শনিবার ১৮ জানুয়ারি, ২০২৫


সারদা দেবী।

মা সারদার কাছে বহু গৃহী ভক্ত ব্রহ্মচর্য ও সন্ন্যাসদীক্ষা পেয়ে নিজেদের ধন্য মনে করেছেন। এই দীক্ষাদান নিয়ে শ্রীমা কোন বিশেষ অনুষ্ঠান করতেন না। শুধু ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করেই তাঁর ভক্তদের মহান ব্রতে দীক্ষা দিতেন। ব্রহ্মচারি হতেন যারা তাদের সাদা ডোরকৌপীন বহির্বাস দিতেন আর সন্ন্যাসীদের গেরুয়া পোশাক দিতেন। কিন্তু যাঁরা সন্ন্যাসী হতে চাইতেন তাঁদের আবশ্যিকভাবে আগে মুণ্ডন করতে হত।

স্বামী সারদেশানন্দ জয়রামবাটিতে শ্রীমার কাছে ব্রহ্মচর্যদীক্ষা নিয়ে জানতে চান যে, এই ব্রত তাকে কতদিন ধারণ করতে হবে। শুনে শ্রীমা জোরের সঙ্গে বলেন, ‘যতদিন দেহ আছে’। তেমনি মা সারদার কোন এক ভক্ত তাঁর কাছে সন্ন্যাসগ্রহণ করে আশীর্বাদ ও উপদেশ চাইলে শ্রীমা বলেছিলেন, ‘বিশ্বাস ও নিষ্ঠাই আসল জিনিস, বিশ্বাস আর নিষ্ঠা থাকলেই সব কিছু লাভ হয়’।
একদিন মা সারদার একজন গৃহী ভক্ত তাঁর কাছে এসে সন্ন্যাস নিতে চাইলেন। তিনি আগে থেকেই সন্ন্যাসীর মতো ত্যাগীর জীবন যাপন করতেন। শ্রীমা তা জানতেন ও তাঁকে বিশেষ স্নেহও করতেন। কিন্তু তাঁর কথা শুনে শ্রীমা বললেন, ‘তুমি তোমার মার একমাত্র সন্তান, তার মনে আমি ব্যথা দিতে পারব না’। সেই ভক্ত শ্রীমার কাছে অনেক অনুনয়-বিনয় করলেন। শ্রীমা তাঁকে জানালেন যে, তাঁর মা যদি সন্ন্যাসগ্রহণ করতে নিজে অনুমতি দেন, তবেই হতে পারে, নয়তো হবে না। সেই ভক্তের মাও শ্রীমার কৃপা লাভ করেছেন। তিনিও খুব ভক্তিমতী আর বৈরাগ্যশীল মহিলা। তিনি ছেলের আধ্যাত্মিক উন্নতির পথে বাধা দিলেন না। নিজের হাতে তাকে গেরুয়াবস্ত্র দিয়ে আনন্দের সঙ্গে অনুমতি দিলেন। ছেলের ইচ্ছা পূর্ণ হল।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৭৩: ভক্তদের সমস্যার সমাধান দিতেন শ্রীমা

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০১: খামখেয়ালির গিরীন্দ্রনাথ

মায়ের নিজহাতে দেওয়া গেরুয়া পরে, তাঁর অনুমতি নিয়ে তিনি বেলুড়মঠের পূজ্যমহারাজের কাছে বিরজাহোম করে যোগপট্ট লাভ করেছিলেন। তাঁর স্বাস্থ্য ভালো ছিল না। হাঁপানির কষ্টে অনেক সময় প্রাণসংকট দেখা দিত। তাই তাঁর মা ছেলেকে সন্ন্যাসের অনুমতি দিলেও শ্রীমার চরণে প্রার্থনা রেখেছিলেন যে ছেলেকে রেখেই সে যেন দেহত্যাগ করতে পারে। পুত্রশোক যেন তাকে ভোগ করতে না হয়। শ্রীমাও কৃপা করে তার ইচ্ছা পূর্ণ করেন। ছেলের দেহত্যাগের কিছুদিন আগেই সে দেহত্যাগ করে বাঞ্ছিতধামে গমন করে।

শ্রীমার অপর সন্তান স্বামী মহেশ্বরানন্দ তাঁর কাছ থেকে গৈরিক ধারণ করে সংসার ত্যাগ করতে না করতেই তার নিজের মা এসে মা সারদার কাছে প্রার্থনা করে যে তার ছেলে যেন সংসারে ফিরে আসে। সেই মহিলা শ্রীমার কাছে কাতর হয়ে কাঁদল, এমনকি, অনুযোগও করল। কারণ তার এই ছেলের উপরই একমাত্র ভরসা। সে ভালো রোজগার করে, তার অল্পবয়সী স্ত্রী ও সন্তান আছে। তার উপরই সকলের জীবন নির্ভর করে। মা সারদা সবই শুনলেন ও তাকে সহানুভূতি জানালেন। কিন্তু নবীন সন্ন্যাসীকে আবার গৃহী করার কথায় সায় দিলেন না। তিনি দৃঢ় গলায় বললেন, ‘সে তো ভাল পথেই গিয়েছে। তোমাদের থাকা, খাওয়ার ব্যবস্থা করে গেছে, তোমাদের দেখবারও লোক আছে, শুনেছি। কাজেই তাকে আবার ঘরে ফিরে যাবার কথা বলতে পারব না’।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৮৯: মাথার কান

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৪৫: বহু আলাস্কাবাসীর ব্যক্তিগত বিমান বা হেলিকপ্টার রয়েছে!

ছেলের মা তার সন্ন্যাসী ছেলেকে ঘরে ফেরাতে পারল না বটে, তবে সে শ্রীমার কাছ থেকে স্নেহ ও আশীর্বাদ পেল। তার মনও ঠাণ্ডা হল আর খুব আশা, ভরসা নিয়েই সে ফিরে গেল। সন্ন্যাস নিলেও শ্রীমার ইচ্ছায় স্বামী মহেশ্বরানন্দ যতদিন তাঁর মা জীবিত ছিলেন, তার সুখস্বাচ্ছন্দ্যের খেয়াল রাখতেন আর মার প্রতি শ্রদ্ধাভক্তির সম্পর্ক রাখতেন। শ্রীমার অন্য এক ভক্ত স্বামী জগদানন্দ সুশিক্ষিত, সদ্বংশজাত এবং ভাল চাকরি করেন। সে বিবাহিত, ঘরে তার যুবতী স্ত্রী প্রথম সন্তানসম্ভবা। দুজনেই শ্রীমার কৃপা লাভ করেছে। ছেলেটির সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাসী হবার ইচ্ছা প্রবল হওয়ায় সে চাকরি ছেড়ে দিয়ে জয়রামবাটি এসে হাজির হল। মা সারদার কাছে তাঁর মনের ইচ্ছা জানিয়েই তিনি নবাসনের আশ্রমে শুভদিনের অপেক্ষায় থাকতে লাগলেন।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪৪: আনন্দী—এক লড়াইয়ের নাম

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫১: সেই ‘পৃথিবী আমারে চায়’

শ্রীমার নিকট আগত বয়স্ক গৃহস্থেরা কেউ কেউ আপত্তি জানিয়ে বললেন, ‘এইরকম ব্যক্তির সন্ন্যাস নেওয়া অনুচিত’। শুধু তাই নয়, তাঁরা শ্রীমার কাছে প্রার্থনা জানালেন যে তাঁকে যেন সন্ন্যাসদীক্ষা না দেওয়া হয়। তাঁরা সকলে প্রস্তাব দিলেন যে, উনি যে উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার কাজ করতেন, তা এখানেই জোগাড় করে দেওয়া হবে। সেই কাজের মধ্য দিয়েই বহু ছেলে মানুষ হবে, সমাজের ও দেশের উপকার হবে। তাঁর বাড়িতে স্ত্রীর ভরণপোষণের জন্য টাকা পাঠিয়ে দেওয়া হবে আর তাঁর ঘরে ফেরার দরকার নেই। কিন্তু তাঁর সন্ন্যাসগ্রহণ নিয়ে আন্দোলন চলল… এইরকম লোককে সন্ন্যাস দিলে সমাজের ভাল না হয়ে খারাপ হবে, এই কাজ করা উচিত নয়, বাধা দেওয়ায়ই কর্তব্য…এই জাতীয় কথাবার্তা চলতেই থাকল।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৬৪ : অকারণে কেউ অন্যের ভালো করতে যায় না

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৭১: মা সারদার নলিনীর মানভঞ্জন

এদিকে এই সব কথা শ্রীমার কানে যেতেই তাঁর ভক্তের জন্য ভীষণ উদ্বেগ বাড়ল। তিনি নিরুপায় হয়ে ঠাকুরের চরণে প্রার্থনা করতে লাগলেন। আর সেই নির্জন আশ্রমের পর্ণকুটিরে আশা ও নিরাশার দ্বন্দ্বে ভক্তের দিন কাটছিল। মাঝে মাঝে সেই আশ্রমের স্বামী জ্ঞানানন্দ যিনি প্রায়ই শ্রীমার বাড়িতে যাতায়াত করেন, তাঁর কাছে ভক্তটি নিজের ইচ্ছার কথা জানান। আর শ্রীমার কাছে তাঁর জন্য প্রার্থনা করতে বলেন। এদিকে শ্রীমা কয়েকদিন শুনলেন কিন্তু কিছু বললেন না। যখন ভক্ত জগদানন্দের জন্য আন্দোলন থেমে গিয়ে সব চুপ করে গেল। তখন একদিন তিনি স্বামী জ্ঞানানন্দকে দিয়ে ভক্তকে ডেকে পাঠালেন আসার জন্য। জগদানন্দ উৎকণ্ঠা নিয়ে এলেন, কি হয় না হয় ভেবে। স্নেহময়ী মা সারদা ভক্তের মনের ইচ্ছা অপূর্ণ রাখলেন না। নিজহাতে তাঁকে গেরুয়া দিয়ে সন্ন্যাসী সাজালেন। এই মহাভাগ্যবান স্বামী বহুজন হিতায় বহুজন সুখায় সুদীর্ঘ জীবনে ঠাকুর ও মা সারদার মহিমা প্রচার করেছিলেন অনেক জিজ্ঞাসু মানুষের কাছে। অনেক তাপিত প্রাণকে শীতল করেছিলেন।

জয়রামবাটিতে এইভাবে শ্রীমা তাঁর বহু গৃহী ভক্তকে নিজহাতে গেরুয়া দিয়ে সন্ন্যাসী করেছেন দেখে মেয়েদের মনে আতঙ্ক ও শোকের সঞ্চার হয়। শ্রীমা আনন্দিত মনে হাসেন তা দেখে যে, তাঁর একটি সন্তান সংসারের দারুণ জ্বালা থেকে রেহাই পেল। তবে সংসারী ছেলেদের রোজগার করা, বিয়ে করা ও গার্হস্থ্য জীবনযাপনেও তিনি নিরুৎসাহী ছিলেন না। কিন্তু তাঁর ত্যাগী সন্তানদের ত্যাগের পথও দেখিয়ে দিতেন পরম আনন্দে।—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।

Skip to content