মঙ্গলবার ৯ জুলাই, ২০২৪


স্বামী বিবেকানন্দ, গিরিশচন্দ্র ঘোষ ও শ্রীরামকৃষ্ণদেব।

শ্রীশ্রী ঠাকুর, শ্রীমা স্বামীজির আবির্ভাব, নতুন কোনও একটি সম্প্রদায়ের জন্য নয়। আবির্ভাবের মূল উদ্দেশ্য ছিল বেদের পুনরুত্থান। সনাতন আদর্শকে জাগরিত করা। তিনি বলতেন, “নবাবী আমলের মুদ্রা বাদশাহী আমলে চলে না।” তিনি সেই একই পুরুষ, মূল তত্ত্বকে এক রেখে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গ্রহণ উপযোগী করার মানসে আবার জন্মগ্রহণ করেছেন। এটাও পরিষ্কার যে, আধুনিক যুগে মানুষের জীবন ধারার সঙ্গে সঙ্গে তাদের মন সাম্রাজ্যেরও পরিবর্তন হয়েছে। তাই প্রয়োজন অনুযায়ী পথ আরও সহজ-সরল দরকার। তাই তিনি নিজেই নতুন পথ নির্দেশ করলেন, “আমি যে রূপে বলিতেছি সেই রূপ যদি চলিয়া যাস তাহা হইলে সোজাসুজি গন্তব্যস্থলে পৌঁছাইয়া যাইবি।” তাই সাধারণ মানুষের আর সন্দেহ থাকে না কেন পথে গেলে ঈশ্বরের উপলব্ধি সহজে হবে।
আবার তিনিই সেই এক চৈতন্য পুরুষ কি না সে সন্দেহ দূর করেছেন, যেমন পূর্ব যুগে অবতারগণ বলছেন, তেমনই অভয় প্রদান করে বলেছেন, “যাহার শেষ জন্ম, যাহার সংসারে পুনঃ পুনঃ আগমনের ও জন্ম মরণের শেষ হইয়াছে, সেই ব্যক্তিই এখানে আসবে এবং এখানকার ভাব গ্রহণ করতে পারবে।” তিনিই যে সমস্ত দেবদেবী এবং যা কিছুই প্রকাশিত তারও স্বরূপ, তাও ঘোষণা করছেন, “তোমার ইষ্ট (উপাস্য দেবতা) ইহার আপনাকে দেখাইয়া) ভেতরে আছেন, ইহাকে ভাবলে তাকেই ভাবা হইবে।”
আরও পড়ুন:

অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-৬০: যা কিছু মোর সবই তোমার…

এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-৩: ত্রিপুরা সমৃদ্ধিতে রাজা বিজয় মাণিক্যের ভূমিকা অপরিসীম

রামকৃষ্ণদেবের কোনও একজন ভক্ত লেখক, যাঁরা শ্রীরামকৃষ্ণকে ঈশ্বরাবতার বলে বিশ্বাস করেন না, তাদের প্রতি কটাক্ষ করেছিলেন। স্বামীজি তাঁকে ডেকে উত্তেজিত হয়ে বলতে লাগলেন, “তোর এমন করে সকলকে গাল দিয়ে লেখবার কি দরকার ছিল? তোর ঠাকুরকে বিশ্বাস করে না তার কি হয়েছে? আমরা কি একটা দল করছি নাকি, আমরা কি রামকৃষ্ণ ভজার, যে তাকে যে না বুঝবে সে আমাদের শত্রু? তুই তো তাকে নীচু করে ফেললি, তাকে ছোট করে ফেললি। যে যেমন করে ডাকুক তাকেই তো ডাকছে। তবে সবাইকে তুই গাল দেওয়ার কে? না, গাল দিলেই তোর কথা শুনবে? আহাম্মক! মাথা দিতে পারিস তবে মাথা নিতে পারবি, নইলে তোর কথা লোকে নেবে কেন?”

একটু স্থির হয়ে স্বামীজি পুনরায় বলতে লাগলেন, “বীর না হলে কি কেউ বিশ্বাস করতে পারে, না নির্ভর করতে পারে? বীর না হলে হিংসা দ্বেষ যায় না, তা সভ্য হবে কি? সেই ম্যানলি (পুরুষোচিত) শক্তি, সেই বীরভাব তোদের দেশে কই? নেই, নেই। সে ভাব ঢের খুঁজে দেখেছি, একটা বই দুটো দেখতে পাইনি।”

কার দেখেছো স্বামীজি স্বামীজি?
“এক জি.সি-র (গিরিশচন্দ্র) দেখেছি যথার্থ নির্ভর, ঠিক দাসভাব; মাথা দিতে প্রস্তুত। তাই না ঠাকুর তাঁর আমমোক্তারনামা নিয়ে ছিলেন। কি নির্ভর! এমন আর দেখলুম না, নির্ভর তার কাছে শিখেছি।” এই বলে স্বামীজি হাত তুলে গিরিশবাবুর উদ্দেশ্যে নমস্কার করলেন। প্রকৃত ভক্তের নির্ভরশীলতা আর বীর পুরুষোচিত ভাবের সংমিশ্রণ গিরিশের মতো মাহাত্ম্যদেরই দেখা যায়। তিনি ছিলেন ভক্ত ভৈরব।
আরও পড়ুন:

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৫০: অর্ধশতাব্দী ছুঁলো ‘অমানুষ’

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪২: অ্যান্টিবায়োটিক খেলেই গন্ডগোল?

ভক্তি পথের পথিক আর ভক্তি লাভ হওয়ার মধ্যে অনেক পার্থক্য, এই যেমন অনেক পার্থক্য ব্রাহ্মণ জাতি ও ব্রাহ্মণগুনের মধ্যে। ঠিক যেমন আসল সোনা আর নকল সোনার মতো পার্থক্য। প্রত্যেকের ভিতর সত্ত্বঃ রজঃ, তমঃ তিন গুণের মিশ্রণ আছে। প্রকৃতির গুণের প্রাধান্যে, তার আচার-আচরণ সেরকম হয়। সংস্কার কর্মের গুণে তার পরিবর্তনও হয়ে থাকে। স্বামীজি জোর করে বলতেন, আমাদেরকে ব্রাহ্মণ্যত্বে উন্নীত হতে হবে। মানে যে সত্ত্ব গুণে উন্নীত হলে দয়া, ক্ষমা, প্রেম জ্ঞান, বৈরাগ্য, শ্রী (সম্পদ ও সৌন্দর্য) ইত্যাদি সকল গুণ সম্পন্ন হবে। ধর্মপরায়ণ সৎগুণ সম্পদের অধিকারী চাই। তবেই প্রকৃত ব্রাহ্মণ্যত্বের জাগরণ হবে।
আরও পড়ুন:

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৩৫: ঘুম ঘুম চাঁদ ঝিকিমিকি তারা

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫৪: রাজনীতিতে, যুগান্তরেও স্বার্থচিন্তার আবহমান প্রভাব

স্বামীজি প্রিয়নাথ সিংহকে আমেরিকা থেকে ফিরে অভিজ্ঞতা বলছেন। প্রিয়নাথ সিংহ তাঁর বাল্যবন্ধু। তিনি বলেছেন, “ব্রাহ্মণ জাতি আর ব্রাহ্মণের গুণ দুটো আলাদা জিনিস। এখানে সব জাতিতে ব্রাহ্মণ সেখানে গুণে। যেমন সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ তিনটে গুণ আছে জানিস, তেমনি ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র বলে গণ্য হবার গুণও আছে। এই তোদের দেশে ক্ষত্রিয় গুণটা যেমন প্রায় লোপ পেয়ে গেছে, তেমনি ব্রাহ্মণ গুণটাও প্রায় লোপ পেয়ে গেছে। ও দেশে এখন সব ক্ষত্রিয়ত্ব থেকে ব্রাহ্মণত্ব পাচ্ছে।”
“তার মানে সেখানকার সাত্ত্বিক তুমি ব্রাহ্মণ বলছো?”
“তাই বটে। সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ যেমন সকলের মধ্যে আছে—কোনটা কার মধ্যে কম; কোনটা কার মধ্যে বেশি; তেমনি ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র হবার কয়টা গুন সকলের মধ্যে আছে। তবে এই কয়টা গুণ সময়ে সময়ে কম বেশি হয়, আর সময়ে সময়ে এক একটা প্রকাশ হয়। একটা লোক যখন চাকরি করে তখন সে শূদ্রত্ব পায়, যখন দু’ পয়সা রোজগারের ফিকিরে থাকে, তখন বৈশ্য; আর যখন মারামারি ইত্যাদি করে তখন তার ভিতর ক্ষত্রিত্ব প্রকাশ পায়। আর যখন সে ভগবানের চিন্তা ও ভগবত প্রসঙ্গ থাকে তখন সে ব্রাহ্মণ। এক জাতি থেকে আর এক জাতি হয়ে যাওয়াও স্বাভাবিক। বিশ্বামিত্র আর পরশুরাম—একজন ব্রাহ্মণ ও অপর জন ক্ষত্রিয় কেমন করে হলো?”

ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পুনর্জাগরণের জন্য আবার নতুন রূপে তাদের আবির্ভাব। —চলবে।
* অনন্ত এক পথ পরিক্রমা (Ananta Ek Patha Parikrama) : স্বামী তত্ত্বাতীতানন্দ (Swami Tattwatitananda), সম্পাদক, রামকৃষ্ণ মিশন, ফিজি (Fiji)।

Skip to content