
লতা ও পঞ্চম।
এতদিন ধরে সংগীতের আঙিনায় শতসহস্র সুগন্ধি ফুল ফোটাবার পরেও তাঁকে কি আবার নতুন করে অগ্নিপরীক্ষা দিতে হবে? এই প্রশ্নই যেন পঞ্চমকে কুড়ে কুড়ে খেতে থাকে। তিনি তো যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়েই চলতে চেয়েছেন। বহুক্ষেত্রে তাঁর রচিত সুর সময়ের থেকে এগিয়ে থেকেছে। একসঙ্গে সবাইকে যে খুশি করা যায় না সেটি তিনি বিলক্ষণ জানতেন। বিশেষ করে যে সময় নব প্রজন্মের সংগীতকারদের আবির্ভাব ঘটেছে। মানুষের রুচি বদলেছে। কিন্তু তার অর্থ তো এই নয় যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাঁর সংগীত উপেক্ষিত হবে!
আশির দশকের শেষ থেকে নিয়ে নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় এসেও, মাত্র হাতেগোনা কিছু পরিচালক এবং নির্দেশকের ডাক পেতে থাকেন আরডি বর্মণ! সে প্রায় না পাওয়ারই মতো। ভাবা যায়? হ্যাঁ, এটিই চরম সত্যি। এর হেতু বোধগম্য হয় না পঞ্চমের। কোথায় ঘাটতি থেকে যাচ্ছে? কোন সেই খামতি যা আরডি বর্মণকে করে তুলছে অপ্রাসঙ্গিক এবং গুরুত্বহীন? তিনি তো তাঁর সুরভাণ্ডার অকৃপণভাবে উজাড় করে দিতে প্রস্তুত। তবু কেন এই উপেক্ষা। তিনি দিবারাত্র ডুবে থাকেন এই চিন্তায়।
আশির দশকের শেষ থেকে নিয়ে নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় এসেও, মাত্র হাতেগোনা কিছু পরিচালক এবং নির্দেশকের ডাক পেতে থাকেন আরডি বর্মণ! সে প্রায় না পাওয়ারই মতো। ভাবা যায়? হ্যাঁ, এটিই চরম সত্যি। এর হেতু বোধগম্য হয় না পঞ্চমের। কোথায় ঘাটতি থেকে যাচ্ছে? কোন সেই খামতি যা আরডি বর্মণকে করে তুলছে অপ্রাসঙ্গিক এবং গুরুত্বহীন? তিনি তো তাঁর সুরভাণ্ডার অকৃপণভাবে উজাড় করে দিতে প্রস্তুত। তবু কেন এই উপেক্ষা। তিনি দিবারাত্র ডুবে থাকেন এই চিন্তায়।
এরই মধ্যে বন্ধু গুলজার নির্দেশিত ছবি ‘লিবাস’ এ কাজ করার ডাক আসে পঞ্চমের কাছে। খুব স্বাভাবিক কারণেই পঞ্চমকে বেছে নেন গুলজার। গানগুলি লেখা শেষ করে পঞ্চমের কাছে আসেন তিনি। গানের বিষয়বস্তু, দৃশ্য, প্রেক্ষাপট সব কিছু নিয়ে আলোচনা হয় দু’ জনের মধ্যে। কিছুদিন পর একে একে গানগুলিতে সুরারোপ করার কাজটি সম্পন্ন করে, সেগুলি সম্পর্কে গুলজারের মতামত জানতে চান পঞ্চম। এক কথায়, ভাষা হারিয়ে যায় গীতিকারের। তিনি নির্বাক হয়ে চেয়ে থাকেন সুরকারের দিকে। সেটি বিশেষ করে একটি নির্দিষ্ট গানের জন্য। এই গানটির সুরের ব্যাকরণটি যখন ব্যাখ্যা করেন পঞ্চম, আবেগ সামলাতে পারেননি এই স্বনামধন্য গীতিকার।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৬৫: নদীর পাড়ে উঠছে ধোঁয়া, মনে হয় কিছু হয়েছে…

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫১: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—পশুর, ধুধুল ও হাবল
কোন গানটির কথা বলছি? গানটি হল ‘সিলি হাওয়া ছুঁ গয়ি, সিলা বদন ছিল গয়া’। কোথা থেকে এই সুরের উৎপত্তি সেটি শুনলে আপনারাও যারপরনাই অবাক হবেন।
একটু ব্যাখ্যা করি। ‘সাসপেন্ডেড ফোর্থ’ বলে একটি কর্ড হয়। আপনারা অনেকেই জেনে থাকবেন, কর্ড হল কয়েকটি মিউজিক্যাল নোটের সমষ্টি। নোটগুলি একসঙ্গে বাজালে যে শব্দের উৎপত্তি হয়, সেটিকে কর্ড বলা হয় থাকে। এটির প্রচলন ছিল মূলত পাশ্চাত্য সংগীতেই। কিন্তু ধীরে ধীরে কর্ড ব্যবহার করার প্রবণতা সাড়া বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। এটি ব্যবহার করা হয় কোনও গান অথবা ইন্সট্রুমেন্টালের সঙ্গে সঙ্গত করার উদ্দেশ্যে। হারমোনিয়াম, পিয়ানো, স্প্যানিশ গিটার প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্রের সাহায্যে কর্ড বাজানো সম্ভব।
একটু ব্যাখ্যা করি। ‘সাসপেন্ডেড ফোর্থ’ বলে একটি কর্ড হয়। আপনারা অনেকেই জেনে থাকবেন, কর্ড হল কয়েকটি মিউজিক্যাল নোটের সমষ্টি। নোটগুলি একসঙ্গে বাজালে যে শব্দের উৎপত্তি হয়, সেটিকে কর্ড বলা হয় থাকে। এটির প্রচলন ছিল মূলত পাশ্চাত্য সংগীতেই। কিন্তু ধীরে ধীরে কর্ড ব্যবহার করার প্রবণতা সাড়া বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। এটি ব্যবহার করা হয় কোনও গান অথবা ইন্সট্রুমেন্টালের সঙ্গে সঙ্গত করার উদ্দেশ্যে। হারমোনিয়াম, পিয়ানো, স্প্যানিশ গিটার প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্রের সাহায্যে কর্ড বাজানো সম্ভব।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৫: সুর হারানো হারানো সুর

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯০: সাহেবের বেশ না-পরে ফিরেছিলেন সাহেবের দেশ থেকে
আসল বিষয়টি হল, পঞ্চম সেই ‘সাসপেন্ডেড ফোর্থ’ কর্ডের নোটগুলি থেকে উপরোক্ত গানটির সুরের কাঠামো তৈরি করেন। কী ভাবছেন? পঞ্চম গিটার অথবা পিয়ানো বাজানোয় সিদ্ধহস্ত ছিলেন? একদমই না। তবে কেমন করে এটি সম্ভব হল? কোনও একটি রিহার্সাল চলাকালীন এই কর্ডটি তাঁর কানে পৌঁছয়। সঙ্গে সঙ্গে রিহার্সাল থামিয়ে দিয়ে বাদককে অনুরোধ করেন কর্ডটি আরো একবার বাজাতে। কর্ডের নোটগুলি আলাদা আলাদা করে বাজাতে। বার বার বাজানোর অনুরোধ করেন। মাথায় রেখে দেন সেই নোটগুলি। সেগুলিই এই গানটির ক্ষেত্রে কাজে লেগে যায়।
কি অসাধারণ একটি সৃষ্টি! অত্যন্ত ধীর গতির একটি লয়ের উপর সুরটিকে বসানো হয়েছে। মেলোডির আবেদন এককথায় নিদারুণ। প্রেলুড, ইন্টারলুডগুলি সেই আবেদনকে করে তুলেছে গগনচুম্বী। এই গানের মাধ্যমে লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠের মায়াজালে সেই যে আমরা আবদ্ধ হয়ে পড়েছি, সেই বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়ার বিন্দুমাত্র সাধ্য আমাদের নেই। সার্বিকভাবে এই গানটির প্রভাব এতটাই।
কি অসাধারণ একটি সৃষ্টি! অত্যন্ত ধীর গতির একটি লয়ের উপর সুরটিকে বসানো হয়েছে। মেলোডির আবেদন এককথায় নিদারুণ। প্রেলুড, ইন্টারলুডগুলি সেই আবেদনকে করে তুলেছে গগনচুম্বী। এই গানের মাধ্যমে লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠের মায়াজালে সেই যে আমরা আবদ্ধ হয়ে পড়েছি, সেই বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়ার বিন্দুমাত্র সাধ্য আমাদের নেই। সার্বিকভাবে এই গানটির প্রভাব এতটাই।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২৫: অরু দত্ত— এক অভিশপ্ত গান্ধর্বী

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৩: এক্সপায়ারি ডেটের ওষুধ খাবেন?
শুধু কি তাই? এই ছবির ‘খামোশ সা আফসানা, পানি সে লিখা হোতা’ গানটির কথা একটিবার ভাবুনতো? প্রেলুডের অপার্থিব সৌন্দর্য। ধীর গতির লয়। বৈচিত্রে ভরা ইন্টারলুড। ভায়োলিনে অবলিগেটো। বেস গিটারের গাম্ভীর্য। বাঁশি এবং স্যাক্সোফোন এর উপযুক্ত প্রয়োগ। সর্বোপরি, মেলোডির অঝোর বারিধারায় স্নাত লতা মঙ্গেশকর এবং সুরেশ ওয়াদকারের কণ্ঠ। এই গানটির থেকে সুর সংগীতের শিক্ষা অর্জন করা যায় বইকি? এই গান আজও একই রকম আবেদনশীল।
পঞ্চমের রাগ-রাগিণীর জ্ঞানের পরিধি ঠিক কতখানি সেটি জানতে হলে এই ছবির ‘ফির কিসি শাখ নে’ গানটি আমাদের শুনতেই হবে। এমন একটি সুর রচনা করার ক্ষমতা বোধহয় শুধু সংগীতশিক্ষার মাধ্যমে অর্জন করা আক্ষরিক অর্থেই অসম্ভব। সুরের চলনটি লক্ষ্য করুন। লক্ষ্য করুন মুখরা এবং অন্তরাগুলির মধ্যে সূক্ষ্ম সংযোগগুলিও। লক্ষ্য করুন গানটির জন্য গায়িকা চয়নের বিষয়টি। হ্যাঁ, ঠিকই বুঝেছেন। আমি লতা মঙ্গেশকরের কথাই বলছি। সুরকার তো বটেই। এমনকি তাঁর জন্ম দেওয়া এই সুরটিও হয়তো লতাকণ্ঠকেই দাবি করে। রসায়নটি ভাবুন। লেখক গুলজার। সুরকার পঞ্চম। গায়িকা লতা মঙ্গেশকর। সুতরাং এই গানটি যে শ্রোতাদের মনের গভীরে একটি চিরস্থায়ী জায়গা করে নেবে তাতে আর আশ্চর্য হওয়ার অবকাশ কোথায়?
পঞ্চমের রাগ-রাগিণীর জ্ঞানের পরিধি ঠিক কতখানি সেটি জানতে হলে এই ছবির ‘ফির কিসি শাখ নে’ গানটি আমাদের শুনতেই হবে। এমন একটি সুর রচনা করার ক্ষমতা বোধহয় শুধু সংগীতশিক্ষার মাধ্যমে অর্জন করা আক্ষরিক অর্থেই অসম্ভব। সুরের চলনটি লক্ষ্য করুন। লক্ষ্য করুন মুখরা এবং অন্তরাগুলির মধ্যে সূক্ষ্ম সংযোগগুলিও। লক্ষ্য করুন গানটির জন্য গায়িকা চয়নের বিষয়টি। হ্যাঁ, ঠিকই বুঝেছেন। আমি লতা মঙ্গেশকরের কথাই বলছি। সুরকার তো বটেই। এমনকি তাঁর জন্ম দেওয়া এই সুরটিও হয়তো লতাকণ্ঠকেই দাবি করে। রসায়নটি ভাবুন। লেখক গুলজার। সুরকার পঞ্চম। গায়িকা লতা মঙ্গেশকর। সুতরাং এই গানটি যে শ্রোতাদের মনের গভীরে একটি চিরস্থায়ী জায়গা করে নেবে তাতে আর আশ্চর্য হওয়ার অবকাশ কোথায়?
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩৩: এখনও সারেঙ্গিটা বাজছে

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬৫: রাজা যযাতির উপাখ্যান—পৌরবদের বর্ণ বিপর্যয় না উত্তরণের কাহিনি?
তাই হলোপ করে এটি বলা যেতেই পারে যে সেই সময়, যখন আপাতদৃষ্টিতে তৎকালীন প্রযোজক এবং নির্দেশকদের কাছে পঞ্চমের গুরুত্ব কমে আসছে, তখন এই ছবির গানগুলি সেই সব প্রযোজক এবং নির্দেশকদের বিরুদ্ধে যেন প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেছিল। সে যেন এক নিঃশব্দ প্রতিবাদ। প্রতিবাদ সেই উপেক্ষার বিরুদ্ধে। প্রতিবাদ সেই বদলে যাওয়া সময়ের বিরুদ্ধে। এই ছবির গানগুলি তাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল যে পঞ্চমের সুরভাণ্ডার তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুনের অক্ষয়তুনের মতোই। তাই গুলজারের মতো কেউ অন্য কোনো স্রোতে না বয়ে গিয়ে পঞ্চমকে ডেকে নেন নিজের কাছে। নিজের সন্তানসম রচনাগুলি নির্ভয়ে তুলে দেন পঞ্চমের সুরক্ষিত হাতে। প্রাণ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে। অবশ্যই সুরের মাধ্যমে। তাঁর চোখ যে জহুরির। রত্ন চিনতে তিনি ভুল করবেন কীভাবে?
* পঞ্চমে মেলোডি (R D Burman): সৌম্য ভৌমিক, (Shoummo Bhoumik) সঙ্গীত শিল্পী।