মোহিতকুমারী।
রাসসুন্দরী আত্মজীবনী লেখার পথটা মেয়েদের জন্য খুলে দিয়েছিলেন। তাছাড়া আত্মজীবনী মেয়েদের মনের এক মুক্তির পথও ছিল। মোহিতকুমারীকে লেখক হিসেবে খুব কম জনই চেনেন। কিন্তু তাঁর লেখা সেই সময়ের এক দলিল। তাছাড়া মোহিতকুমারীর বর্ণময় জীবন যেকোনও জীবনীকারের লেখার বিষয় হতে পারে।
মোহিতকুমারী ছিলেন ঠাকুরবাড়ির মেয়ে এবং ঠাকুরবাড়িরই বৌ। বাবার ঘরে তাও পর্দাঘেরা পালকি চড়ে গঙ্গাস্নানে যেতে পারতেন। কিন্তু শ্বশুরবাড়ি এসে গঙ্গাস্নানও নিষিদ্ধ হয়ে গেল। মেয়েদের রেলগাড়ি চড়া, ঘোড়ার গাড়ি চড়ার কথা কেউ কল্পনাও করতে পারতেন না।
মোহিতকুমারী ছিলেন ঠাকুরবাড়ির মেয়ে এবং ঠাকুরবাড়িরই বৌ। বাবার ঘরে তাও পর্দাঘেরা পালকি চড়ে গঙ্গাস্নানে যেতে পারতেন। কিন্তু শ্বশুরবাড়ি এসে গঙ্গাস্নানও নিষিদ্ধ হয়ে গেল। মেয়েদের রেলগাড়ি চড়া, ঘোড়ার গাড়ি চড়ার কথা কেউ কল্পনাও করতে পারতেন না।
মোহিতকুমারী ছিলেন গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় মেয়ে সুনন্দিনীর শাশুড়ি। মোহিতকুমারীর বাবা ছিলেন পাথুরিয়াঘাটার অতীন্দ্রনাথ ঠাকুর। খুব অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছিল তাঁর। জীবনের অনেক ঘাত-প্রতিঘাত, টানাপোড়েন পেরিয়ে শেষ বয়সে সন্ন্যাস গ্রহণ করেছিলেন মোহিতকুমারী, সকলের কাছে পরিচিত হয়েছিলেন ‘সাধুমা’ নামে। ঐশ্বর্যশালী পরিবারের মেয়ে এবং বৌ হওয়ার পরেও ঠিক কোন বোধ বা কোন চেতনা থেকে তিনি সংসার ছেড়েছিলেন সেকথা জানা যায় না। কারণ তাঁর আত্মজীবনীটির সম্পূর্ণ অংশ মুদ্রিত হয়নি এবং পাওয়া যায় না। তবে যেটুকু পাওয়া যায়, তাই-ই সেই আমলের ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের জীবনের প্রামাণ্য দলিল। মোহিতকুমারীর ঠাকুরবাড়ির সম্পর্কে ধারাবাহিক লেখাটি ইন্দিরাদেবী তুলে দিয়েছিলেন দ্বিজেন্দ্রলালের পুত্রবধূ হেমলতার কাছে। তবে সম্পূর্ণ রচনাটি প্রকাশিত না হওয়ায় মোহিতকুমারীর প্রবজ্যা নেওয়ার পরের জীবন সম্পর্কে জানা যায় না।
আরও পড়ুন:
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১৭: তিনটি মেয়ের তিনটি কলম!
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪২: সুন্দরবনের বাঘের ভবিতব্য
সে এক সময় ছিল। মেয়েমহলে বিয়ে উপলক্ষ্যেই হইচই হত। অন্দরমহলে খেমটাওয়ালি আসত। দেবেন্দ্রনাথের পরিবারে এইসব আসর না বসলেও অন্যান্য ঠাকুরবাড়িতে বসত। মেয়েরা সেজেগুজে পাঞ্জাবি আস্তিন বা রুমাল আস্তিনের জ্যাকেট পরে ছোট ছোট পালকের হাতপাখা নেড়ে আসরে এসে জমিয়ে বসতেন। পরীর হাট বসে যেত সেখানে। তখনও বইপড়া, সাহিত্য রচনার প্রথা শুরু হয়নি মেয়েমহলে। মোহিতকুমারী তাঁর জীবনের গল্প লিখে রেখেছিলেন পরম যত্নে। পরে যখন সেই লেখা মুদ্রিত হল তখন ঠাকুরবাড়ির মেয়েমহলের অনেক গল্পকথা জানা গেল।
আরও পড়ুন:
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬২: ধনময়ী জ্ঞানময়ী-র পাশে ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’
এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-৫: কৃষ্ণ মাণিক্য সিংহাসনে বসেই উদয়পুর থেকে রাজধানী সরিয়ে আনেন আগরতলায়
এমনই একটি মজার ঘটনা বলা যাক। মোহিতকুমারীর ছেলের বৌ সুনন্দিনীকে তাঁর বাবা এক সেট হিরের গয়না দিয়েছিলেন। নিমন্ত্রিত মহিলারা সেই নিয়ে তর্ক জুড়লেন। একদল বলছেন হিরে নয়, পোখরাজ আর অন্যদল বলছেন হিরে! তর্ক জমজমাট হয় এবং সেই আমলে বাজি ধরা হয় একশো টাকা! দু-চারদিন পর সেই গয়না গোপনে পৌঁছনো হয় স্যাকরার কাছে। স্যাকরার দোকান চোরাই গয়না ভেবে গয়না আটক করে এবং শেষে অনেক তদন্ত করে মোহিতকুমারীর কাছে সেই গয়না ফিরত যায় এবং ছয় নম্বর ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের যথেষ্ট ভর্ৎসনা করা হয় এবং সেই নিয়ে যথেষ্ট মান অভিমান হয়। সুনন্দিনী শ্বশুরবাড়ি না এলে মোহিতকুমারী বিরক্ত হতেন চিরাচরিত রীতিমাফিক। সুনন্দিনীর বোন পূর্ণিমার স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায় মোহিতকুমারী ছেলের বৌকে খোলা বাগানে খেলার অনুমতি দিতেন না। অথচ মোহিতকুমারীর আত্মকথা থেকে জানা যায় তাঁর নিজেরও বিয়ের পর এমন খাঁচার পাখির মতো দুর্দশা হয়েছিল।
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩৯: ইন্দুমতী ও সুরবালা
ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩১: আমার মতে, তোর মতো কেউ নেই
নিজেই বিয়ের পর লিখেছিলেন, ‘আজ হতে আমার এই বাল্যজীবনের খেলা, বসনভূষণ, কথা, চালচলন সবই পরিবর্তন করিতে হইবে। …আজ সকলই অন্যলোকের আজ্ঞার উপর নির্ভর।’ আর সেদিন গেল,—প্রাতঃকালে গাড়িতে ভ্রমণ, যখন যা ইচ্ছা খাওয়া, যেখানে ইচ্ছা বসে গান গল্প করা—’! এই বেদনা যৌথ নির্জ্ঞান হয়ে আজও বিবাহিতা মেয়েদের মনের অন্তরালে রয়ে গিয়েছে। মোহিতকুমারীর আত্মকথা সেই একই অনুভূতির প্রাচীন সময়ের দলিল মাত্র। নয় বছর বয়সে মোহিতকুমারীর বিয়ে হয়।
বিয়ের আগের দিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়েছিলেন তিনি—‘গায়ে হলুদের পূর্বদিনে, আমার বাবা সকালে ফোর্টের ভিতর বেরিয়ে আনেন, মনুমেন্ট চড়া হয়, পরে দুপুরবেলা জাদুঘর ও জুলজিক্যাল গার্ডেন দেখে আসি। বৈকালে গড়ের মাঠে রোজ যেমন বাজা শুনে বাড়ি ফিরি, সেইমতো হয়।’ মোহিতকুমারী বিয়ের আগেরদিন এইভাবে একবার অন্তত উড়াল ডানার সুখ পেয়েছিলেন। তাঁর মায়ের আবার ঘর ছেড়ে আঙিনা বিদেশ ছিল। উঠোনে দাঁড়িয়ে বাগান দেখাই তখন একটা বড় ব্যাপার ছিল।
বিয়ের আগের দিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়েছিলেন তিনি—‘গায়ে হলুদের পূর্বদিনে, আমার বাবা সকালে ফোর্টের ভিতর বেরিয়ে আনেন, মনুমেন্ট চড়া হয়, পরে দুপুরবেলা জাদুঘর ও জুলজিক্যাল গার্ডেন দেখে আসি। বৈকালে গড়ের মাঠে রোজ যেমন বাজা শুনে বাড়ি ফিরি, সেইমতো হয়।’ মোহিতকুমারী বিয়ের আগেরদিন এইভাবে একবার অন্তত উড়াল ডানার সুখ পেয়েছিলেন। তাঁর মায়ের আবার ঘর ছেড়ে আঙিনা বিদেশ ছিল। উঠোনে দাঁড়িয়ে বাগান দেখাই তখন একটা বড় ব্যাপার ছিল।
আরও পড়ুন:
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫৬: রামায়ণে রামচন্দ্রের যাত্রাপথ সুগম হওয়ার কারণেই কি সীতার উপস্থিতি?
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৪: নোবেল পাওয়ায় বন্ধু দিয়েছিলেন লজ্জাবতীর চারা
মোহিতকুমারীর আত্মজীবনী থেকে ঠাকুরবাড়ি, চাটুজ্যেবাড়ি —এই দুই বাড়ির কথাই জানা যায়। প্রথমজীবনে মোহিতকুমারী তাঁর শ্বশুরমশাইকে দূর থেকে দেখেছেন। জানালার খড়খড়ি ফাঁক করে দূর বৈঠকখানা ঘরে। তবে পরবর্তীজীবনে মোহিতকুমারী অনেক পুরনো রেওয়াজ ভেঙে তাঁর শ্বশুরমশাইকে অন্দরমহলে নিয়ে এসেছিলেন। খেয়াল রেখেছিলেন। পুত্রবধূকেও সব সৃজনশীল কাজে উৎসাহ দিতেন তিনি। আত্মকথায় তাঁর গৃহবন্দী মা সেই সময়ের সব মেয়েদের বন্দীদশার প্রতীক হয়ে ফিরে ফিরে এসেছেন, মোহিতকুমারীর বেদনার মতো।
মোহিতকুমারী ঘোর সংসারী ছিলেন। কিন্তু স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি শুধু সংসার ত্যাগ করলেন না, সন্ন্যাসও নিলেন। তাঁর নাম হল মহানন্দী ভারতী। তাঁকে সকলে সাধুমা বলেই ডাকত। ঈশ্বরের প্রতি নিত্য নির্ভরতার খবর তাঁর আত্মকথায় সেইভাবে নেই। শুধু কোনও কোনও বিপন্ন মুহূর্তে তিনি তিনতলার গোপাল মন্দিরে প্রার্থনা জানাতেন। তখন মধুসূদনের নামজপ করলে বিপদ হবে না—এই প্রত্যয় তাঁর মনে জেগেছিল। তারপর অন্যখাতে বয়ে গেল তাঁর জীবনের গল্প! মোহিতকুমারী সাধুমা হয়ে মুক্তির পথ পেয়েছিলেন কীনা জানা নেই। তবে নারীস্বাধীনতার প্রবল প্রয়াসের ইতিহাসে মোহিতকুমারীর আত্মকথা ও তাঁর জীবনযাত্রার একটি বিশিষ্ট ভূমিকা রয়েছে।
ঋণ স্বীকার
● ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল, চিত্রা দেব
মোহিতকুমারী ঘোর সংসারী ছিলেন। কিন্তু স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি শুধু সংসার ত্যাগ করলেন না, সন্ন্যাসও নিলেন। তাঁর নাম হল মহানন্দী ভারতী। তাঁকে সকলে সাধুমা বলেই ডাকত। ঈশ্বরের প্রতি নিত্য নির্ভরতার খবর তাঁর আত্মকথায় সেইভাবে নেই। শুধু কোনও কোনও বিপন্ন মুহূর্তে তিনি তিনতলার গোপাল মন্দিরে প্রার্থনা জানাতেন। তখন মধুসূদনের নামজপ করলে বিপদ হবে না—এই প্রত্যয় তাঁর মনে জেগেছিল। তারপর অন্যখাতে বয়ে গেল তাঁর জীবনের গল্প! মোহিতকুমারী সাধুমা হয়ে মুক্তির পথ পেয়েছিলেন কীনা জানা নেই। তবে নারীস্বাধীনতার প্রবল প্রয়াসের ইতিহাসে মোহিতকুমারীর আত্মকথা ও তাঁর জীবনযাত্রার একটি বিশিষ্ট ভূমিকা রয়েছে।
ঋণ স্বীকার
* ড. মহুয়া দাশগুপ্ত, শিক্ষক এবং লেখক। রবীন্দ্রনাথের দেবলোক, জোড়াসাঁকোর জার্নাল, আমি নারী আমি মহীয়সী, কথানদীর কূলে, লেডিজ স্পেশাল, পথে পুরুষ বিবর্জিত, পরীক্ষায় আসবে না এবং ভুবনডাঙার বাউল তাঁর লেখা একক বই। বাংলা কথকতা নিয়ে একক ভাবে কাজ করছেন।