বুধবার ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৪


যতীন দাস।

১৯২৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর পাঞ্জাব কেশরী লালা লাজপৎ রায়কে লাহোরের রাস্তায় একটি স্বদেশী মিছিল পরিচালনাকালে মেসার্স স্কট ও জেপি স্যান্ডার্সের নেতৃত্বে এক পুলিশ বাহিনী এমন প্রহার করে যে, শেষ পর্যন্ত তাঁর মৃত্যু হয়। এই ঘটনার প্রতিশোধ নেওয়ার দায়িত্ব বিপ্লবীরা নিজেদের কাঁধে তুলে নেন এবং তাঁদের গুলিতে জেপি স্যান্ডার্স নিহত হন। লালা লাজপৎ রায়ের শোচনীয় মৃত্যুতে দেশ যখন বিক্ষুব্ধ সেই সময় ১৯২৯ সালের ৬ জুন বিপ্লবী ভগৎ সিং ও বিপ্লবী বটুকেশ্বর দত্ত দিল্লি অ্যাসেম্বলিতে একটি উন্মুক্ত স্থানে সজোরে একটি বোমা নিক্ষেপ করে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সরকারি পরিকল্পনায় ষড়যন্ত্রের মামলা সংঘটিত হয়, নাম দেওয়া হয় ‘লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা’।
গোপন খবর অনুযায়ী ওই বছরই ব্যস্ত কলকাতার ১৪ জুন সকালে টাউনসেন্ড রোড ও হাজরা রোডের মোড়ে একটি বাড়িতে অভিযান চালায় ব্রিটিশ পুলিশ। খবর ছিল ওই বাড়ির দোতলায় লুকিয়ে আছেন যতীন দাস। খবর মিলে যায়। জেপি স্যান্ডার্সকে হত্যার অপরাধ ও ইংরেজ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অন্যতম অভিযোগী হিসেবে গ্রেফতার হন ২৪ বছরের তরুণ বিপ্লবী যতীন দাস। লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা খাড়া করে ব্রিটিশ সরকার ভগৎ সিং, সুকদেব, রাজগুরু, যতীন দাস-সহ সতেরো জনকে আসামী হিসেবে লাহোর সেন্ট্রাল জেলে পাঠিয়ে দেয়। শুরু হয় তাঁদের মতো রাজনৈতিক বন্দীদের উপর অকথ্য অত্যাচার। যদিও জেলখানার অভিজ্ঞতা যতীনের সেই প্রথম নয়।
আরও পড়ুন:

গল্পবৃক্ষ, পর্ব-১: হাতির মতো বুদ্ধি?

শারদীয়ার গল্প: তখন বিকেল/৩

ভবানীপুর মিত্র ইনস্টিটিউশন এবং বঙ্গবাসী কলেজের কৃতী ছাত্রটি ১৯০৪ সালের ২৭ অক্টোবর কলকাতার সিকদার বাগানে মামার বাড়িতে জন্মানোর নয় বছরের মধ্যেই নিজের মাকে হারান। বাবার কাছে মানুষ, বাবা ছিলেন স্বদেশী ভাবাপন্ন, তাই ছোটবেলা থেকেই বাবার কাছে স্বদেশী আন্দোলনের গল্প শুনে বড় হন। অন্যের দুঃখ, দুর্দশা নিবারণে ঝাঁপিয়ে পড়া ছিল ছোটবেলার অভ্যাস।
আরও পড়ুন:

বাংলাকে ধ্রুপদী ভাষার স্বীকৃতি: বাংলা বুকের ভিতরে

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৬২: সত্যজিৎ রায় রুপটান শিল্পীকে বলেছিলেন, উত্তমকুমারের কোনও মেকআপ করার

একে পরাধীনতার নাগপাশ, তার উপর দেশের মানুষের বিপন্নতা বাড়িয়ে মাঝে মাঝে হানা দিত কলেরা, বসন্ত প্রভৃতি নানা মহামারী। দুঃস্থ, রোগগ্রস্ত মানুষদের সাহায্যের জন্য নির্ভয়ে এগিয়ে যেতেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলে বস্তিতে বস্তিতে স্থাপন করেছিলেন নৈশ স্কুল। দেশমাতৃকার মুক্তির পাশাপাশি দেশের মানুষের অজ্ঞানতার অন্ধকার থেকে মুক্তিও ছিল যতীন দাসের লক্ষ্য। কিন্তু অন্ধকার দেশ, পরাধীনতার মাটি আর নিরীহ মানুষদের উপর দেশ শাসনের নামে অকথ্য অত্যাচার শান্তি দিত না তাঁকে।

সুভাষচন্দ্র বসু ও ভগৎ সিং।

খুব অল্প বয়সেই বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামী দল অনুশীলন সমিতি থেকে শচীন্দ্রনাথ সান্যালের হিন্দুস্তান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন থেকে মহাত্মা গান্ধীর দ্বারা পরিচালিত অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান কোনও কিছুই বাদ দেননি তিনি। স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে দেশব্যাপী পরিচিতি থাকলেও একসময় তাঁকে তাঁর সিদ্ধান্ত থেকে টলানো যায়নি। সিদ্ধান্তটি ছিল লাহোর ষড়যন্ত্র মামলায় ধৃত এবং রাজনৈতিক বন্দি হিসেবে অকথ্য অত্যাচার ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে আমৃত্যু অনশন। ১৯২৯ সালের ১৩ জুলাই লাহোর জেলে শুরু হয় তাঁদের পরিকল্পনা মাফিক কাজ। সেই সময় সবার প্রিয় যতীন দা ছাড়া কারও অনশন আন্দোলনের অভিজ্ঞতা ছিল না তাই তিনি ভাবাবেগে চালিত হয়ে এই আন্দোলনে যোগ দিতে নিষেধ করে বলেছিলেন, ‘রিভলভার বা পিস্তল নিয়ে লড়াই করার চেয়ে অনেক বেশি কঠোর এক অনশন সংগ্রামে আমরা নামছি। অনশন সংগ্রামীকে তিল তিল করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে হয়।’
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩

মুভি রিভিউ: মামুটির মাল্টিস্টারার ছবি ‘সিবিআই ৫: দ্য ব্রেন’ গতানুগতিক থ্রিলার

বিপ্লবীদের এই অনশন ইংরেজ সরকারের ঘুম কেড়ে নেয়। কিন্তু জেলবন্দিদের উপর শারীরিক, মানসিক অত্যাচারের মাত্রা কমে না। বিশেষত লাহোর জেলে সবচেয়ে অত্যাচারিত হন ভগৎ সিং। সমস্ত অনশনরত বিপ্লবীদের নাকে, মুখে নল ঢুকিয়ে খাওয়ানোর চেষ্টা ব্যর্থ হয়। অনশনের খবর ছড়িয়ে পড়ে দেশ জুড়ে। পাঞ্জাব প্রদেশের বাড়িতে বাড়িতে শুরু হল অরন্ধন, অনশন। অনশনকারীদের সমর্থনে রাস্তায় নামলেন হাজার হাজার মানুষ। গুরুতর অসুস্থ যতীন দাসকে ড. গোপীচাঁদ এবং পুরুষোত্তম দাস ট্যান্ডন অনেক বুঝিয়েও জল ও ওষুধপত্র খাওয়াতে পারেননি সেইসময়। কারণ ছিল ইংরেজ সরকারের উপর তাঁর অবিশ্বাস এবং দেশ ও রাজনৈতিক বন্দীদের জন্য মর্যাদা তুলে ধরা।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৮১: তথাকথিত পরিচয়হীন প্রতিভার মূল্যায়ন কী শুধুই সাফল্যের নিরিখে সম্ভব?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

ভগৎ সিং থেকে শুরু করে পণ্ডিত শান্তনম, সর্দার শার্দুল সিং কবিশের ও ভগৎ সিং-এর পিতা সর্দার বিষণ সিং কারও কোনও অনুরোধ তিনি রাখেননি। ধীরে ধীরে শরীরের সাড়া না দেওয়া, একটা একটা করে বিকল হয়ে যাওয়া অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিয়ে তিনি নিঃশব্দ, নিশ্চিত মৃত্যু বরণ করেন ১৯২৯ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর টানা ৬৩ দিনের অনশনের পর। যতীন দাসের মৃত্যু সংবাদ আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ে লাহোর থেকে কলকাতা পর্যন্ত। যে ট্রেনে করে তাঁর মরদেহ কলকাতায় আনা হয় সেই ট্রেন দীর্ঘ যাত্রাপথের যে যে স্টেশনে দাঁড়ায় সেখানে কাতারে কাতারে মানুষ তাঁকে শেষবারের মতো দেখতে, শ্রদ্ধা জানাতে এগিয়ে আসেন। এলাহাবাদ স্টেশনে গাড়ি দাঁড়ালে অজস্র মানুষের ভিড়ে জওহরলাল নেহরু তাঁকে শ্রদ্ধা জানান। কলকাতায় সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে লক্ষাধিক মানুষ রাস্তায় নেমে পড়েন।

শোকস্তব্ধ জনতার মিছিল।

নেতাজি স্বয়ং কাঁধে তুলে নেন যতীন দাসের মরদেহ। কেওড়াতলা মহাশ্মশানের দিকে এগিয়ে যায় সেই বিশাল মিছিল। শান্তিনিকেতনে একটি নাটকের মহড়ায় ব্যস্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যতীন দাসের মৃত্যুর খবরে স্তম্ভিত হয়ে যান। বন্ধ করে দেন নাটকের মহড়া। লেখেন ‘সর্ব খর্ব তারে দহে তব ক্রোধ’। কাজী নজরুল ইসলাম লেখেন ‘যতীন দাস’ কবিতাটি। পরে তা ব্রিটিশ সরকার নিষিদ্ধ করেন। কিন্তু সেই মানুষটা? যিনি ছোটবেলা থেকে ছিলেন খাদ্যরসিক। কাছে টাকা থাকলেই বন্ধুদের নিয়ে খেতে যেতেন‌। ভালো কিছু খেতে আর খাওয়াতে পারলে কিছুই চাইতেন না, তিনি তো টানা ৬৩ দিন খাবার তো দূরস্থান জল পর্যন্ত খেলেন না! আর আমাদের জন্য রেখে গেলেন স্বাধীন আকাশের নিচে নিঃশ্বাস নেওয়ার অধিকার। আমরা কি পেরেছি ফিরিয়ে দিতে সেই প্রত্যয়ীর অঙ্গীকার?
* ড. বিদিশা মিশ্র বিগত পনেরো বছর ধরে সরকারি কলেজে, বর্তমানে কলকাতার লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত। তাঁর বিষয়— সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতি ছাত্রী বিদিশা স্নাতক ও স্নাতকোত্তর উভয় পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে তৃতীয় হন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল —বাঙালি নৈয়ায়িক চিরঞ্জীব ভট্টাচার্যের গ্রন্থ ‘কাব্যবিলাস’। তাঁর এই গবেষণা ২০২১ সালে কর্ণাটকের আইএনএসসি পাবলিশিং হাউস থেকে ‘দ্য কাব্যবিলাস অফ চিরঞ্জীব ভট্টাচার্য — এ ক্রিটিক্যাল স্টাডি’ শিরোণামে প্রকাশিত হয়। দেশের বিভিন্ন প্রদেশের পত্রিকায় তাঁর শোধপত্র প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানে তাঁর তত্ত্বাবধানে একাধিক স্কলার গবেষণারত। বিভিন্ন সরকারি কাজকর্ম ও অধ্যাপনার পাশাপাশি তিনি গুরুজি বিপ্লব মুখোপাধ্যায়ের কাছে হিন্দুস্থানি ক্লাসিক্যাল ও রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী জয়শ্রী দাসের কাছে রবীন্দ্রসংগীত শিক্ষারতা। ভ্রমণপিপাসু বিদিশা দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থান ঘুরেছেন, সেইসব অভিজ্ঞতা তাঁকে সমৃদ্ধ করেছে বলে তিনি মনে করেন।

Skip to content