শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


পীড়িতের সেবাই তাঁর কাছে যোগ—
সাল ২০১২, ১৬ ডিসেম্বর দিল্লির মুনিরকাতে ঘটে যাওয়া ভয়ানক অপরাধের গুরুত্ব বোঝাতে মিডিয়ার সক্রিয় ভূমিকা, রাজ্যসভা ও লোকসভা তোলপাড় করা সব অধিবেশন, গুরুত্বপূর্ণ সেলিব্রিটিদের পর পর স্টেটমেন্ট আর জনরোষের জনস্রোত দিল্লির তৎকালীন সরকার আর পুলিশ প্রশাসনকে ভিতর থেকে নাড়িয়ে দেয়। শুরু হয় অপরাধীদের ধরপাকড়ের কাজ।
যদিও ততক্ষণে সব প্রমাণ ধুয়ে মুছে সাফ করে ফেলে তারা। কিন্তু সাফ করতে পারে না তাঁর ওপর ঘটে যাওয়া ভয়ঙ্কর অত্যাচারের স্মৃতিকে। তিনি নির্ভয়া। সফদরজং হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে নিজের ওপর ঘটে যাওয়া নারকীয় অত্যাচারের পুঙ্খানপুঙ্খ বর্ণনা তিনি সেই সময়ের মহিলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দিয়েছিলেন। আর তার ভিত্তিতে গঠিত হয় বলিষ্ঠ চার্জশিট। অপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে উত্তাল দিল্লি একদিন শান্ত হয় আর তারপর ২০১২-২০২০, শুরু হয় তার পরিবারের দীর্ঘ লড়াই। আর এই দীর্ঘ লড়াইয়ে নির্ভয়ার বাবা-মা যাকে সবসময় পাশে পেয়েছিলেন তিনি আর কেউ নন, তিনি যোগিতা ভয়ানা।
আরও পড়ুন:

পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৮২: খটকা

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৬:কোনও একটি দাবিতে বিরোধীরা জোট বাঁধুক কখনও চায় না শাসক

ভারতে ধর্ষণ বিরোধী কর্মকাণ্ডের সবচেয়ে অগ্রণী সৈনিক তিনি। দিল্লির নির্ভয়া কাণ্ডের ওই সব দিনে তিনি মাসের পর মাস দোষীদের শাস্তির দাবিতে বিভিন্ন বিক্ষোভ মিছিলের আয়োজন করেন, আদালত চত্বরে বেশি সময় কাটাতেন কারণ সেই সময় আরও আট নয়টি ঘটনার প্রতিবাদ তিনি একসঙ্গে করছিলেন। এক শুনানি থেকে অন্য শুনানিতে যেতেন। অন্যান্য ধর্ষিতা মহিলার পাশে থাকার, তাঁদের ন্যায় বিচারের জন্য লড়াই ও পরিবারগুলোর নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছিলেন। সেই প্রতিশ্রুতি তিনি আজও পালন করে চলেছেন।
বিগত ১৪ বছর ধরে বিভিন্ন সামাজিক কাজ, মহিলা ও শিশু কল্যাণ, বিশেষত ধর্ষণ, যৌন নির্যাতন, বৈবাহিক ধর্ষণ, গার্হস্থ্য হিংসা প্রভৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে অত্যাচারিত মহিলাদের জন্য প্রতিনিয়ত লড়াই চালান তিনি। দিল্লি ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় যে সব ঘটনার কোনও সংবাদ মাধ্যমে লেখালেখি নেই, কোর্ট চত্বরে দিনের পর দিন বিচারের আশায় চক্কর কাটে অসহায়দের, তাঁদের পাশে থাকেন যোগিতা ও তাঁর সংগঠন পরী (People Against Rape in India)।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-৮: যেথা আমি যাই নাকো / তুমি প্রকাশিত থাকো

দিনের পর দিন মানুষের পাশে দাঁড়ানোই তাঁর জীবনের মূলমন্ত্র। তা সে দুশো বেঘর ধর্ষণ পীড়িতের মাথার ওপরে ছাদের ব্যবস্থা হোক অথবা কোভিড অতিমারিতে দিল্লি এইমস থেকে ফিরিয়ে দেওয়া অনেক হৃদরোগী, ক্যানসার রোগী কিংবা অগ্নিদগ্ধ মানুষ যাদের অনেকের হাঁটার ক্ষমতা ছিল না, দিল্লিতে থাকার জায়গা ছিল না তাঁদের তিনি নিজের খরচে বাসের ব্যবস্থা করে বাড়ি পৌঁছে দেন।
মানুষের পাশে থাকা তাঁর ছোটবেলার অভ্যাস। নবম-দশম শ্রেণিতে পড়াকালীন তিনি তাঁর বাড়ির বাইরের গাছের নীচে গরীব বাচ্চাদের পড়াতেন। বৃদ্ধদের সাহায্যের জন্য তহবিল গড়তেন। ক্রমশঃ ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্টে এমএ পাশ করার পর কিংফিশার এয়ারলাইন্সে মোটা মাইনের চাকরিতে ঢোকেন কিন্তু ২০০২ সালের এক ঘটনা তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ওই সময় তিনি এক পথদুর্ঘটনার সাক্ষী হন যেখানে দুর্ঘটনা কবলিত মানুষটিকে সাহায্যের জন্য কেউ এগিয়ে আসে না। তিনি ও তাঁর বন্ধুরা মিলে তাকে সরকারি হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানকার বেহাল অবস্থা তাঁর চোখে পড়ে। চিকিৎসা শুরু হতে দেরি হওয়ায় ওই ব্যক্তি মারা যান। ওই ঘটনা তাঁকে ভিতর থেকে নাড়িয়ে দেয়, রাতের পর রাত ঘুমোতে না পারা তিনি এই ভেবে কাটিয়ে দেন যে আমাদের দেশে গরীব মানুষের জীবন কত সস্তা!
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩৮: নন্দিতা কৃপালনি— বিশ শতকের বিদুষী

ওই দুর্ঘটনাগ্রস্ত পরিবারের পাশে দাঁড়ান তিনি, আদালতে সাক্ষ্য দেন, নিহতের স্ত্রী ও সন্তানদের ক্ষতিপূরণের দাবিতে আদালতের দ্বারস্থ হন। এরপরেই তিনি চাকরি ছেড়ে পুরোপুরি সমাজকল্যাণে ব্রতী হন। মহিলাদের আত্মনির্ভর করার কাজও তিনি ও তাঁর সংস্থা করে যান। দিল্লি ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের আঙনওয়াড়ি কর্মীদের সাক্ষাৎকার নেওয়া, ন্যাশানাল কমিশন ফর উইমেন ও দিল্লি সরকারের রোগী কল্যাণ সমিতির উল্লেখ্যযোগ্য সদস্য তিনি। হাজারেরও বেশি অর্থনৈতিক ভাবে অসচ্ছল মহিলাকে গাড়িচালক, গৃহস্থালির কর্মী এবং গাড়ি সাফাই কর্মী হিসেবে নিয়োগ করেছেন তিনি।
দেশের অন্যতম সমাজকর্মী তিনি, সংবাদ মাধ্যমে অত্যন্ত পরিচিত মুখ তাঁর, কিন্তু এত কিছুর পরেও তাঁর কণ্ঠরোধের জন্য দিল্লি পুলিশ আইপিসি ১৫৩, ১৫৩(এ), ৫০৫(১) (বি) তে তাঁকে পুলিশ স্টেশনে হাজিরা দিতে বলে, বিহার পুলিশের সেই কুখ্যাত উক্তি, ‘Now Bihar Police will tell, how ladies should live’, তাঁর দিকে ধেয়ে আসে। এতকিছুর পরেও তিনি নিজের জায়গায় অবিচল, থামবার পাত্রী নন। মানুষের পাশে দাঁড়ানোই তাঁর কাছে যোগ— তাই তো তিনি যোগিতা।
* লেখিকা পরিচিতি: ড. বিদিশা মিশ্র বিগত চৌদ্দ বছর ধরে সরকারি কলেজে, বর্তমানে কলকাতার লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত। তাঁর বিষয়— সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতি ছাত্রী বিদিশা স্নাতক ও স্নাতকোত্তর উভয় পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে তৃতীয় হন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল —বাঙালি নৈয়ায়িক চিরঞ্জীব ভট্টাচার্যের গ্রন্থ ‘কাব্যবিলাস’। তাঁর এই গবেষণা ২০২১ সালে কর্ণাটকের আইএনএসসি পাবলিশিং হাউস থেকে ‘দ্য কাব্যবিলাস অফ চিরঞ্জীব ভট্টাচার্য — এ ক্রিটিক্যাল স্টাডি’ শিরোণামে প্রকাশিত হয়। দেশের বিভিন্ন প্রদেশের পত্রিকায় তাঁর শোধপত্র প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানে তাঁর তত্ত্বাবধানে একাধিক স্কলার গবেষণারত। বিভিন্ন সরকারি কাজকর্ম ও অধ্যাপনার পাশাপাশি তিনি গুরুজি বিপ্লব মুখোপাধ্যায়ের কাছে হিন্দুস্থানি ক্লাসিক্যাল ও রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী জয়শ্রী দাসের কাছে রবীন্দ্রসংগীত শিক্ষারতা। ভ্রমণপিপাসু বিদিশা দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থান ঘুরেছেন, সেইসব অভিজ্ঞতা তাঁকে সমৃদ্ধ করেছে বলে তিনি মনে করেন।

Skip to content