মা সারদা।
অপরের দুঃখে মা সারদার প্রাণ কেঁদে উঠত। এমনই তাঁর কোমল মাতৃহৃদয়। পুলিশের হাতে যখন স্বতন্ত্রসংগ্রামীর গর্ভবতী স্ত্রী সিন্ধুবালার লাঞ্ছনার খবর তিনি পান, তখন তাঁর মন অধীর হয়ে ওঠে। তিনি চোখের জল ফেলেন। ইংরেজ শাসনের অবসান কামনা করেন। আর যে সকল দেশবাসী এই অত্যাচারের প্রতিরোধ করেন, তাদের উদ্যম প্রশংসনীয় বলে শ্রীমা মত প্রকাশ করেন।
শ্রীমা তাঁর বাল্যকাল থেকে আর্থিক শোষণে দেশের দুর্দশা দেখেছেন। মানুষ এর বিরোধ করলে নিপীড়নের কথা নিজকর্ণে শুনেছেন। তাই ইংরেজের শাসনের অবসান চেয়েছেন। তাদের প্রতি শ্রীমার কোনও বিদ্বেষভাব ছিল না। শ্রীমার সন্তানসম লাবণ্যকুমার চক্রবর্তী তার নিজের লেখা গ্রন্থ ‘ধ্রুবচরিত’ তাঁকে পাঠান। বইটি পেয়ে শ্রীমা খুশি হলেন এবং সেটি শোনার ইচ্ছা প্রকাশ করলে একদিন সন্ধ্যার পর সেটি শোনাবার আয়োজন করা হল।
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৬৫: মা সারদার পুনরায় কাশীযাত্রা
সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬৭: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— রামবাণ ও পানি তাঙ্কি
শ্রীমা বারান্দায় মাদুর বিছিয়ে ‘ধ্রুবচরিত’ শুনতে বসলেন। তাঁর সঙ্গে বাড়ির আরও মেয়ে-বউরাও বসলেন। একটা ছেলে খানিক দূরের আলাদা আসনে বসে পাঠ করতে লাগল। সকলে আনন্দের সঙ্গে শুনতে লাগলেন। চরিতের গল্পে সেই অংশের বর্ণনা চলছে, যখন রাজা উত্তানপাদ তাঁর প্রিয় দ্বিতীয়া পত্নী সুরুচির ছেলেকে নিজ কোলে নিয়ে বসেছেন। আর তাই দেখে প্রথমা পত্নী সুনীতির ছেলে ধ্রুবও তার পিতার কোলে বসার জন্য এগিয়ে এল।
আরও পড়ুন:
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৯: শাসক বেকায়দায় পড়লেই প্রতিপক্ষকে সন্ধির প্রতিশ্রুতি দেয়, যদিও রাজনীতিতে সে সব মানা হয় না
পর্দার আড়ালে, পর্ব-৬২: সত্যজিৎ রায় রুপটান শিল্পীকে বলেছিলেন, উত্তমকুমারের কোনও মেকআপ করার
সুরুচি ধ্রুবকে তিরস্কার করে বলল, ‘দুঃসাহসী বালক, যদি পিতার কোলে ওঠার সাধ হয়, তবে আবার সুরুচির গর্ভে এসে জন্ম নাও’। সুরুচির বশীভূত রাজা তার স্ত্রীর ভয়ে ধ্রুবকে কোলে বসানোর সাহস করল না। ধ্রুব ছোট শিশু, দুঃখে কাঁদতে লাগল। এই ঘটনায় বালকের দুঃখিনী মা সুনীতিও কাঁদতে লাগল। তার যে কিছু করার ছিল না। শ্রীমাও শান্তভাবে তাঁর চোখ মুছলেন। আবার পড়া শুরু হল। এ বারও দুঃখের কথা। পাঁচবছরের বালক ধ্রুব জগতের পিতা শ্রীহরিকে তপস্যা করে তুষ্ট করার জন্য গহন বনে যেতে উদ্যত হল।
আরও পড়ুন:
বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩
মুভি রিভিউ: মামুটির মাল্টিস্টারার ছবি ‘সিবিআই ৫: দ্য ব্রেন’ গতানুগতিক থ্রিলার
সুনীতি তার একমাত্র পুত্রের জন্য গভীর উৎকণ্ঠা নিয়ে দিন যাপন করতে লাগল। ছেলে মাকে ছেড়ে বনে যাবে, সুনীতি তাকে অনেক বুঝিয়েও নিরস্ত করতে পারল না। সুনীতির দুঃখে শ্রীমায়ের কোমল মাতৃহৃদয় বিগলিত হয়ে উঠল। তিনিই স্বয়ং যেন সুনীতি, ছেলের বিচ্ছেদ বেদনায় এমনভাবে কেঁদে ভাসালেন। খানিক পরে তিনি সুস্থির হলে আবার পড়া আরম্ভ হল। ধ্রুব একা বনের পথে বেরল। আর শুনে শ্রীমার চোখের জল ঝরতে লাগল।
তবে দুর্গম বনের মধ্যে নারায়ণের কৃপায় যখন ধ্রুব নানাভাবে সহায়তা লাভ করতে লাগল, তখন শ্রীমা আবার উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন। তাঁর মুখের হাসি ফিরে এলো। এর পর দেবর্ষি নারদের আবির্ভাব ঘটে। তাঁর সদুপদেশ ও গুরুমন্ত্র ওঁ নমো ভগবতে বাসুদেবায় দানের কথা শুনে মা সারদা আরও খুশি হয়ে সকলকে বললেন, ‘দ্যাখো দ্যাখো ভগবানের করুণা। তাঁকে যারা চায়, তিনি তাদের কেমন সাহায্য করেন’।
তবে দুর্গম বনের মধ্যে নারায়ণের কৃপায় যখন ধ্রুব নানাভাবে সহায়তা লাভ করতে লাগল, তখন শ্রীমা আবার উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন। তাঁর মুখের হাসি ফিরে এলো। এর পর দেবর্ষি নারদের আবির্ভাব ঘটে। তাঁর সদুপদেশ ও গুরুমন্ত্র ওঁ নমো ভগবতে বাসুদেবায় দানের কথা শুনে মা সারদা আরও খুশি হয়ে সকলকে বললেন, ‘দ্যাখো দ্যাখো ভগবানের করুণা। তাঁকে যারা চায়, তিনি তাদের কেমন সাহায্য করেন’।
আরও পড়ুন:
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৮১: তথাকথিত পরিচয়হীন প্রতিভার মূল্যায়ন কী শুধুই সাফল্যের নিরিখে সম্ভব?
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ
এ বার ধ্রুবের কঠোর তপের কথা পড়া হচ্ছে। দুর্গম শ্বাপদপূর্ণ বনে নানারকমের ভয়ের বর্ণনা। বালক ধ্রুবের মন ভয়ে কাঁপছে। সে নিরুপায় একা অসহায় হয়ে কাঁদছে। সেই হৃদয়বিদারী ঘটনার বিবরণ শুনেই শ্রীমায়ের মন আবার দ্রবীভূত হল। ধ্রুব যেন তাঁর নিজ কোলের সন্তান, এমনভাবে কেঁদে ভাসাতে লাগলেন। তারপর অনেক চেষ্টা করে শ্রীমা নিজেকে সংযত করলেন।
আবার পড়া শুরু হল। কিছুক্ষণ পরেই শ্রীমা ধ্রুবকে স্মরণ করে আকুল হয়ে আবার কাঁদতে লাগলেন। ক্রমশ তিনি এতটাই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন যে তাঁর মনপ্রাণ যেন সেই গভীর জঙ্গলে ধ্রুবকে রক্ষা করার জন্য ছুটে চলেছে। বাকি শ্রোতারা শ্রীমার এই শোকোচ্ছ্বাস দেখে নীরবে চুপিসারে সবাই উঠে গেলেন। গ্রন্থটি আর পড়া হল না। সকলের হৃদয়ই তখন যেন শোকাচ্ছন্ন। মা সারদার শোক সকলের মনেই সংক্রামিত হল।—চলবে।
আবার পড়া শুরু হল। কিছুক্ষণ পরেই শ্রীমা ধ্রুবকে স্মরণ করে আকুল হয়ে আবার কাঁদতে লাগলেন। ক্রমশ তিনি এতটাই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন যে তাঁর মনপ্রাণ যেন সেই গভীর জঙ্গলে ধ্রুবকে রক্ষা করার জন্য ছুটে চলেছে। বাকি শ্রোতারা শ্রীমার এই শোকোচ্ছ্বাস দেখে নীরবে চুপিসারে সবাই উঠে গেলেন। গ্রন্থটি আর পড়া হল না। সকলের হৃদয়ই তখন যেন শোকাচ্ছন্ন। মা সারদার শোক সকলের মনেই সংক্রামিত হল।—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।