মঙ্গলবার ৩ জুন, ২০২৫


মা সারদা।

১৩১৮ সালের চৌঠা ভাদ্র শশীমহারাজ রামকৃষ্ণলোকে গমন করেন। মাদ্রাজে ঠাকুরের ভাব প্রচারের কাজে অতিরিক্ত পরিশ্রমের ফলে তাঁর শরীর ভেঙে পড়ে। চিকিৎসার জন্য তাঁকে কলকাতায় শ্রীমার বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। দেহরক্ষার আগে তিনি শ্রীমাকে দেখার জন্য ব্যাকুল হন। মা সারদাকে আনার জন্য জয়রামবাটিতে লোক পাঠানো হয়। তবে শ্রীমা আসতে সম্মত হননি। তিনি অন্তর্যামী, আগেই বিচ্ছেদ হবে জেনে আর যেতে চাননি।
শশীমহারাজ কিন্তু মৃত্যুর পূর্বে ‘মা এসেচেন’ এই কথা বলে মহাসমাধি প্রাপ্ত হন। তাঁর দেহত্যাগের খবরে শ্রীমা গভীর দুঃখে কাতর হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, ‘শশী, আমার কোমর ভেঙে দিয়ে গেছে’। এর তিনমাস পর আটই অঘ্রান শ্রীমা কলকাতায় আসেন। এই সময়ে মঠে বাবুরাম মহারাজ দুর্গোৎসবের আয়োজন করেন। শ্রীমা দেবীর বোধন হয়ে যাওয়ার পর মঠে এসে একাদশী পর্যন্ত থাকেন। মহাষ্টমীর রাতে গিরীশ ঘোষের ‘জনা’ নাটক অভিনীত হয়। আর বিজয়াদশমীতে রাতে ‘রামাশ্বমেধযজ্ঞ’ যাত্রা দেখানো হয়। মা সারদা দুটি অভিনয়ই দোতলায় বসে দেখেছিলেন।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৬৩: বেলুড়মঠে শ্রীমায়ের অভিনন্দন

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩৯: ভারতের বিপ্লবী মেয়েরা এবং অন্তরে রবীন্দ্রনাথ

ঠাকুরের পার্ষদগণ শ্রীমাকেই সাক্ষাৎ জগদম্বা জ্ঞানে তাঁরই অর্চনা করতেন। একবার মহাষ্টমীর দিন মহারাজ ১০৮টি পদ্মফুল দিয়ে মা সারদার পুজো করেন। ১৩১৯ সালের দুর্গাপুজো নিয়ে লাবণ্যকুমার চক্রবর্তী লিখেছেন, “ষষ্ঠীর দিন মঠের ফটকে শ্রীমাতাঠাকুরাণীর গাড়ি এসে থামল। ঘোড়া ছেড়ে দিয়ে প্রেমানন্দস্বামী ও ঠাকুরের ভক্তরা গাড়ি টেনে মঠের প্রাঙ্গণে নিয়ে আসেন। আনন্দে বাবুরাম মহারাজের চোখ যেন ফেটে যাচ্ছে”।

মহানবমীর দিন দুপুরবেলার পর গোলাপমা এসে বললেন, ‘শরৎ, মাঠাকুরণ, তোমাদের সেবায় খুব খুশি, তোমাদের তাঁর আশীর্বাদ জানাচ্ছেন। ‘শরৎ মহারাজ আনন্দে গম্ভীরভাবে বলেন, বটে এবং পাশে উপবিষ্ট বাবুরাম মহারাজের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বাবুরাম শুনলে?’ দু’জনে তখন কোলাকুলি করতে লাগলেন আনন্দে। ১৩২৩-এ আবার মঠে ঘটা করে দুর্গাপুজো হয়। সেবারের পুজোয় প্রণবানন্দ ব্রহ্মচারী পুজারী ও জগদানন্দ তন্ত্রধারক হন।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৯: শাসক বেকায়দায় পড়লেই প্রতিপক্ষকে সন্ধির প্রতিশ্রুতি দেয়, যদিও রাজনীতিতে সে সব মানা হয় না

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৫২: পুলক রাখিতে নারি (কেল)

প্রণবানন্দ লিখেছেন, “মহাসপ্তমীর দিন ভোরবেলায় চণ্ডীমণ্ডপে নবপত্রিকা প্রবেশের পর শ্রীমা গাড়ি করে মঠে আসেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন যোগীনমা, গোলাপমা, সুধীরাদেবী। মঠের প্রবেশদ্বার থেকে চণ্ডীমণ্ডপ পর্যন্ত সমস্তপথ ফুল ও পাতায় সাজানো হয়েছিল। বাবুরাম মহারাজ শ্রীমাকে সাদরে আহ্বান করে ভেতরে নিয়ে যান। তখন ধূপধুনোর গন্ধে, শাঁখ, ঘণ্টা, ঢাকঢোল, কাঁসরের ধ্বনিতে ‘মহামাঈ কী জয়’ রবে গঙ্গাতীর মুখরিত হয়ে ওঠে। শ্রীমা ঠাকুরঘরের সিঁড়ির কাছে এলে শুকুলমহারাজ তাঁকে পঞ্চপ্রদীপে আরতি করেন ও বাবুরাম মহারাজ চামর ব্যজন করেন। কিছুক্ষণ ঠাকুরঘরে থেকে শ্রীমা নীচে নেমে এলেন। আর চণ্ডীমণ্ডপে প্রবেশ করে তাঁর জন্য রাখা গালিচার আসনে বসলেন।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬৬: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—ছাগল ক্ষুরি ও ধানি ঘাস

প্রণবানন্দ লিখেছেন, তার তখন অল্পবয়স। আনন্দে আত্মহারা হয়ে কি করবেন বুঝতে পারলেন না। অন্তর্যামী শ্রীমাই যেন প্রাণে প্রাণে বলে দিলেন যা করতে হবে। আর তিনি যন্ত্রের মতো তাই করতে বসলেন। উৎকৃষ্ট জবা, গোলাপ, পদ্ম, অপরাজিতা ফুল ও বেলপাতা চন্দনলিপ্ত করে শ্রীমার চরণে তিনবার অঞ্জলি দিলেন ও হাঁটু গেড়ে বসে রেকাবিতে রাখা ছোট একখানি নৈবেদ্য নিয়ে তাঁর সামনে ধরলেন। শ্রীমা তখন ভাবাবিষ্ট হয়ে অর্ধনিমীলিত চোখে বসেছিলেন। প্রণবানন্দ মহারাজেরও তখন কথা বলার সামর্থ্য ছিল না। শ্রীমা সেই নৈবেদ্য থেকে চিনি নিয়ে নিজের মাথায় ঠেকিয়ে মুখে দিলেন।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৮২: খটকা

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

প্রণবানন্দ অশ্রুসজল হয়ে শ্রীমার চরণে প্রণত হলে তিনি তাঁর বাঁহাতের কোমল স্পর্শে প্রণবানন্দকে আশীর্বাদ করেন। সপ্তমীর পুজো শেষ হলে মহিলা ভক্তদের নিয়ে শ্রীমা আবার চণ্ডীমণ্ডপে আসেন। আর অঞ্জলি দেবেন বলে প্রণবানন্দকে মন্ত্র পড়তে আদেশ করেন”। প্রণবানন্দ, তাঁর কণ্ঠে শ্রীশ্রীচণ্ডীর এই শ্লোকটি সুস্পষ্টভাবে আবৃত্তি করেন-ওঁ জয়ন্তী মঙ্গলা কালী ভদ্রকালী কপালিনী।

দুর্গা শিবা ক্ষমা ধাত্রী স্বাহা স্বধা নমোঽস্তু তে।। স্বামী স্বরূপানন্দ সেবার মঠে পুজো দেখতে যান। শ্রীমা মঠের উত্তরে পাশের বাগানবাড়িতে আছেন। কিছুক্ষণ পর কৃষ্ণলাল মহারাজ এসে বাবুরাম মহারাজকে বলেন, ‘ মা বলছেন, রাধুর অসুখের জন্য তাঁকে কলকাতায় নিয়ে যেতে হবে, আপনি গিয়ে একবার বলুন যাতে তিনি থাকেন’। বাবুরাম মহারাজ শুনে হাতজোড় করে বললেন, ‘মহামায়াকে কে বাবা নিষেধ করতে যাবে, তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কে কি করবে? তাঁর যা ইচ্ছা,তা তিনি করবেন’। পরে দেখা গেল যে, রাধু অনেকটা ভাল আছে, শ্রীমারও যাওয়া হল না।—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।

Skip to content