রামকৃষ্ণ ও মা সারদা।
রামেশ্বর মন্দির থেকে চোদ্দ-পনের মাইল দূরে এই দ্বীপের শেষ প্রান্তে প্রসিদ্ধ তীর্থ হল ধনুস্তীর্থ বা ধনুষ্কোটি। এখানে সোনা বা রূপোর তীরধনুক দিয়ে সমুদ্রের পুজো দিতে হয়। শ্রীমা আশুতোষ মিত্র ও কৃষ্ণলাল মহারাজের মাধ্যমে সেখানে রূপোর তীরধনুক পাঠান। রামনাদের রাজা ভাস্কর সেতুপতি আর তাঁর উত্তরাধিকারী স্বামীজি যখন মাদ্রাজে যান, সম্ভবত তখন তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। রাজা তার করেছিলেন যে, গুরুর গুরু পরমগুরু যাচ্ছেন, সব ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য। মা সারদাকে রাজার মণিকোঠা খুলে দেখানো হয়েছিল।
শ্রীমা বলেছেন, ‘সেখানে সামান্য আলো জ্বলচে, গোটা ঘরটা ঝকঝক কচ্চে’। রাজার নির্দেশ ছিল যে, মণিকোঠার কোন রত্ন যদি শ্রীমার পছন্দ হয়, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে তা যেন মা সারদাকে উপহার দেওয়া হয়। এর জন্য শ্রীমা বিব্রত বোধ করলেও রাজা বা তাঁর লোকেরা যাতে ক্ষুণ্ণ না হন, তাই বলেন, ‘আমার আর কি প্রয়োজন? আচ্ছা, রাধু যদি কিছু নিতে চায় তো নেবে’। সব দেখে শুনে রাধু বলেছিল, ‘এ আবার কি নেব, আমার পেনসিলটা হারিয়ে গেছে, একটা পেনসিল কিনে দিও’।
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৬১: মা সারদার রামেশ্বরম মন্দির দর্শন
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৭৮: নির্দোষ প্রাণীহত্যা কী সমর্থনযোগ্য?
আসলে রাধুর মনে যাতে বাসনা না জাগে তাই মা সারদা ঠাকুরকে প্রার্থনা জানিয়েছিলেন। এখানে তিন রাত থেকে শ্রীমা ফেরা শুরু করেন। মাদুরাইয়ে একদিন মাত্র থেকে তিনি মাদ্রাজে আসেন। এখানকার মঠে তখন ঠাকুরের জন্মোৎসব অনুষ্ঠিত হয়। বাঙ্গালোর মঠের অধ্যক্ষ তুলসী মহারাজ শ্রীমাকে সেখানকার মঠে নিয়ে যাবার জন্য খুব ব্যগ্র হলে তিনি দশই চৈত্র সেখানে যান। প্রথমে নারায়ণ আয়েঙ্গার সহ অন্য ভক্তেরা তাঁকে নিতে আসেন, তখন শ্রীমা যেতে চাননি। তাঁরা ফিরে যাওয়ায় তুলসী মহারাজ নিজে আসেন। নানা সময়ে ঢাকা, রাঁচি ও চন্দ্রকোণার ভক্তেরাও শ্রীমাকে নিয়ে যাবার ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন।
আরও পড়ুন:
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬৪: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—গিরা শাক ও যদু পালং
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৬:কোনও একটি দাবিতে বিরোধীরা জোট বাঁধুক কখনও চায় না শাসক
চন্দ্রকোণার নলিনবাবুকে মা সারদা স্পষ্টভাবে বলেছিলেন, ‘আমাকে কেউ কি নিয়ে যেতে পারে, বাবা? নিয়ে যায় তো এক শরৎ’। আত্মানন্দ ছাড়া শ্রীমার সঙ্গে দলের অন্য সকলেই বেঙ্গালুরু গিয়েছিলেন। সেখানে মা সারদা মঠের ভেতর বর্তমান ঠাকুরঘরে তিন রাত্রি থাকেন। ওই তিনদিন শ্রীমার পুরুষভক্তদের থাকার জন্য মাঠে তাঁবু খাটানো হয়েছিল। রোজ দলে দলে লোক শ্রীমাকে প্রণাম করতে আসত। আর তাদের আনা ফুলের পাহাড় জমে যেত। মঠের জমিতে একটা চন্দনগাছ ও ছোট পাহাড় দেখে তিনি উৎফুল্ল হন। ভক্তদের অনুরোধে একদিন শ্রীমা ওই পাহারের পাথরের আসনে বসে সান্ধ্যজপ করেন। এখানে তিনি আয়েঙ্গার সহ আরও কয়েকজনকে মন্ত্রদীক্ষা দেন।
আরও পড়ুন:
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ
গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-৮: যেথা আমি যাই নাকো / তুমি প্রকাশিত থাকো
বেঙ্গালুরুর মঠ থেকে শ্রীমা আবার মাদ্রাজে ফিরে দু’একদিন থেকে কলকাতা রওনা হন। পথে রাজমহেন্দ্রীতে জেলা জজ এম.ও. পার্থসারথি আয়েঙ্গারের অতিথি হয়ে তিনি একদিন থাকেন ও গোদাবরী নদীতে স্নান করেন। বৃদ্ধ আয়েঙ্গার অত্যন্ত জ্ঞানী মানুষ ছিলেন। তিনি সংস্কৃতভাষায় তুলসী মহারাজের সঙ্গে শাস্ত্রালাপ করেছিলেন। এখান থেকে পুরীতে এসে মা সারদা শশী নিকেতনে কিছুদিন ছিলেন। সেইসময় মহারাজা পুরীতে ছিলেন। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট অটলবিহারী মৈত্র মহারাজকে ও অন্য ভক্তদের নিমন্ত্রণ করে বাড়িতে নিয়ে এসে আনন্দোৎসব করেন। এই উৎসবে শ্রীমা ঠাকুরের পুজো করেন।
আরও পড়ুন:
বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩৮: নন্দিতা কৃপালনি— বিশ শতকের বিদুষী
পুরীর বেঙ্গল-নাগপুর রেলপথের তৎকালীন ডাক্তার রতিকান্ত মজুমদার এ বিষয়ে বলেছেন, ‘উৎসবের দিন আমার বড় ছেলের খবর জানার জন্য টেলিগ্রাম করে উত্তরের অপেক্ষায় ছিলাম। কিছুদিন আগেই হাজারিবাগ থেকে তার আসার কথা ছিল। টেলিগ্রামের উত্তরে আরও উদ্বিগ্ন হয়ে প্রসাদ নিতে গেলাম। সবাই আমার বিলম্ব হওয়ার কারণ জানতে চাইল। ঘরের মধ্যে জানলার কাছে দাঁড়িয়ে মা সারদা সব শুনছিলেন। তিনি বললেন, ‘ ছেলে ভাল আছে, ভয় নেই। আজই টেলিগ্রামের উত্তর পাওয়া যাবে’। ঘরে ফেরার পথেই শ্রীমার কথা মতো ছেলের কুশলসংবাদ পেলাম’। এরপর পুরী থেকে মা সারদা আঠাশে চৈত্র মঙ্গলবার কলকাতায় ফিরে আসেন। তুলসী মহারাজও বাঙ্গালোর থেকে কলকাতা পর্যন্ত শ্রীমার সঙ্গে আসেন।—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।