বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


তরু দত্ত।

সে এক সময়। কালাপানি পার হয়ে বিলেতযাত্রা মানে সে এক কাণ্ড! তার উপর যদি কোনও ভারতীয় মহিলা তাঁর তথাকথিত ‘অবলা’ ইমেজ ভেঙে দুই মেয়েকে নিয়ে বিলেতে পৌঁছে যান, তাহলে তো উনিশ শতকের গোটা সমাজ ছ্যা ছ্যা করে উঠত। কিন্তু বহতা নদীর গতি কে কবে রুখতে পেরেছে বলুন? উনিশ শতকের নারী জাগরণ ওই বহতা নদীরই মতো। কাজেই অন্দরমহলের অবরুদ্ধ দ্বার পেরিয়ে মেয়েরা ডানা মেলল। মুক্ত বিহঙ্গের মতো পাড়ি দিল স্বাধীনতার উড়াল আকাশে। আজ বলব সেই সময়ের এক বহুভাষাবিদ মহিলা কবি তরু দত্তের কথা। কথার টানে আসবে তাঁর মা ক্ষেত্রমোহিনী দেবী আর বোন অরু দত্তের কথা। তাঁরাও ছিলেন বিদুষী নারী। তবে কবি হিসেবে তরু দত্ত একটু বেশিই খ্যাতি পেয়েছিলেন।
সে অনেকদিন আগের কথা। ক্ষেত্রমোহিনী দেবী তাঁর স্বামী ও সন্তানদের সঙ্গে ইউরোপে যান ১৮৬৯ সালের নভেম্বর ডিসেম্বর মাসে। সংস্কার কাটিয়ে বিলেত যাত্রাই তাঁর অন্যতম কৃতিত্ব। তরু দত্তের বাবা গোবিন্দ দত্ত ছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্তের বন্ধু। তাঁর লেখা বই ছিল ‘চেরি স্টোন’ সেই সময় বেশ সমাদৃত হয়েছিল। তরু দত্তের ঠাকুর্দা রসময় দত্ত ছিলেন সেই সময়কার নামজাদা মানুষ। তবে ডিরোজিওকে হিন্দু কলেজ থেকে বিতাড়ন করার গোষ্ঠীর মধ্যে তিনিও ছিলেন। কিন্তু আইরনি অফ ফেট হল তাঁর মৃত্যুর পর নিজের তিন সন্তানই খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করে পাশ্চাত্য জীবনধারা বেছে নিয়েছিলেন।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২২: সরলাদেবী, এক পণ্ডিত মানুষ

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৮: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা: কাঁকড়া, গরান ও গেঁওয়া

গোবিন্দ দত্ত ও তাঁর পরিবার খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেছিলেন বলেই ইংলন্ডে যেতে পেরেছিলেন। প্রথমে তাঁরা গিয়েছিলেন ফ্রান্সের মার্সাই শহরে। তরুর ফরাসী ভাষা শেখা, প্রথম স্কুলে যাওয়া সবই বিলেতে। বিভিন্ন অভিজাত পরিবারের সঙ্গে আলাপ ও ভাব বিনিময় সব বিদেশে। তরু দত্ত কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন আলোচনা শুনতে যেতেন তাঁর দিদি অরু দত্তের সঙ্গে। তাঁদের আগে কোনও ভারতীয় মেয়ে লেখাপড়ার জন্য বিলেত যায়নি। এই দিক থেক তরু দত্ত জীবনে এই অভিনব সুযোগ পেয়েছিলেন, ভারতের মেয়েদের জন্য তখন তা স্বপ্ন ছিল। বাংলা, ইংরেজি, ফরাসী ও সংস্কৃত এই চারটি ভাষা জানতেন তরু দত্ত। তরু দত্ত বিভিন্ন ভাষায় সাহিত্য রচনা শুরু করেন ছোট থেকেই। ফরাসি ভাষায় অনায়াসে লিখে ফেলেন উপন্যাস। বিলেতেও তিনি কবি হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৩: বাবু ডাক্তার ও ‘ডাক্তারবাবু’

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪৫: কথার কথা মা নয়—সত্য জননী

তরু দত্তকে ভারতের কীটস বলা হত। আসলে কীটসের মতোই স্বল্পায়ু আর অসাধারণ কবিত্ব শক্তির অধিকারী। তরু মারা যাওয়ার পর তাঁর বাবা তাঁর লেখার পাণ্ডুলিপি আবিষ্কার করেন। তরু দত্তের মৃত্যুর আগে ১৮৭৬ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা—‘A sheaf Gleaned in French Frields’ পশ। মাইকেল মধুসূদন দত্তের Captive lady ও বিদেশে প্রকাশিত হয়নি। তরু দত্তের ইউরোপ ভ্রমণ তাঁর লেখায় প্রভাব ফেলেছিল।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৮: ছবি আঁকতে আঁকতে অবনীন্দ্রনাথ টান দিতেন গড়গড়ায়, চিবোতেন পান

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬২: ক্রৌঞ্চবধের বিষাদ কী ছেয়ে আছে রামায়ণের প্রেক্ষাপট?

কলকাতায় যখন ফিরেছিলেন তখন তরু দত্ত এবং তাঁর সহোদরা অরু দত্ত দু’ জনেই ভগ্ন স্বাস্থ্য ও যক্ষা রোগাক্রান্ত। বিদেশের বহু বিশিষ্ট মানুষজনের সঙ্গে তাঁর পত্রবিনিময় চলত। তাঁর চিঠিতে সেইসময়কার দৈনন্দিন জীবন, সমাজ, মনস্তত্ত্ব — সব জায়গার বর্ণনা রয়েছে। বলা যায় তরু দত্তের চিঠিগুলো সেই সময়কার দলিল। তরু দত্ত দ্য বেঙ্গল ম্যাগাজিন, দ্য ক্যালকাটা রিভিউ, পোয়েটস কর্নার —এ নিয়মিত লেখালিখি করতেন। তাঁর গবেষণামূলক লেখাগুলিও প্রশংসার দাবি রাখে। অরু দত্তের সঙ্গে বিবিধ সাহিত্যের অনুবাদ, মৌলিক সৃজন করতেন তরু দত্ত। অনেক রাজনৈতিক বক্তৃতার অনুবাদও তাঁরা করেন। তরু দত্তের সাহিত্য প্রতিভার অন্তরালে একটি অভিজাত শিক্ষিত পরিবার — একথা অস্বীকার করার উপায় নেই। উপন্যাস কবিতা ছাড়াও বিভিন্ন ভাষার অনুবাদ নিয়ে প্রকাশিত ‘প্রাচীন ব্যালাডস অ্যান্ড লিজেন্ডস অফ হিন্দুস্থান’ উল্লেখযোগ্য।
আরও পড়ুন:

সেদিন ‘খণ্ডরে’র পুনঃপ্রদর্শন আনন্দ দিয়েছিল বিশ্বের তাবড় সিনেমাপ্রেমী থেকে বরেণ্য সেই পরিচালককে

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩২: কে বলে ঈশ্বর গুপ্ত?

জীবন তরু দত্তকে আনন্দ বিষাদ দুইই দেখিয়েছে। তরু দত্ত নিজেও সেই আনন্দ বিষাদে সমৃদ্ধ হয়েছেন। প্রকাশও করেছেন সাহিত্য রূপে। এত বছর পর তরু দত্তের কথা লিখতে বসে মনে মনে গর্ব হয়। সেই কতকাল আগে এক স্বল্পায়ু মেয়ে হাতে সরস্বতীর লীলাকমল নিয়ে তোলপাড় করে দিয়েছিলেন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য — সে বড় গৌরবের কথা। আজ সেই নারীর প্রতি রইল আমাদের অক্ষরের অঞ্জলি।—চলবে।
* ড. মহুয়া দাশগুপ্ত, শিক্ষক এবং লেখক। রবীন্দ্রনাথের দেবলোক, জোড়াসাঁকোর জার্নাল, আমি নারী আমি মহীয়সী, কথানদীর কূলে, লেডিজ স্পেশাল, পথে পুরুষ বিবর্জিত, পরীক্ষায় আসবে না এবং ভুবনডাঙার বাউল তাঁর লেখা একক বই। বাংলা কথকতা নিয়ে একক ভাবে কাজ করছেন।

Skip to content