বৃহস্পতিবার ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


মা সারদা।

মাদ্রাজে স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ ও ঠাকুরের মেজভাইয়ের ছেলে রামলাল এসে পৌঁছলেন। নিতাইয়ের মার অসুখ হওয়ায় দেরি হয়ে যাওয়ায় তাকে মাদ্রাজে রেখে সকলে রামেশ্বরমে গেলেন। রাত্রিতে যাত্রা করে ভোরবেলায় সকলে মাদুরাইতে পৌঁছলেন। সেখানকার পৌর প্রতিষ্ঠানের সভাপতি জনৈক মাদ্রাজি ভক্তের আতিথ্য গ্রহণ করলেন সবাই। মাদুরাই বাইগাই নদীর ধারে অবস্থিত ভারতের একটি প্রাচীন শহর। এখানকার মন্দিরের মতো সুন্দর, প্রাচীন ও বৃহৎ মন্দির দক্ষিণ ভারতে আর কোথাও নেই। মন্দিরের মধ্যে সুন্দরেশ্বরস্বামী বা সুন্দর নামে শিবলিঙ্গ ও মীনাক্ষীদেবীর মূর্তি আছে।
মন্দিরের পাশে শিবগঙ্গা নামে তীর্থ সরোবর আছে। শ্রীমা-সহ সকলে অপরাহ্ণে ওই সরোবরে স্নান করে মন্দির দর্শন করেন। মহিলারা সন্ধ্যাকালে দীপ কিনে শিবগঙ্গার তীরে নিজ নিজ নামে রেখে যান। শ্রীমাও নিজের নামে শিবগঙ্গায় দীপদান করেন। আশুতোষ মিত্র বলেছেন, মাদ্রাজে প্রথম নারকেল তেলে রাঁধা খাবার ও একটি নতুন জিনিস ভাতের পাঁপর খাওয়া হয়েছিল। পরদিন দুপুরে গাড়ীতে রওনা দিয়ে অপরাহ্ণে পাম্বানপ্রণালী বা হরবলার খাড়ির তটে যাওয়া হল। এইখানে মণ্ডপম্ স্টেশনে রেলপথ শেষ হওয়ায় সকলে একটি ছোট স্টীমারে দু’মাইল বিস্তৃত খাড়ি পার করে রামেশ্বরদ্বীপে যান।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৬০: শ্রীমার রামেশ্বরম যাত্রা

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৭৭: যাজ্ঞসেনী স্বয়ংবরা দ্রৌপদী কি শুধুই প্রতিহিংসার বাতাবরণ বিনির্মাণ করেন?

আশুতোষবাবুর কথায়, এখন ওই থাড়ির ওপর দিয়ে রেল চলে। কিন্তু তাঁরা যখন যান তখন সেতুর ওপর থামগুলোর কিছু অংশ তৈরি হয়েছে। তাঁরা দ্বীপের যে স্থানে এলেন তাকে পাম্বান বা পবন বন্দর বলে। ওই বন্দর থেকে আবার রেলে করে রামেশ্বর স্টেশনে প্রায় রাত এগারোটায় সকলে পৌঁছান। পাণ্ডা গঙ্গারাম পীতাম্বরের ব্যবস্থায় তাঁরা একটা দোতলা বাড়িতে ওঠেন। সবাই রামেশ্বরম মন্দির দর্শন করেন। এই মন্দিরটি পাথরের তৈরি। কারুকার্যসমৃদ্ধ অতি বিশাল মন্দির। ভিতরে প্রবেশ করলে দেখা যায়, পুবদিকের বারান্দা নৃপতিগণ ও মন্ত্রিগণের পাথরের মৃর্তিতে পরিপূর্ণ।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬৩: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— কেরালি ও নোনা হাতিশুঁড়

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৬:কোনও একটি দাবিতে বিরোধীরা জোট বাঁধুক কখনও চায় না শাসক

মন্দিরে তিনটি মহল আছে। দুটি মহল পার করে তবে রামেশ্বর মহলে প্রবেশ করতে হয়। এই মহলের প্রাঙ্গণে প্রায় একতলা সমান উঁচু প্রস্তরের নন্দীবৃষ আছে। তার কাছে প্রায় তিনতলা সমান উঁচু একটি স্তম্ভ প্রোথিত। রোজ তার পুজো করা হয়। এই মহলের চারদিকে বিশ্বনাথ, কেদারনাথ প্রভৃতির লিঙ্গ পৃথক পৃথক ভাবে অবস্থান করছেন। পাশে আলাদা মহলে দেবী পার্বতীর মূর্তি রয়েছে। আশুতোষবাবু বলেছেন যে, রাতে তাঁরা ধুলোপায়ে রাজপথ থেকেই রামেশ্বরের উদ্দেশ্যে প্রণাম করে ঘরে ফেরেন। পরের দিন সকালে সমুদ্রস্নানের পর অন্যান্য দেবদেবীকে দর্শন করতে করতে শেষে সকলে রামেশ্বরের স্থানে পৌঁছন।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-৮: যেথা আমি যাই নাকো / তুমি প্রকাশিত থাকো

রামেশ্বরের বালুকাময় লিঙ্গ কুণ্ডের মধ্যে অবস্থিত, অতি ক্ষুদ্র। কুণ্ডের উপরভাগ প্রায় আধহাত উঁচু। তা সোনার মুকুটে ঢাকা থাকে ও ওই মুকুটের ওপরই জল চড়ানো হয় আর পুজো করা হয়। প্রাতঃকালে গঙ্গাজলে স্নান করানোর সময় সর্বপ্রথম মুকুটের আবরণ উন্মোচন করা হলে প্রকৃত মূর্তির দেখা পাওয়া যায়। কোন যাত্রী গঙ্গোত্রীর জল চড়াতে চাইলে, রামনাদের রাজার কাছারিতে এক টাকা বার আনা জমা দিয়ে অনুমতিপত্র নিয়ে এলে মন্দিরের পুজারীরা তখন আবরণ সরিয়ে সেই জল বাবার মাথায় ঢেলে দেন। বাবার নিত্যস্নান ও ভোগে গঙ্গাজল ব্যবহার করা হয়। রোজ এই জল সরবরাহের ব্যয় নির্বাহের জন্য পুণ্যশ্লোক ইন্দোরের মহারানি অহল্যাবাঈ হোলকার সুবন্দোবস্ত করে গেছেন। বাবার পুজারীরা সব দক্ষিণী ব্রাহ্মণ। তাঁদের হাত দিয়েই পুজো দিতে হয়। বাবার গৃহে সব যাত্রী প্রবেশ করতে পারে না, কেবল দক্ষিণী ব্রাহ্মণরা প্রবেশ করে থাকেন। এমনকি উত্তরভারতীয় ব্রাহ্মণদেরও প্রবেশাধিকার নেই। তবে মা সারদার কথা আলাদা।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩

দশভুজা, পর্ব-৩৬: মৃণালিনী— রবি ঠাকুরের স্ত্রী-র লেখকসত্তা

রামনাদের রাজার ব্যবস্থাপনায় শ্রীমার সঙ্গে আসা মহিলা ভক্তরাও পর্যন্ত মন্দিরে প্রবেশ করে নিজ হাতে বাবাকে গঙ্গোত্রীর জল ও বেলপাতা দিয়ে পুজো করেছিলেন। পাণ্ডাদের কাছ থেকে পাঁচসিকে তোলা হিসেবে গঙ্গোত্রীর জল কিনতে পাওয়া যায়। আশুতোষবাবু বলেন, ‘আমরা বাবার পুজো ও আরতি দেখলাম’। তৃতীয় দিন মা সারদা বিশেষভাবে বাবাকে পুজো দিলেন। আর পাণ্ডাদের পুঁথিতে লিখিত রামেশ্বরতীর্থের কথা শ্রবণ করে পাণ্ডাভোজন করালেন। প্রত্যেক পাণ্ডাকে একটা করে জলের ঘটি দান করেন। হাতে সুপারি, পান ও পয়সা নিয়ে পুরাণকথা শুনতে হয় এবং শোনার পর ওই সকল জিনিস কথকঠাকুরকে দিয়ে প্রণাম করতে হয়। শ্রীমাও বিধানানুসারে তাই করেছিলেন। রামেশ্বরম দর্শনপ্রসঙ্গে শ্রীমা বলেছিলেন, ‘রামেশ্বরে গেছি, শশী (অর্থাৎ রামকৃষ্ণানন্দ মহারাজ) সব পুজোর ব্যবস্থা করেচে, একশো আট সোনার বেলপাতা আমার জন্য করিয়ে রেখেছে। আমি সেই বেলপাতা দিয়ে পুজো কললুম’।—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।

Skip to content