রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


মোক্ষদায়িনী।

কথা চলছে মহিলা সাহিত্যিকদের নিয়ে। আজ বলছি নারী সম্পাদিত প্রথম সাময়িক পত্রিকার সম্পাদক মোক্ষদায়িনী মুখোপাধ্যায়ের কথা। নামটি একালে সকলের কাছে সুপরিচিত না হলেও একটা সময় তিনি মহিলা মহলে লেখালিখির ক্ষেত্রে বেশ নামযশ অর্জন করেছিলেন। তিনি ছিলেন ‘বঙ্গমহিলা’ পত্রিকার প্রথম মহিলা সম্পাদক। ১৮৭০ সালের এপ্রিল মাসে মোক্ষদায়িনী দেবী বলেছিলেন, বঙ্গমহিলা কোনও এক সময় মেয়েদের লেখালিখির মুখপাত্র হবে। তিনি নিজে কবি ছিলেন।

মোক্ষদায়িনীর পদ্যসংকলন প্রকাশিত হয় ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে, বনপ্রসূন, ১৮৮৪ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা ঐতিহাসিক উপন্যাস ‘সফল স্বপ্ন’। এছাড়াও ১৩৩৫ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত হয় তাঁর জীবনীগ্রন্থ। সেইসময় মোক্ষদায়িনী মুখোপাধ্যায়ের লেখা কবিতা বেশ বিখ্যাত হয়েছিল। তখনকার দিনে মহিলাদের লেখার প্রশংসা বড় একটা করা হত না। মেয়েদের লেখাপড়ার পাঠসূচিতেও রকমফের ছিল। শুধু গৃহকর্মনিপুণা ও স্বামীকে সঙ্গ দেওয়ার জন্যই মেয়েদের বিদ্যাচর্চার যত আয়োজন — এমনটাই মনে করা হত। তবু মোক্ষদায়িনীর লেখা ভালো হওয়ায় পুরুষ লেখক সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মনে করলেন তাঁর প্রশংসা করা উচিত।
ফলে বঙ্গদর্শনে কবি মোক্ষদায়িনীর প্রশংসা প্রকাশিত হল একটু ঘুরিয়ে—‘মুখোপাধ্যায় মহাশয়ার কবিতাগুলি পড়িয়াআমরা মুক্ত কণ্ঠে বলিতে পারি যে তিনি ক্ষমতাশালিনী বটে। স্ত্রীলোকের কবিতার বেশি প্রশংসা করিতেআমরা ভয় পাই পাছে উৎসাহ দিলে গৃহিনীর দল, গৃহকর্ম ছাড়িয়া সকলেই কাগজকলম লইয়া বসেন। তাহা হইলে গরীব পুরুষের দল একমুঠা অন্ন পাইবে না। অতএব মোক্ষদায়িনী মুখোপাধ্যায় আমাদের মার্জনা করিবেন, আমরা একটু কম করিয়া প্রশংসা করিব।’ এই কথাগুলি রসালাপ হতেই পারে। কিন্তু মহিলা লেখককে সহলেখক ভাবতে অস্বস্তি সর্বকালে সর্বযুগেই সত্য।

মোক্ষদায়িনীর পরিবার ছিল উচ্চশিক্ষিত। ১৮৪৭ সালে তাঁর জন্ম। তাঁর বাবার নাম ছিল গিরীশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, মা সরস্বতী দেবী। স্বামীর নাম শশীকুমার মুখোপাধ্যায়। গিরীশচন্দ্র আর সরস্বতীদেবীর দুই সন্তানই রত্ন। ছেলে উমেশচন্দ্র ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম সভাপতি আর মোক্ষদায়িনী বঙ্গমহিলা পত্রিকার প্রথম সম্পাদক ছিলেন। তবে প্রথমে তাঁর সম্পাদক হিসাবে সরাসরি নাম ছিল না। এইভাবে ছিল— ‘খিদিরপুর নিবাসিনী জনৈক মহিলার সম্পাদনায়’!
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২৬: কুসুমকুমারী দাশ—লক্ষ্মী সরস্বতীর যুগ্ম মূর্তি

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৩: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—খলসি ও করঞ্জা

সেই সময় মেয়েদের সম্পাদনায় মেয়েদের জন্য লেখা এই পত্রিকা সকলের নজর কেড়েছিল। মোক্ষদায়িনীর আন্তরিকতা আর কর্মোদ্যোগ প্রশংসনীয় ছিল। মোক্ষদায়িনী অসীম মনের জোরে লিখে গিয়েছেন। তখন মেয়েদের লেখার কোনও পূর্ব আদর্শ বা পরিকল্পনা ছিল না।

প্রিয়নাথ সেনের মতো ব্যক্তিত্ব মেয়েদের লেখায় কবিত্বের কোনো সুস্থ সুন্দর বিকাশ খুঁজেই পেলেন না। কাঁচাভাষা, অপরিণত ভাব, ভাষার অসংযম— এইগুলিকে মুখ্য করে মহিলা কবিদের নিজেদের তুলনায় খাটো করে দেখানোর ইচ্ছেটুকু প্রবল হয়ে উঠেছিল কুলীন পুরুষ সাহিত্যিকদের বাক্যচয়নে। অথচ হাত পা বেঁধেও যে মন বাঁধা যায় না — সেকথা বুঝতে তাঁদের ভুল হয়ে গিয়েছিল। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিষাক্ত তীরগুলির আঘাত সয়েও মোক্ষদায়িনীর মতো নারীরা কলম ধরতে শুরু করলেন। সামাজিক চাপ তাঁদের লেখার গড়নকে পরিণত না করলেও তাঁদের আবেগ উড়াল ডানা মেলল মনের আকাশে।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৭০: পাভেল কোথায়?

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪৯: রসিক স্বভাব মা সারদা

মোক্ষদায়িনী লেখক হিসাবে তো বটেই সম্পাদক হিসেবেও সমান দক্ষ ছিলেন। মেয়েদের সমস্যা, শিক্ষা, স্বাধীনতা ইত্যাদি বিষয় আলোচনা হত বঙ্গমহিলা পত্রিকায়। পাশ্চাত্ত্য শিক্ষার পরিমণ্ডলেরবড় হলেও সমাজ মোক্ষদায়িনীকে শিখিয়েছিল— ইউরোপীয় ও আমেরিকান মেয়েদের স্বাধীনতা স্বেচ্ছাচারিতা। লেখাপড়া ও নম্রতার যুগ্ম ভারসাম্য ভারতীয় মেয়েদের নতুন আদর্শ রূপ তৈরি করবে— মোক্ষদায়িনী এমনটাই ভেবেছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় এও ছিল তথাকথিত পুরুষতন্ত্রের বুলি। মেয়েদের স্বকীয় নিজস্ব ভাবনার ফুল তখনও প্রস্ফুটিত হয়নি। অন্তত মোক্ষদায়িনীর ভাবনা সে পরিণতি পায়নি।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪৬: রাজার নিয়ন্ত্রণহীন অনুচরেদের কুকর্মের দায় রাজাকেই নিতে হয়

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩৪: পুণ্য আষাঢ়ের প্রথম দিবসে

মোক্ষদায়িনীর কণ্ঠরোধ করেছিল সেকালের পুরুষতন্ত্র। অথচ মোক্ষদায়িনীর বিদ্যাচর্চার কোনো অভাব ছিল না। পয়ার ত্রিপদী ছন্দে দিব্যি মনের ভাব প্রকাশ করে ফেলতেন তিনি। তাঁর প্রোষিতভর্তৃকা আর মিলনসাগর কবিতা পড়লে এ কর্মযোগী সত্তার অন্তরালে তাঁর রোম্যান্টিক সত্তারও পরিচয় পাওয়া যায়। সংস্কৃত শ্লোকের অনুবাদের ঝলকও অনায়াসে কবিতায় লক্ষ করা যায়—‘গৃহলক্ষ্মী পূর্ণশশী/ কখন বা হও দাসী/ প্রকৃত বন্ধু প্রেয়সী/ হও হে তুমি আমার/ পরামর্শে মন্ত্রী তুমি/ জীবনের আধার।’ এর অনেক পরে রবি ঠাকুর ‘ যদি পার্শ্বে রাখো মোরে’ — এই কথা বলাবেন চিত্রাঙ্গদাকে দিয়ে। আসলে প্রতিটি মেয়ে যেকোনো যুগে যেকোনো সময় পুরুষের পাশেই থাকতে চেয়েছে। এইটুকু সাধ নিয়ে মেয়েরা জীবনের লক্ষযোজন পথ পাড়ি দেয়।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯২: মহর্ষিদেব নাতজামাইকে দিয়েছিলেন সোনার কলম

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬৭: পাঞ্চালদেশে যাত্রাপথে পাণ্ডবদের বিচিত্র অভিজ্ঞতায় কিসের ইঙ্গিত?

মোক্ষদায়িনী যেসময় কাজ করেছেন সাহিত্যিক ও সম্পাদক হিসেবে,সেই সময় মেয়েদের পালকিশুদ্ধ জলে ডুবিয়ে আনা হত। মেয়েরা শিক্ষিত হলে বৈধব্য নিশ্চিত একথা বলা হত!সেই সময় দাঁড়িয়ে মোক্ষদায়িনী মেয়েদের পত্রিকা সম্পাদনা করছেন, মনের কথা লিখছেন। প্রেমের ভাব হোক বা প্রতিবাদী সত্তা সবটাই অকপটে প্রকাশ করছেন— জ্ঞানবৃক্ষের এই ফল আস্বাদনের জন্য তাঁকে কুর্নিশ।—চলবে।
* ড. মহুয়া দাশগুপ্ত, শিক্ষক এবং লেখক। রবীন্দ্রনাথের দেবলোক, জোড়াসাঁকোর জার্নাল, আমি নারী আমি মহীয়সী, কথানদীর কূলে, লেডিজ স্পেশাল, পথে পুরুষ বিবর্জিত, পরীক্ষায় আসবে না এবং ভুবনডাঙার বাউল তাঁর লেখা একক বই। বাংলা কথকতা নিয়ে একক ভাবে কাজ করছেন।

Skip to content