মঙ্গলবার ৯ জুলাই, ২০২৪


কনফারেন্সে লেখক।

বিজ্ঞানচর্চার জন্য আমাকে বেশ কিছু বিজ্ঞান সম্মেলনে যেতে হয়। সেখানে বিজ্ঞান ছাড়াও বেশ কিছু অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়। বিজ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গে সেই সব অভিজ্ঞতাকেও আমি খুব যত্নে রাখি। নষ্ট করি না। যত্নে থাকে মনের মণিকোঠায়।

একবার একটি সম্মেলনে বক্তা বারবার একই কথাই বলে যাচ্ছিলেন। প্রতিটি বাক্যে ‘অ্যাকচুয়ালি’ শব্দটি ব্যবহার করছিলেন। তিনি চেন্নাই থেকে এসেছিলেন। পরে এখানেই আমাদের মধ্যে সখ্যতা গড়ে ওঠে। আমার মতো তিনিও ইনফ্লামেশনের ওপর কাজ করেন। পরে তাঁর কন্যার বিয়েতে আমন্ত্রণও জানিয়েছিলেন। সেখানেও তিনি যা বলছিলেন তা ছিল এইরকম: “অ্যাকচুয়ালি মাই ডটার নিউ দা বয়, অ্যাকচুয়ালি দে ইউজ টু ওয়ার্ক টুগেদার ইন রিসার্চ ল্যাব। অ্যাকচুয়ালি আই দেন ডিসাইডেড ট গেট দেম ম্যারেড’’। আমি তখন বলেই ফেললাম, “অ্যাকচুয়ালি আই ভেরি মাচ এনজয়েড দা ফাংশন, বাট অ্যাকচুয়ালি আই হ্যাভ ট লিভ নাউ। অ্যাকচুয়ালি আই হ্যাভ টু গো টু অ্যানাদার ফাংশন’’। সেদিন সত্যি কথা বলতে কি, আমি অ্যাকচুয়ালি র্যা ন অ্যাওয়ে ফ্রম দা প্লেস। আমার আর একটাও ‘অ্যাকচুয়ালি’ শোনার আর ধৈর্য ছিল না।

আরেকজনের কথা বেশ মনে আছে। সম্মেলন চলছে। বিদগ্ধ বক্তারা বসে আছেন। ভদ্রলোক বলেই চলেছেন, “ইউ নো, ইউ নো”। আমি বিরক্ত হয়ে ভাবলাম বলি, আই নো স্যার, বাট ডু ইউ নো হোয়েদার ইউ নো অর নট”। খারাপ দেখাবে, তাই বলিনি। অনেকে আবার বলে অ্যান্ড, অ্যান্ড। অ্যান্ডের শেষ আর হবে না। কেউ আবার বলে ‘ইন ফ্যাক্ট’ প্রতিটি বাক্যের পরে আসে ‘ইন ফ্যাক্ট’। ভাবলাম বলেই ফেলি কোনটা তোমার ‘আউট অফ ফ্যাক্ট’টা কী বলে ফেলো বাবা।
একবার গিয়েছি আর্জেন্টিনাতে। বুয়েনস আইরেসে মিটিং হচ্ছে। সমস্ত ব্যাপারটা বেশ সিরিয়াস। এক একজন তাঁদের পেপার প্রেজেন্ট করছেন। তারপর প্রশ্নোত্তর। এ বার পালা এল ক্রিসটাবেল কুটোর। কুটোকে কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন মিটিংয়ে দেখছি। দিলখোলা হাসি। নো টেনশন। পেপার পড়ার পর কুটোকে একজন প্রশ্ন করল—হাউ ডু ইউ এক্সপ্লেন, সাচ এ রিমারকেবল রেজাল্ট, নো কমপ্লিকেশন অ্যাট অল। সবাই চুপ। দশ সেকেন্ড, কুড়ি সেকেন্ড, তিরিশ সেকেন্ড। কুটো চুপ। সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে কুটোর প্রতিক্রিয়ার জন্য। হঠাত সব্বাইকে চমকে কুটো বলে উঠল, “দিস ইজ কুটোস ম্যাজিক।” সবাই হো হো করে হেসে উঠল।

একবারে আমেরিকার সারাসোটায় এসেছি পেপার প্রেজেন্ট করতে। মিটিংটা ছিল খুব আকর্ষণীয়। সেটা ছিল আমেরিকায় আমার প্রথম ‘ফ্রি পেপার’ পড়া। পেপার পড়ার পর একজন জার্মান বিজ্ঞানী আমাকে উঠে প্রশ্ন করলেন। প্রশ্নটা বেশ খটমটে ছিল। তার উপর জার্মান উচ্চারণ। ধরতে পারছিলাম না। তখন বোস্টনের একজন নামকরা বর্ষীয়ান বিজ্ঞানী দেখি ওই জার্মান ভদ্রলোককেই প্রশ্ন করতে শুরু করল। এমনকি, আমাকে করা প্রশ্নটির উত্তরও দিয়ে দিল। আসলে বোস্টনের ওই বিজ্ঞানীর আমার কাজটা ভালো লেগেছিল। দু’জনের মধ্যে কথা চালাচালিতে ‘ডিসকাশন টাইম ওভার’। রাখে কৃষ্ণ মারে কে!

হ্যাঁ, অনেক বিজ্ঞান সম্মেলনে যাওয়া হয়ে গিয়েছে। জাতীয়, আন্তর্জাতিক, রাজ্য, শহর—কিছুই বাদ যায়নি। সবগুলোর কথা মনেও নেই। কিন্তু যে বিজ্ঞান সম্মেলনের কথা কোনওদিনই ভুলবো না, সেটা হল অন্ধ্রপ্রদেশের টেডিয়াপাল্লিগুডামের মিটিংয়ের কথা। হাওড়া মেলে গিয়েছিলাম চেন্নাই থেকে। ছোট স্টেশন। ট্রেনটা বেশিক্ষণ থামেও না। ট্রেন থেকে নেমে তো অবাক। আমাকে নিতে এসেছেন দশজন। পরিচয় করিয়ে দিলেন। বললেন, আমি প্রেসিডেন্ট, উনি ভাইস, উনি অনারারি সেক্রেটারি, উনি ট্রেজারার, আর উনি…। থামিয়ে দিয়ে বললাম, একি করেছেন আপনারা। আমার জন্য আপনারা সবাই কেন এলেন? ড্রাইভার পাঠিয়ে দিলেই তো হত। ওঁদের আন্তরিকতায় সেদিন সত্যি বলতে কি অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম।
আরও পড়ুন:

চণ্ডীগড়ের সেই ভাটুরা জংশন

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৪: নোবেল পাওয়ায় বন্ধু দিয়েছিলেন লজ্জাবতীর চারা

বাংলাদেশে গিয়েছিলাম একটা ‘সায়েন্টিফিক মিটিং’-এ। মিটিং শুরু হল কয়েক লাইন রবীন্দ্রসংগীত দিয়ে। ‘ওয়েলকাম স্পিচ’ নয়। কোরান পড়লেন একজন। আমিও সাহস করে শুরু করলাম রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত কবিতার কয়েকটা লাইন দিয়ে, “নমো নমো নমো, বাংলাদেশ মম, চির মনোরম, চির মধুর”। সত্যি কথা বলছি বিবেকানন্দর চিকাগো বক্তৃতার শেষের মতো হাততালি উঠেছিল।

বিজ্ঞান সম্মেলনে গেলে একটা না একটা মেমেন্টো আপনি পাবেনই। অনেক সময়ই প্লাক (Plaque) কিংবা ট্রফি পাওয়া যায়। আমার বউ একটাও বাড়িতে রাখতে দেন না। আলমারিতে রাখা পুতুলদের সঙ্গে ওগুলো ঠিক মানায় না নাকি। অগত্যা অফিসের ছোট্ট ঘরে তাদের স্থান হয়। তবে একসময় আসে যখন তারা গায়ে গায়ে লেগে থাকে। গনেশ কিম্বা সরস্বতীর মূর্তি পেলে তারা ঠাকুর ঘরে যথাযোগ্য মর্যাদায় স্থান পায়। একবার তামিলনাডুর একটা সম্মেলনে পেলাম কুথুভিলা। আমরা যাকে প্রদীপ বলি, সেই প্রদীপ। বাড়িতে এসে সহধর্মিণীকে দিতে বলল, এরকম প্রদীপ একটা রাখতে নেই, দুটো রাখতে হয় ঠাকুরের সামনে। এখন কোথায় পাই আরেক পিস কুথুভিলা। না, পেলাম। ছ’ বছর পরে আরেকটা কুথুভিলা পেয়ে গেলাম। শান্তি। বারমিংহামের কাছে ‘ইলস ডিজিজ’ (Eales disease) এর উপর একটা বক্তৃতা দিতে গিয়েছিলাম। ডাঃ হেনরি ইলস (Dr Henry Eales) বারমিংহামের মিডল্যান্ড হাসপাতালে কাজ করতেন। মিটিং শেষে উদ্যোক্তারা দিচ্ছিলেন একটা করে শ্যাম্পেনের বোতল। আমি তো ও রসে বঞ্চিত। তবে আমার শালককে দিতে সে যারপরনাই খুশি হয়েছিল।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৩: সুন্দরবনের পশ্চিমাংশে ম্যানগ্রোভ

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩২: কে বলে ঈশ্বর গুপ্ত?

আমাদের দেশে বিজ্ঞান সম্মেলনে খাওয়াদাওয়া একটা বড়সড় ব্যাপার। ফ্রি লাঞ্চ, ফ্রি ডিনার, স্ন্যাকস। কখনও কখনও ব্রেকফাস্ট অবধি। তারপর ব্যাঙ্কোয়েট তো আছেই। রাজকীয় ব্যাপার হয় এদেশের সম্মেলনে। কিন্তু বিদেশে ও সব নেই, বিশেষ করে আমেরিকাতে। ওখানে ওই ফেল কড়ি মাখো তেল। একবার আমেরিকার সিয়াটল শহরে গিয়েছিলাম। সেটা ছিল বিদেশে আমার প্রথম পেপার। লাঞ্চ ব্রেকে অরগান্যাইজিং সেক্রেটারি গাইড করে নিয়ে গেল লাগোয়া একটা রেস্টুরেন্টে। বুফে লাঞ্চ। থরে থর খাবার সাজানো আছে। আমি স্যালমন, চিকেন, মাটন, স্যালাড, পুডিং, আইসক্রিম নিয়েছি। কোনওটা বাদ রাখিনি। লাইনে দাঁড়িয়ে। হঠাৎ দেখলাম সবাই যে যার মতো টাকা মেটাচ্ছেন। দেশে এরকম হয় দেখিনি। উদ্যোক্তাদের বাবা-মায়ের স্পর্শ না করে যতটা পারা যায় মনে মনে গালাগালি দিতে দিতে যা পারা যায় নামিয়ে রাখলাম। তাও উনত্রিশ ডলারে উঠল। নাকে খত।

অনেক রকম ছোটখাট অভিজ্ঞতাও হয় এই সব কনফারেন্সে। গিয়েছি লস এঞ্জেলসের একটা ছোট সম্মেলনে। বায়োব্রেকে টয়লেটে একটু গিয়েছিলাম। পেচ্ছাপ করছি। কানে এলো পাশের এক চিকিৎসক আরেক চিকিৎসক বন্ধুকে বলছেন, “আর ইউ উইথ দা সেম ওয়াইফ?” যস্মিন দেশে যদাচার।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬২: ধনময়ী জ্ঞানময়ী-র পাশে ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’

ইতিহাস কথা কও: পূর্বোত্তরে ইতিহাস ঐতিহ্যে হাতি

বিজ্ঞান সম্মেলনে মাঝে মাঝে অদ্ভুত ঘটনাও ঘটে। দেখা হয়েছিল ম্যানফ্রেডের সঙ্গে বেশ কয়েক বছর পর। ম্যানফ্রেড জার্মানির নাগরিক। দেখা হতেই মনে হল তাঁকে যেন চেনা চেনা মনে হচ্ছে। কোথায় যেন আগে দেখেছি। খানিকক্ষণ পরে মনে পড়লো। হ্যাঁ, লস এঞ্জেলেসে ডহিনি আই ইন্সটিটিউটে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। আমি সবে ফেলোশিপে জয়েন করেছি। আর তিনি ফেলোশিপ শেষ করে পাততাড়ি গুটিয়ে জার্মানিতে ফিরে যাচ্ছেন। মুভিং সেলের নোটিস দিয়েছে ক্যান্টিনে। সেখানে তালিকায় অনেক জিনিসের সঙ্গে একটা ব্রিফকেসও ছিল। আমি ওই ব্রিফকেসটা কিনেছিলাম প্রায় জলের দামে। তিন ডলার মাত্র। দশ বছর ধরে ওই ব্রিফকেসটা আমার সম্মেলনের সঙ্গী। এ বারও সঙ্গে এনেছি। কনফারেন্সের জরুরি কাগজটাগজ রাখতে খুব কাজে লাগে। ব্রিফকেসটা ম্যানফ্রেডকে দেখাতে ম্যানফ্রেড উল্লাসে বলে উঠলেন, “ইউ আর কিপিং ইট স্টিল নাউ, মাই গড!”

না, সম্মেলনে শুধু বিজ্ঞানচর্চা হয় না, তার বাইরেও কিছু কিছু ছোটখাট ঘটনা স্মৃতি হয়ে থাকে। জানি সম্মেলনে বিজ্ঞানচর্চা থাকবে, থাকবে ওরেশন, ফ্রি পেপার, সায়েন্টিফিক পোস্টার, আলোচনা অনেক কিছু। তবু তার সঙ্গে থাকবে এই সব স্মৃতি, যা ভুলবার নয়। ভুলবোও না।
* ডাঃ জ্যোতির্ময় বিশ্বাস সাহিত্যের জগতে পদচারণা করেন ডাকনামে। ‘সবুজ বিশ্বাস’ নামে তিনি একাধিক সাহিত্যকেন্দ্রিক গ্রন্থ রচনা করেছেন। বাচিক শিল্পেও তাঁর প্রবল আগ্রহ। এই মুহূর্তে বাচিকশিল্পে আমাদের রাজ্যে যাঁরা স্বনামধন্য, তাঁরা অধিকাংশই ডাঃ বিশ্বাসের বন্ধুস্থানীয়। ছাত্রজীবনে, এই শহরে এমবিবিএস পাঠকালে একসঙ্গে এ-মঞ্চে, সে-মঞ্চে কবিতা আবৃত্তি করেছেন। পরে পেশাগত কারণে বিদেশযাত্রা ও গবেষণাকর্মের শেষে শংকর নেত্রালয়ে যোগদানের ফলে সেই বাচিকশিল্পের সঙ্গে যোগাযোগ ক্ষীণ হয়ে উঠেছে। চেন্নাই শহরের বাঙালিসমাজের যে কোনও অনুষ্ঠানে অবশ্য এখনও তিনি আবৃত্তি পরিবেশন করেন। ডাঃ বিশ্বাস চক্ষু বিশেষজ্ঞ হিসেবে স্বনামধন্য। ভারতের প্রথম শ্রেণির একজন চক্ষু বিশেষজ্ঞ। তিনি চেন্নাইয়ের শংকর নেত্রালয়ের অন্যতম ডিরেক্টর।

Skip to content