শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়।

বাংলায় দীর্ঘদিনের এক প্রচলিত কথা হল ‘ব্যবসায় বসতি লক্ষী’। ব্যবসা যদি সঠিকভাবে বুদ্ধি খাটিয়ে করা যায় অর্থ লাভ হয় পর্যাপ্ত। তার জন্য প্রয়োজন নেই বিরাট কোনও ডিগ্রির এমনই এক ডিগ্রিহীন, দলছুট, ভিন্ন স্থপতিবিদ হলেন রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। যিনি পরবর্তীকালে ইংরেজ সরকার দ্বারা ‘স্যার’ উপাধি পেয়েছিলেন, হয়েছিলেন কলকাতার শেরিফও।
১৮৫৪ সালের ২৩ জুন ২৪ পরগনার এক গন্ডগ্রাম ভ্যাবলাতে জন্মগ্রহণ করেন রাজেন্দ্রনাথ। বাবা ভগবানচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও মা ব্রহ্মময়ী দেবীর সন্তান ছিলেন তিনি। বাবা পেশায় ছিলেন মোক্তার। পিতার চাকুরীস্থল ছিল বারাসতে। মাত্র ছয় বছর বয়সে তিনি পিতৃহারা হন। গ্রামের স্কুলের পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে আসেন বারাসাতে। ভর্তি হন বারাসত গভর্নমেন্ট স্কুলে। পরে সেখানকার পড়া শেষ না করেই চলে যান আগ্রা, মামার কাছে। সেখানে এক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। স্কুলের নাম সেন্ট জন কলেজিয়েট স্কুল। আবার ডাক পড়লো বাড়িতে, বিয়ের জন্য। এর কিছুদিন পর ভবানীপুর মিশনারি সোসাইটি ইনস্টিটিউশন থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন।

১৮৭২ সালে ১৯ বছর বয়সে ভর্তি হলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে, ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার জন্য পড়াশোনা ছাড়তে হয়। পূর্বের ওয়েলিংটন স্কোয়ার, মানে আজকের সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারে এক মেস ভাড়া করে থাকতেন তিনি। টিউশন পড়াতেন, বিষয় ছিল গণিত। ওই মেসে থাকতেন তাঁর সুহৃদ রামব্রম্ভ সান্যাল। তিনি আলিপুর চিড়িয়াখানার অন্যতম কর্মী।
আরও পড়ুন:

জাপানি রেইকি কী? এই থেরাপি কীভাবে রোগ নিরাময় সাহায্য করে?

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৭: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—বাইন ও গর্জন

প্রাত্যহিক জীবনের একঘেয়েমি কাটানোর জন্য রাজেন্দ্রনাথ প্রায়ই চিড়িয়াখানা চলে যেতেন পশুপাখি দেখতে। একদিন ফেরার পথে কলকাতা কর্পোরেশনের চিফ এগজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার ব্র্যাডফোর্ড লেসলি এক ভারতীয় কর্মীকে সেতু তৈরির কাজের নির্দেশ দিয়েছিলেন ইংরেজিতে। কিন্তু বেচারা সেই কর্মীটি কিছুই বুঝতে পারছিলেন না। ‘মিস্টার মুখার্জি’ সেখানে দাঁড়িয়ে শুনছিলেন, তিনি ওই ভারতীয়কে সহজ বাংলা ভাষায় সবকিছু বুঝিয়ে দিলেন। সাহেব খুশি হয়ে তাঁকে অফিসে দেখা করতে বললেন। পরদিন তিনি দেখা করলে তাঁকে কাজ দিলেন সাহেব। শুরু হল এক নতুন জীবন।
আরও পড়ুন:

মহামানবের সাগরতীরে

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪৫: কথার কথা মা নয়—সত্য জননী

কেয়ারটেকার দিয়ে শুরু, শেষ করলেন ভারতের তথা বিশ্বের অন্যতম সেরা ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে। অর্থ, খ্যাতি, সম্মান পেলেন ভুরি ভুরি। সঙ্গে এমন কিছু কৃতিত্ব স্থাপন করলেন যে পরাধীন ভারতের মুখ উজ্জ্বল করলেন তিনি। ১৮৮৩-১৮৮৫ সালে প্রতিষ্ঠা করলেন পলতা জলপ্রকল্প, ১৮৮৮ থেকে ১৮৯২ সালে তৈরি করলেন আগ্রা জলপরিষেবা। পরে এলাহাবাদ জলপ্রকল্পও তাঁর তৈরি। এরপর তৈরি করলেন তাঁর বিখ্যাত মার্টিন কোম্পানি। ভারতের বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে পূর্বভারতে। রাজেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের মাটিন কোম্পানির পাতা বিখ্যাত কয়েকটি লাইন হল—রানাঘাট কৃষ্ণনগর, বারাসাত-বসিরহাট লাইন ও হাওড়া-আমতা শিয়াখালা লাইন। কলকাতা তথা ভারতের গর্ব ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল রাজেন্দ্রনাথ অমর সৃষ্টি।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬২: ক্রৌঞ্চবধের বিষাদ কী ছেয়ে আছে রামায়ণের প্রেক্ষাপট?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৭: কবির জন্মদিনে প্রিয়জনের উপহার

১৯১১ সালে তিনি হলেন কলকাতার শেরিফ। নিজে একজন নেটিভ হয়েও তিনি হয়েছিলেন ইংরেজ সরকার প্রতিষ্ঠিত অর্থ, শ্রম, কয়লা ও রেলওয়ে কমিটির অন্যতম নীতিনির্ধারক। সভাপতি ছিলেন ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেস ও ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ার্সেরও। বিদেশ থেকেও পান অসংখ্য সম্মান, যথা কেসিভিও, কেসিআইই এবং সিআইই। দেশে ব্যবসা এবং শিল্প কাঠামো তৈরিতে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। নিজের হাতে তৈরি করেন বার্নপুর শিল্প শহর। তাঁকে সম্মান দেওয়ার জন্য তার নামে কলকাতায় একটি বড় রাস্তা আছে। আবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সাম্মানিক ডিএসসি (ইঞ্জিনিয়ারিং) উপাধি দেয়। তাঁর বিপুল কর্মধারাই তাঁকে চিরঅমরত্ব দেবে এই আশা রাখি। আগামী ২৩ জুন তাঁর জন্মদিন। আমরা সকল বাঙালি যেন হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে এই মহান মানুষকে স্মরণ করি ওইদিন।
* ড. উৎপল অধিকারী, সহ-শিক্ষক, আঝাপুর হাই স্কুল, আঝাপুর, জামালপুর, পূর্ব বর্ধমান।

Skip to content