বাঁশলই নদী।
গঙ্গা বা ভাগীরথী ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম প্রধান নদী। অসংখ্য ছোট-বড় নদী এই নদীর সঙ্গে মিলিত হয়ে এই নদীর কলেবর বৃদ্ধি করেছে। নদীকে তিলে তিলে করেছে তিলোত্তমা। এমনই এক ছোট্ট নদী বাঁশলই। ছোটনাগপুর মালভূমির প্রসারিত এক পাহাড়, বাঁশপাহাড় থেকে এটি উৎপন্ন হয়েছে, অর্থাৎ উৎপত্তিস্থল হল ঝাড়খণ্ডের সাহেবগঞ্জ জেলার গোড্ডা নামক স্থান। ছোট এই নদীর কুলকুল ধ্বনি শোনা যায়, ঝাড়খন্ডের সাহেবগঞ্জ ও পাকুড় জেলায় এবং পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম ও মুর্শিদাবাদ জেলায়। এটি পাকুড় জেলার মধ্যাঞ্চল বরাবর প্রবাহিত হয়েছে।
মহেশপুর স্টেশনের কাছে বাঁশলই নদী পশ্চিমবঙ্গের ঝাড়খণ্ড সংলগ্ন জেলা, বীরভূম জেলায় প্রবেশ করেছে। এরপর এটি এই জেলার মুরারই স্টেশনের উত্তরদিক বরাবর রেললাইন পার হয়ে মুর্শিদাবাদ জেলায় প্রবেশ করেছে। নদীটি বীরভূম থেকে মুর্শিদাবাদ প্রবেশ করেছে যে গ্রামের মধ্য দিয়ে তার নাম হুসেনপুর। তারপর ভূমির ঢাল বরাবর নদীটি পূর্বমুখে প্রবাহিত হয়ে মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুরের উত্তরে গিরিয়াগ্রামে ভাগীরথী মিলিত হয়েছে। এই গিরিয়াগ্রাম অত্যন্ত প্রাচীন এক জনপদ। দেখা গিয়েছে, নদীটি মুর্শিদাবাদ জেলার উত্তর অংশ বরাবর প্রবাহিত হয়েছে। বাঁশলই নদী হল পশ্চিমবঙ্গে ভাগীরথীর নদীর প্রথম উপনদী। সেই দিক থেকে নদীটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
আরও পড়ুন:
রাঢ়বঙ্গের অনাদৃত খড়ি নদী
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৭২: বনবাসজীবনে প্রকৃতির প্রভাব কি রামের দুঃখকে মুছে দিয়েছিল?
পাগলা-বাঁশলই নদী অববাহিকা প্রায় ২২০০ বর্গকিলোমিটার বা ৮৫০ বর্গমাইল অঞ্চল জুড়ে প্রসারিত। বাগমারি-বাঁশলই-পাগলা নদী অববাহিকাটি অবস্থিত ২৪°১৯’-২৪°৪৭’ উত্তর এবং ৮৭°১৪’-৮৮°০৪’ পূর্ব। নদীটি খুব গভীর না হওয়ায় এর জলধারণ ক্ষমতা সীমিত। ছোটনাগপুর মালভূমি থেকে উৎপন্ন অন্যান্য নদীর মতই বর্ষাকালে প্রচুর বৃষ্টিপাতজনিত কারণ এবং জলধারণ ক্ষমতার অপ্রতুলতা জন্যে এই নদীতে প্রচুর বন্যা হয়ে থাকে। বন্যায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ স্থান হল জঙ্গিপুর এবং বর্ধমান জেলার কানলার মধ্যবর্তী অঞ্চল।
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫৬: নান্দনিক শিক্ষায় উৎসাহী ছিলেন শ্রীমা
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫০: পুত্রস্নেহে অন্ধ হলে পিতাকেও ধৃতরাষ্ট্রের মতো দুর্দশা ভোগ করতে হয়
উৎপত্তিস্থল থেকে নদী যত নিম্নগামী হয়ে থাকে, নদীর কলেবর এবং জলের পরিমাণ ততই বৃদ্ধি পায়। এই কারণে মুর্শিদাবাদ জেলা ও বর্ধমান জেলার কালনা সংলগ্ন অঞ্চলে উর্বর ভূমি লক্ষ্য করা যায়। তাই এই অঞ্চলগুলিতে চাষাবাদ ভালো হয়ে থাকে। এখানে প্রচুর পরিমাণে পাট চাষ হয়ে থাকে। জেলে, চাষি, মাঝিমোল্লার বাস এই অঞ্চলগুলিকে। নদীকে ঘিরে আবর্তিত হয় এইসব সাধারণ মানুষের নিত্য জীবনযাত্রা। সরল এই মানুষগুলির কন্ঠে সতত বাজে ভাটিয়ালি গান। এই সব নদী অববাহিকার তীরে অবস্থিত ছোট ছোট জনজাতির কাছে নদী আপন বন্ধু ন্যা য়। ভাগীরথী এবং অন্যান্য নদীর ন্যা য় বাঁশলোই নদীও নিয়ত তাদের গতিপথ পরিবর্তন করে, তাই নদীর কূলে গড়ে ওঠা ছোট-ছোট মাটির বাড়ি ভেঙে। আবার নদীর অন্য কূলে গড়ে ওঠে নতুন প্রাণস্পন্দন।
আরও পড়ুন:
গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-৩: কাঁটা হেরি ক্ষান্ত কেন কমল তুলিতে
বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৩: টলস্টয় ও সোফিয়া—সে কি কেবলই যাতনাময়…/৩
রবি ঠাকুরের ছোট নদীর মতো এখানকার গ্রামগঞ্জের মানুষরা দুপুরে গায়ে তেল মেখে নদীতে স্নান করে, গামছা দিয়ে ছেকে ছোট ছোট চুনো মাছ ধরে নিয়ে যায় বাড়ি। যেহেতু এই নদীর তীরে বড় কোনো শিল্প-কারখানা গড়ে ওঠে নাই, তাই এই নদীর জল অনেক পরিশুদ্ধ; বলা যেতে পারে তা পান উপযোগীও।
‘নমামি গঙ্গে’ কেন্দ্রীয় সরকারের প্রদত্ত অর্থে কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকার মিলে নদীর পাড় সংরক্ষণ এবং সবুজায়নে বিশেষ জোর দিয়েছে। এইরকম সাতটি নদীকে প্রাথমিকভাবে বেছে নেওয়া হয়েছে। সেগুলি হল-মহানন্দা, বাঁশলই, ময়ূরাক্ষী, অজয়, দামোদর, দ্বারকেশ্বর ও কংসাবতী। বন দফতর থেকে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সোনাঝুরি, আম, জাম, পেয়ারা জাতীয় দেশজ উদ্ভিদ লাগানোয় জোর দেওয়া হয়েছে। এর ফলে নদীবাঁধ রক্ষা পাবে ও ভূমিক্ষয় কিছুটা হলেও কমবে এই আশা করা যায়।
‘নমামি গঙ্গে’ কেন্দ্রীয় সরকারের প্রদত্ত অর্থে কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকার মিলে নদীর পাড় সংরক্ষণ এবং সবুজায়নে বিশেষ জোর দিয়েছে। এইরকম সাতটি নদীকে প্রাথমিকভাবে বেছে নেওয়া হয়েছে। সেগুলি হল-মহানন্দা, বাঁশলই, ময়ূরাক্ষী, অজয়, দামোদর, দ্বারকেশ্বর ও কংসাবতী। বন দফতর থেকে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সোনাঝুরি, আম, জাম, পেয়ারা জাতীয় দেশজ উদ্ভিদ লাগানোয় জোর দেওয়া হয়েছে। এর ফলে নদীবাঁধ রক্ষা পাবে ও ভূমিক্ষয় কিছুটা হলেও কমবে এই আশা করা যায়।
আরও পড়ুন:
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৮: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— বাবুর ও বন জুঁই
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৬: স্রোতস্বিনী পদ্মায় লাফিয়ে কবির কটকি চটি-উদ্ধার
এই নির্জন নদী অববাহিকায় প্রচুর পরিমাণে জন এবং জীববৈচিত্র লক্ষ্য করা যায়। তবে সময়ের সাথে সাথে অন্যান্য নদীর ন্যা য় এখানেও জীববৈচিত্র ধ্বংস হচ্ছে। এটি পরিবেশবিদ ও অন্যান্য মানুষের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলছে।
নদীর জল কমে গেলেও, নদীর প্রবাহ স্তিমিত হলেও নদীর দেবত্ব কখনও নষ্ট হয়ে যায় না। পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে তর্পণ, শ্রাদ্ধে পিন্ডদান, সূর্য দেবতার আরাধনা এমনই প্রায় সকল ধর্মীয় কাজে নদী আজও মানুষের কাছে একান্ত অপরিহার্য। তাই নদীকে রক্ষা করার দায়িত্বও মানুষের। নদী ব্যতীত এই সকল মানুষের জীবন থমকে যাবে, থমকে যাবে জীবনের প্রবাহমানতাও।
তথ্যসূত্র:
● বাংলার নদ-নদী: দিলীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, দে’জ পাবলিশিং
● Evolution of Wet lands in lower reaches of Bagmari-Bansloi-Pagla rivers: a study using multidated images and maps.
● WikiVisually.com
● Bansloi River, India, 11.04.2009
● Murshidabad district 05.03.2009
● Roy, Jitendra, The Deluge 2000, 10.04.2009
● Flood management, irrigation and Water ways Department, Govt. Of W.B
● Jharkhand and River maps of India, 11.04.2009
নদীর জল কমে গেলেও, নদীর প্রবাহ স্তিমিত হলেও নদীর দেবত্ব কখনও নষ্ট হয়ে যায় না। পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে তর্পণ, শ্রাদ্ধে পিন্ডদান, সূর্য দেবতার আরাধনা এমনই প্রায় সকল ধর্মীয় কাজে নদী আজও মানুষের কাছে একান্ত অপরিহার্য। তাই নদীকে রক্ষা করার দায়িত্বও মানুষের। নদী ব্যতীত এই সকল মানুষের জীবন থমকে যাবে, থমকে যাবে জীবনের প্রবাহমানতাও।
তথ্যসূত্র:
* ড. উৎপল অধিকারী, সহ-শিক্ষক, আঝাপুর হাই স্কুল, আঝাপুর, জামালপুর, পূর্ব বর্ধমান।