিয়ে, নাচের তালে তালে হত আবিরের আলপনা
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১৭: তিনটি মেয়ের তিনটি কলম!
শোনা যায়, সুরবালার গর্ভকালীন ঠাকুর শ্রীমাকে দেখিয়েছিলেন যে, ওই গর্ভস্থ কন্যাটিই ইহজগতে শ্রীমায়ের অবলম্বনস্বরূপ হবে। ঠাকুরের লোকান্তরের পর তেরো বছর কোনওরকমে অতিবাহিত হলেও দীর্ঘকাল মনকে নিম্নভূমিতে রাখার জন্য একটি মায়ার বন্ধনের প্রয়োজন হয়েছিল। এখন শ্রীমার কাছে সেই বন্ধন এসে উপস্থিত হয়েছে। জন্ম থেকেই এই মেয়ে রাধারানি বা রাধুকে আর তার মা পাগলী সুরবালাকে যিনি ভক্তদের কাছে ‘পাগলী মামী’ বলে পরিচিত, মা সারদার সঙ্গে দেখতে পাওয়া যায়। এদের অবলম্বন করেই শ্রীমার অসংসারী মন যেমন সংসারে বেঁধেছিল। তেমনই তাদের সংস্পর্শে থেকেই ‘আগুনের স্পর্শে সোনার মতন’ শ্রীমায়ের দৈবচরিত্রের বৈশিষ্ট্যগুলিও সমধিক উজ্জ্বল হয়ে প্রকাশ লাভ করে। ঠাকুরের রোগের কারণে সংশয়ী বিষয়ী লোকদের কাছ থেকে তিনি যেমন দূরে চলে গিয়েছিলেন, তেমনই রাধুর প্রতি শ্রীমায়ের টানও তাঁকে বিষয়ী লোকদের থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল।
আরও পড়ুন:
আপনার সন্তান কি প্রায়ই কাঁদে? শিশুর কান্না থামানোর সহজ উপায় বলে দিচ্ছেন ডাক্তারবাবু
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪১: সুন্দরবনে বাঘে-মানুষে সংঘাত
এই বিষয়ে শোনা যায়, বিশ্বেশ্বরানন্দ স্বামী একদিন মাকে বলেন, ‘আপনি এত ‘‘রাধু রাধু’’ করেন কেন? রাধুর ওপর আপনার ভারি আসক্তি’। এরকম কথা তিনি আগেও মাকে দু-একবার বলেছেন। এর উত্তরে শ্রীমা বলতেন, ‘কি করব, বাবা, আমরা মেয়েমানুষ, আমরা এমনই’। কিন্তু এবার শ্রীমা একই প্রশ্ন শুনে একটু উত্তেজিত হয়ে বলেন, ‘তুমি এসব কি বুঝবে? যখন বিদ্যুৎ চমকায়, তখন শার্শিতে চমকায়, তাতে খড়খড়ির কিছু হয় না। যাদের ঈশ্বরচিন্তায় মন বিশুদ্ধ হয়ে যায়, তারা যখন যে কাজ করে তাতে ষোল আনা মন দেয়। তুমি আমার মতো একটি খুঁজে বার কর দেখি’? আশ্চর্যের কথা হল, রাধুর প্রতি শ্রীমার আদরযত্ন দেখে একদল ভক্ত যখন তাঁর মধ্যে আসক্তির ভাব দেখছিলেন। তখন অপর একদল ভক্ত এই আদর যত্নের আড়ালে শ্রীমার মধ্যের নিরাসক্ত মনোভাব অনুভব করে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধান্বিত হয়ে উঠেছিলেন।—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।