স্বামী বিবেকানন্দ।
আজকাল বিষম ভাবনার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মনে খুব বেশি পরিমাণে মাথা ছাড়া দিয়েছে, উঁচু-নিচু, জাতপাত, ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়, দ্বৈত-অদ্বৈত, বৈষ্ণব-শাক্ত-বেদান্তি, বিভিন্ন ধরনের মতপার্থক্য। স্বাধীন সাপেক্ষ যে সর্বোচ্চ তত্ত্ব, তা সহজে প্রাপ্ত হব আমরা মনে করে, ও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ি। কেন আমরা দ্বন্দ্ব এড়িয়ে যেতে পারি না বা কেন আমরা সুখ-দুঃখের সংসারে বারবার পতিত হই? এর কী কোনও উপায় আছে? যা আমাদের মনের মলিনতা দূর করে সত্য পথের অনুসন্ধান দিবে।
এ তথ্যের অনুধাবন যথেষ্ট পরিমাণে হয় না। এর জন্যই দ্বন্দ্বের সূচনা হয় এবং বিশৃঙ্খলা সমাজের মধ্যে বারংবার হানা দিয়ে থাকে। আবার আমারা মত, পথকে ধর্ম মনে করে তা নিয়ে দ্বন্দ্বে মত্ত হয়ে পড়ি। আসল ধর্মলাভ হলে তখন আর দন্দ্ব থাকে না। এর উপায় হল অদ্বৈত তত্ত্বের অনুভব, তা ভক্তি ভাবে বা জ্ঞানের দ্বারা বা কর্মীর অনুশীলনে বা যোগ সাধনের দ্বারা হতে পারে। সকল মতের সমন্বয় ও আপাত বিরোধী ভাব গুলি যে এক তত্ত্বকেই ইঙ্গিত করে তা অনুভব করা।
আরও পড়ুন:
অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-৭৩: শরীরের প্রতি যেমন বেশি যত্নের দরকার নেই, তেমন অযত্ন করাও উচিত নয়
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৭০: পিতার সমালোচক রাম শুধুই মানুষ, তবু তিনি কেন পুরুষোত্তম?
কীভাবে এই সকল যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে পারি? শ্রীরামকৃষ্ণ, এই মায়াময় সংসারে ইতিবাচক সত্যকে তুলে ধরে মায়ার পারে যেতে বারবার বলছেন। মায়ার পারে যাওয়ার সহজ উপায় মায়াকে চেনা। কৃপা প্রার্থনা করা। যে তিন অবস্থায় সাক্ষী স্বরূপ, সর্বক্ষণ বর্তমান, তাঁকে উপলব্ধি করা। শ্রীরামকৃষ্ণ একটি সুন্দর গল্প বলেছেন, এক ব্যক্তি একটি বাঘের ছাল পরে এসে সবাইকে ভয় দেখাতে শুরু করল। সকলে ভয় পেল। কিন্তু একজন তাকে চিন্তে পেরে, তার নাম করে ডাকতেই সে পালিয়ে গেল। অর্থাৎ মায়াকে চিন্তে পারলেই, সে পালিয়ে যায়। স্বপ্ন যেমন মিথ্যা, তেমন জাগরণ অবস্থাও সত্য নয়, এটি অনুভব করা। এর পারে নিত্য বস্তু সেই এক আত্মা সব অবস্থায় বর্তমান।
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫৩: মহীয়সী গৃহস্থনারী মা সারদা
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৫: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— আমুর ও গোশিঙা
শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, “ব্রহ্ম- জীবজগৎ বিশিষ্ট। প্রথম নেতি নেতি করবার সময় জীবজগৎ কে ছেড়ে দিতে হয়। অহংবুদ্ধি যতক্ষণ, ততক্ষণ তিনিই সব হয়েছেন এই বোধ হয়,– তিনি চতুর্বিংশতি তত্ত্ব হয়েছেন। বেলের সার বলতে গেলে শাঁসই বুঝায়। তখন বিচিয়ার খোলা ফেলে দিতে হয়। কিন্তু বেলটা কতজন ছিল বলতে গেলে শুধু শাঁসের ওজন করলে হবে না। ওজনের সময় শাঁস, বিচি, খোলা সব নিতে হবে যারই শাঁস তারই বিচি, তারই খোলা। যাঁরই তারই নিত্য তাঁরই লীলা। তিনি তাই আমি নিত্য, লীলা সবই লই। মায়া বলে জগত সংসার উড়িয়ে দিই না। তাহলে যে ওজনে কম পড়বে।” (কথামৃত পৃঃ ৬৯১)
আরও পড়ুন:
বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-২: যতই দেখি তারে, ততই দহি…
রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৭৩: জোর কা ঝটকা
সত্য এক ও অদ্বিতীয়। তাঁর প্রকাশ ভিন্ন ভিন্ন ভাবে হতে পারে। নাম ও রূপের পার্থক্য মাত্র। এক সেই চৈতন্য। এক সমুদ্রের জল ভিন্ন ভিন্ন পাত্রে ঢালার পর যেমন বালতির জল, কলসির জল, ঘটির জল নামে ডাকা হয়।
স্বামীজি ‘সর্বাবয়ব বেদান্ত’ বক্তব্যে বলছেন, “ঈশ্বর-কৃপায় আমার এমন এক ব্যক্তির পদতলে বসিয়া শিক্ষালাভের সৌভাগ্য হইয়াছিল, যাঁহার সমগ্র জীবনই উপনিষদের সমন্বয়মূলক ব্যাখ্যা সরূপ—যাঁহার জীবন তাঁহার উপদেশ অপেক্ষা সহস্রগুণে উপনিষদ মন্ত্রের জীবন্ত ভাষ্য স্বরূপ, বস্তুত তিনি ছিলেন উপনিষদের ভাবমূর্তির মূর্তি বিগ্রহ। সম্ভবত সেই সমন্বয়ের ভাব আমার ভেতরে কিছুটা আসিয়াছে। আমি জানি না, জগতের কাছে উহা প্রকাশ করিতে পারিব কি না। কিন্তু বৈদান্তিক সম্প্রদায়গুলি যে পরস্পর বিরোধী নহে, পরস্পর সাপেক্ষ, একটি যেন অন্যটির সোপান স্বরূপ এবং সর্বশেষ চরম লক্ষ্য অদ্বৈতে—’তত্ত্বমসি’তে পর্যবসিত, ইহা দেখানোই আমার জীবন ব্রত।”
স্বামীজি ‘সর্বাবয়ব বেদান্ত’ বক্তব্যে বলছেন, “ঈশ্বর-কৃপায় আমার এমন এক ব্যক্তির পদতলে বসিয়া শিক্ষালাভের সৌভাগ্য হইয়াছিল, যাঁহার সমগ্র জীবনই উপনিষদের সমন্বয়মূলক ব্যাখ্যা সরূপ—যাঁহার জীবন তাঁহার উপদেশ অপেক্ষা সহস্রগুণে উপনিষদ মন্ত্রের জীবন্ত ভাষ্য স্বরূপ, বস্তুত তিনি ছিলেন উপনিষদের ভাবমূর্তির মূর্তি বিগ্রহ। সম্ভবত সেই সমন্বয়ের ভাব আমার ভেতরে কিছুটা আসিয়াছে। আমি জানি না, জগতের কাছে উহা প্রকাশ করিতে পারিব কি না। কিন্তু বৈদান্তিক সম্প্রদায়গুলি যে পরস্পর বিরোধী নহে, পরস্পর সাপেক্ষ, একটি যেন অন্যটির সোপান স্বরূপ এবং সর্বশেষ চরম লক্ষ্য অদ্বৈতে—’তত্ত্বমসি’তে পর্যবসিত, ইহা দেখানোই আমার জীবন ব্রত।”
আরও পড়ুন:
হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৪৩: ইউ এফ ও
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৩: বাবু ডাক্তার ও ‘ডাক্তারবাবু’
পরস্পর সংযুক্ত, একে অন্যের পরিপূরক। মাত্রার পার্থক্য মাত্র, এই উপলব্ধি ও সমন্বয়ের মাধ্যম দ্বন্দ্বের সমাধান ই লক্ষ্য। শ্রীশ্রীঠাকুর, শ্রীশ্রীমা, স্বামীজির সবসময়ই এই সূত্র, জীবন আদর্শের মাধ্যমে দেখিয়েছেন।
শ্রীশ্রীমাকে একদিন উচ্ছিষ্ট পরিষ্কার করতে দেখে, নলিনীদিদি বলেছিলেন, “মাগো, ছত্রিশ জাতের এঁটো কুড়ুচ্ছে!” শ্রীমা তা শুনে বলেছিলেন, সব যে আমার, ছত্রিশ কোথা?” যিনি সকলকে আপনার সন্তান রূপে দেখতেন, যার কাছে জাতপাত, উচ্চ নিচ, পাপী ভক্ত, পশু পাখির ভেদ, অভেদ দর্শনে পর্যবসিত হয়ে ছিল তাঁর কাছে জাগতিক ভেদ স্থান পাবে কীভাবে? তাঁর জগতের সমস্ত প্রাণীর প্রতি মাতৃস্নেহ-প্লাবনে উচ্চ নিচ সমস্ত ভূমি ডুবে গিয়ে একাকার হয়ে যায়। শ্রীরামকৃষ্ণ, শ্রীমা ও স্বামীজির রসায়নে সকল দ্বন্দ্বের অবসানে সমন্বয়, পরম সত্য ও আত্যন্তিক শান্তি ছিল মূল লক্ষ্য।—চলবে।
শ্রীশ্রীমাকে একদিন উচ্ছিষ্ট পরিষ্কার করতে দেখে, নলিনীদিদি বলেছিলেন, “মাগো, ছত্রিশ জাতের এঁটো কুড়ুচ্ছে!” শ্রীমা তা শুনে বলেছিলেন, সব যে আমার, ছত্রিশ কোথা?” যিনি সকলকে আপনার সন্তান রূপে দেখতেন, যার কাছে জাতপাত, উচ্চ নিচ, পাপী ভক্ত, পশু পাখির ভেদ, অভেদ দর্শনে পর্যবসিত হয়ে ছিল তাঁর কাছে জাগতিক ভেদ স্থান পাবে কীভাবে? তাঁর জগতের সমস্ত প্রাণীর প্রতি মাতৃস্নেহ-প্লাবনে উচ্চ নিচ সমস্ত ভূমি ডুবে গিয়ে একাকার হয়ে যায়। শ্রীরামকৃষ্ণ, শ্রীমা ও স্বামীজির রসায়নে সকল দ্বন্দ্বের অবসানে সমন্বয়, পরম সত্য ও আত্যন্তিক শান্তি ছিল মূল লক্ষ্য।—চলবে।
* অনন্ত এক পথ পরিক্রমা (Ananta Ek Patha Parikrama) : স্বামী তত্ত্বাতীতানন্দ (Swami Tattwatitananda), সম্পাদক, রামকৃষ্ণ মিশন, ফিজি (Fiji)।