মা সারদা।
ভানুপিসির সঙ্গে শ্রীমার ভক্তদের স্নেহের সম্পর্ক ছিল। ছেলেদের তিনি তাঁর ‘লাতি’ অর্থাৎ নাতি বলতেন। স্বামী সারদেশানন্দের সঙ্গে তাঁর খুব ভাব ছিল। তাঁকে ভানুপিসি গোপনে বলেন যে মা সারদার ভক্ত ছেলেরা তাঁর পায়ের চিহ্ন নিয়ে রাখে। সারদেশানন্দ তাই শুনে শ্রীমার সম্মতি চান এবং শ্রীমা তাঁকে অনুমতি দেন। কয়েকদিন বাদে তিনি এক শিশি লাল রঙ আর কিছু সাদা রুমাল নিয়ে এসে শ্রীমাকে নিবেদন করেন। সেই সময় বড়দিনের ছুটি এসে গেছে। মা সারদা তাই বললেন, ‘বাবা, বড়দিনের ছুটিতে অনেক ভক্ত আসবে, তারা পায়ে রং দেখে কি মনে করবে। এ সব এখন আমার কাছে রেখে দাও। পরে সুবিধামতো আমি ছাপ তুলে দেব’।
এরপর তিনি মৃদুহেসে আপনমনে বলে উঠলেন, ‘ছেলেরা প্রণাম করতে এসে পায়ের দিকে দেখে ভাববে, মা আলতা পরেছেন’। সারদেশানন্দ শ্রীমার নির্দেশ পালন করে নিশ্চিন্ত হলেন। বেশ কিছু সময় পেরিয়ে গিয়েছে, ওই বিষয়ে আর খেয়াল নেই। একদিন দুপুরে এসে প্রসাদ গ্রহণ করে বিকেলে শ্রীমাকে প্রণাম করে যখন তাঁর ভক্ত মহারাজ ফিরে যাচ্ছেন, তখন তিনি কিছুটা যাবার পর দেখেন, শ্রীমা প্রসন্নমামার বাড়ি থেকে বেরিয়ে তার পিছনে আসছেন। তখন শ্রীমা সেখানে থাকতেন। ভক্ত মনে করলেন যে, শ্রীমা ঘাটে যাবেন হয়তো। তাই শ্রীমার দিকে ফিরে পাশ কাটিয়ে দাঁড়ালেন। সেখানে সদর দরজার আড়ালে লোকজন না থাকায় শ্রীমা সহাস্যে স্নেহভরে কাপড়ের নিচে থেকে একটি প্যাকেট বের করে তার হাতে দিয়ে মৃদুস্বরে বললেন, ‘বাবা, নাও গো তোমার জিনিস’।
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৬৯: শ্রীমার সন্তানস্নেহ
গল্পবৃক্ষ, পর্ব-৩: ভাবিয়া করিও কাজ
শুনে ভক্তের বুক ধরাস করে উঠল, তিনি বুঝতেই পারেননি শ্রীমা কি দিলেন! প্যাকেট খুলে অবাক হয়ে দেখলেন যে, তাঁর সেই কাঙ্ক্ষিত জিনিস, শ্রীমার পবিত্র রাঙা পদচিহ্ন। তিনি অতি আনন্দে পদচিহ্নটি তাঁর বুকে জড়িয়ে ধরলেন। শ্রীমাকে প্রণাম করলেন, আর মা সারদা হাসিমুখে তাঁকে আশীর্বাদ করে ঘরে ফিরে গেলেন। সেই সময় শ্রীমার কাছে অনেকে ছিলেন, তাই তিনি সকলের সামনে দেননি। গোপনে নিজের ছেলের হাতে তার প্রিয় জিনিস তুলে দিলেন। ভক্ত পরে জেনেছেন যে, নলিনীদিকে দিয়ে শ্রীমা তাঁর পায়ের ছাপ তুলিয়েছেন।
আরও পড়ুন:
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৬২: মঠ-মন্দির তৈরি করার চিন্তা বেশি করলে প্রকৃত ধর্মচর্চা থেকে মানুষ দূরে চলে যায়
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৮৬: সুযোগ্য প্রশাসকের মৃত্যুর অভিঘাত
নলিনীদিদি ভক্তকে মুখ ঝামটা দিয়ে একদিন বলেন, ‘কি রঙ এনেছিলেন? খুন-খারাবি, লোকে কি বলত! তাই দেখে আলতা দিয়ে রং করা হয়েছে’। শ্রীমার ছেলে মায়ের চরণচিহ্ন পেয়ে উল্লসিত, তাই দিদির ভর্ৎসনাও তাঁর কাছে এখন মিঠে লাগল। তাঁর মন গেয়ে উঠল, ‘আর ভুলালে ভুলব না মা, হেরেছি ওই চরণ রাঙা’। মা সারদার হাতের তল রক্তাভ ছিল। তা অনেকেই দেখার সুযোগ পেয়েছেন। তাঁর পদতলেও লাল স্থলপদ্মের মতো আভা ছিল। যখন তিনি সুস্থ ছিলেন, তখন কারো কারো ভাগ্যে সেই দর্শন মিলেছে, তারা ধন্য হয়েছেন। তাঁর মাথার সুদীর্ঘ ঘন কালো চুল ছিল উজ্জ্বল, মসৃণ, রেশমি সুতোর মতো সূক্ষ্ম। চুলের সামনের দিক কিছুটা কুঞ্চিত ছিল। তাঁর সুগঠিত মুখমণ্ডলে দীর্ঘ নাসিকা ছিল আগার দিকে যেন ফুলের মতো। তাঁর স্থির প্রশান্ত দৃষ্টিতে সকলের প্রতি ছিল করুণা।
আরও পড়ুন:
সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭১: সুন্দরবনের পাখি: সবুজ বক
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫১: সেই ‘পৃথিবী আমারে চায়’
শ্রীমার প্রসন্ন মুখ ও প্রশস্ত উজ্জ্বল কপাল যদি কেউ দেখতে পেত, তার মন শান্তিতে ভরে যেত। শ্রীমার শ্যামল-গৌর বর্ণ অল্পবয়সে উজ্জ্বল ছিল। শেষবয়সে তা ম্লান হয়ে আসে। দীর্ঘাঙ্গী শ্রীমার হাত ও পদযুগলও অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ ছিল। একটু বাঁদিকে হেলে তিনি ধীরগতিতে চলতেন। তাঁর পায়ে ও হাঁটুতে শ্রমের ফলে বাত ধরে। তাঁর অবিবাহিত খুড়োর সবসময় চিন্তা লেগে থাকত, ভক্তেরা যখন শ্রীমার পায়ে মাথা ঠেকাত, তখন তাঁর স্নেহের পুতলীর পায়ের ব্যথা না বাড়ে, ভাবনা হত। এই খুড়োর দেহরক্ষার পর শ্রীমা খুব শোকাচ্ছন্ন হয়ে বিলাপ করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে শ্রীমার ভক্তসংখ্যার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে অনেক উপদ্রবও সহ্য করতে হয়েছে।
আরও পড়ুন:
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪২: যোগমায়া দেবী—এক প্রতিবাদী নারী
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ
স্বামীজি শ্রীমার কষ্ট বুঝতেন, তাই তাঁর পা ছুঁয়ে নিজে কখনও প্রণাম করতেন না, অন্যদেরও তাঁকে স্পর্শ করতে নিষেধ করতেন। অনেকে ভক্তির আতিশয্যে শ্রীমার পায়ে লুটিয়ে পড়তেন। শ্রীমার তাতে কষ্ট হত। অনেকে আবার সাবধান হত, কথা শুনত। মা সারদা মানবীয় শরীরে মানবী ছিলেন ও লৌকিক নিয়ম মেনে চলতেন। তাই কোনো ভক্ত তাঁর পায়ে তুলসী ও বেলপাতা দিতে চাইলে তিনি আন্তরিকভাবে নিষেধ করতেন। এই ব্যাপারে শ্রীমা যখন উদ্বোধনে থাকতেন, তখন গোলাপমা সদা দৃষ্টি রাখতেন যাতে শ্রীমাকে কেউ উপদ্রব না করে। তিনি যখন জয়রামবাটিতে থাকতেন, তখন তাঁর সেবক ও সেবিকাদেরও সতর্ক থাকতে হত। শ্রীমার ভক্তদের বিষয়ে অনেকেই বলতেন, ‘অবোধ সন্তান তরে কত না যাতনা সহিলে হে জননি, নরদেহ ধরি’। মা সারদার এই সহনশীলতাই তাঁকে জগজ্জননী করেছে।—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।