বুধবার ৪ ডিসেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী।

পর্ব-৬৬: মিত্রসম্প্ৰাপ্তি

ছাগলের পাল যখন গোধূলিতে ঘরে ফেরে, তখন তাদের পায়ে পায়ে ওঠা ধূলির দিকে যেমন কেউ নজর দেয় না তেমনই নির্ধন ব্যক্তির দিকেও কেউ নজর দেয় না। শৌচ ক্রিয়ার সময়ে সামান্য মাটিরও প্রয়োজন হয় অঙ্গ পরিষ্কার করবার জন্য কিন্তু দরিদ্র ব্যক্তিকে দিয়ে কোনো প্রয়োজনই সিদ্ধ হয় না। দুর্ভাগ্য এমনই যে কোনও নির্ধন ব্যক্তি যদি কোনও ধনি ব্যক্তির ঘরে কিছু দান করবার ইচ্ছাতেও আসেন তাহলেও লোকে ভাবে সে হয়তো কিছু চাইতেই এসেছে। দরিদ্রের কপাল থেকে যাচক-নামের কলঙ্ক ঘোছে না। জীবনে দারিদ্র এক বিরাট অভিশাপ।

তাই স্থির করলাম যে সেই পরিব্রাজকদের বালিশের নিচ থেকে ধন চুরি করতে গিয়ে যদি মৃত্যুও হয় সেও ভালো। কারণ যে ব্যক্তি নিজের সম্পত্তিকে চোখের সামনে হরণ হয়ে যেতে দেখেও তা রক্ষা করবার চেষ্টা করে না, শুধু নিজের প্রাণটুকুকেই বাঁচাবারই চেষ্টা করে, শ্রাদ্ধের সময়ে সেই ব্যক্তির প্রদত্ত অন্নজল তার পূর্বপুরুষেরা গ্রহণ করে না। সে পরিবারের একটি কলঙ্ক ছাড়া আর কিছুই নয়। শাস্ত্রকাররা বলেছেন, যে ব্যক্তি ব্রাহ্মণের জীবন রক্ষা করবার জন্য প্রচেষ্টা করে না কিংবা স্ত্রীলোককে অপহরণের সময়েও বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে না তার থেকে অধম ব্যক্তি দুনিয়ায় নেই। এমনকি নিজের ধনসম্পত্তি হরণ হতে দেখেও যে রক্ষা করে না তার জীবনে অক্ষয়লোক প্রাপ্তি লেখা নেই।

রাতে সেই পরিব্রাজক দু’জন ঘুমালে তাদের বালিশের তলায় রাখা সেই ধনের পেটিতে যেই ছিদ্র করেছি তখনই সেই দুষ্ট পরিব্রাজক ঘুম ভেঙে উঠে বসলো। একটা পুরোনো ফাটা বাঁশ নিয়ে আমার মাথায় সে এমন ভাবে মারলো যে শুধু আয়ু ছিল বলে প্রাণে বেঁচে গেলাম, না হলে সেইদিনই আমার মৃত্যু অনিবার্য ছিল। সত্যি বললে, মানুষের ভাগ্যে যেটা পাওয়ার থাকে সেটা সে পাবেই—কোনও দৈব শক্তিই তা পেতে তাকে বাধা দিতে সমর্থ হয় না। এই কারণে কিছু না পেলে আমার মনে এখন শোকও হয় না আবার কিছু আকস্মিক পেয়ে গেলে আশ্চর্যও লাগে না। কারণ যেটা আমার প্রাপ্য সেটা অন্যের কপালে জোটে না—এইটুকু আমি বুঝেছি। হিরণ্যকের কথা শুনে সেই কাক আর কচ্ছপ বলল, ‘কথমেতৎ”—এই ঘটনাটা আবার কি রকম?
হিরণ্যক তখন বলতে শুরু করলো—

০৪: বণিকপুত্রের কাহিনি

কোনও এক নগরে সাগরদত্ত নামে এক বণিক ছিল। তার পুত্র একদিন একশো টাকায় একটা বই বিক্রি হতে দেখে সেটি গিয়ে কিনে আনলো। সেই বইটাতে একটিই মাত্র শ্লোক লেখা ছিল—

প্রাপ্তব্যমর্থং লভতে মনুষ্যো দেবোঽপি তং লঙ্ঘযিতুং ন শক্তঃ।
তস্মান্নশোচামি ন বিস্মযো মে যদস্মদীযং ন হি তৎ পরেষাম্‌।। (মিত্রসম্প্রাপ্তি ১১১)


অর্থাৎ মানুষ নিজের প্রাপ্য জিনিষ টুকু অবশ্যই পেয়ে থাকে, কোনও দৈবশক্তিতেই সে প্রাপ্তি লঙ্ঘিত হয় না। তাই আমি শোকগ্রস্তও হই না আশ্চর্যও হই না। যা আমার ভাগ্যে আছে তা অন্যের মিলবে না—এটা আমি নিশ্চিত। পুত্রের কেনা বইতে লেখা এই শ্লোকটি দেখে সাগরদত্ত তাঁর পুত্রকে জিজ্ঞাসা করলেন, হে পুত্র! এই বইটি তুমি কতো টাকা দিয়ে কিনেছো?
উত্তরে সে বলল, ‘রূপকশতেন’ —একশো টাকায় মাত্র।
সাগরদত্ত তা শুনে রেগে গিয়ে বলল, ওরে মূর্খ! তোকে ধিক্‌! তুমি যদি একটা লিখিত শ্লোক একশো টাকায় কিনে থাকো তো এই বুদ্ধি নিয়ে তুমি কিভাবে দ্রব্যার্জন করবে? তাই আজ থেকে তুমি আর আমার বাড়িতে ঢুকবে না।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৬৫: টাকা না থাকলে নির্ধন ব্যক্তির বন্ধুও শত্রু হয়

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০১: খামখেয়ালির গিরীন্দ্রনাথ

এ ভাবে খুব বকাঝকা করে সাগরদত্ত তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিল। সে তখন উদাসীন হয়ে বহুদূর দেশে অবস্থিত এক নগরে গিয়ে বাস করতে শুরু করলো। কিছুদিন পরে সেই নগরের এক অধিবাসী সেই বণিকপুত্রের কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কে ভাই? কোথা থেকে এসেছেন? আপনার নাম কি?
সে বলল, “প্রাপ্তব্যমর্থং লভতে মনুষ্য” —মানুষ নিজের প্রাপ্য জিনিষ টুকু অবশ্যই পেয়ে থাকে।
অন্যান্য লোকেরাও তাকে কিছু জিজ্ঞাসা করলে তাদেরকেও সেই বণিকপুত্র একই কথা বলে। ফলে গোটা নগরে সে “প্রাপ্তব্যমর্থম্‌” নামেই পরিচিত হয়ে গেল।
এরপর একদিন পরিপূর্ণ রূপযৌবনসম্পন্না সে দেশের রাজকুমারী চন্দ্রাবতী কোনও এক বড় উত্সবের দিন এক সখীকে সঙ্গে নিয়ে নগর পরিভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। সেখানে ঘুড়তে ঘুরতে সেই চন্দ্রবতী কোনও দেশের এক অচেনা রাজকুমারকে দেখে একেবারে কামবাণে ঘায়েল হলেন। সঙ্গের সখীটিকে বললেন, সখি! তুমি এমন কিছু একটা ব্যবস্থা করো যাতে আজকেই আমার সঙ্গে তার সমাগম হতে পারে।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭৬: সুন্দরবনের পাখি—কুরচি বক

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪৫: ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা এবং চলচ্চিত্র

রাজকুমারীর মনোগত অভিপ্রায় বুঝে সেই সখী তখনই সেই রাজকুমারের কাছে গিয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে বললে, রাজকুমারী চন্দ্রাবতী আমাকে পাঠিয়েছেন। তিনি আপনাকে বলতে বলেছেন যে আপনাকে দেখেই তিনি কামে পরিপূর্ণ হয়ে প্রায় অন্তিম দশা প্রাপ্ত হয়েছেন। তাই শীঘ্রই যদি আপনি তাঁর কাছে না আসেন তবে সে কামজ্বালা মেটাতে তিনি মৃত্যুরই আশ্রয় নেবেন।
সখীর কথা শুনে সেই রাজপুত্র তখন জিজ্ঞাসা করলেন, যদি সত্যিই আমার তাঁর কাছে যাওয়াটা এতোটাই গুরুত্বপূর্ণ হয় তবে বলুন কিভাবে আমি রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করতে পারি?
সখীটি তখন বলল, রাত্রে রাজপ্রাসাদের দেওয়ালে মোটা দড়ি দেখতে পাবেন, তাই বেয়েই আপনি সোজা রাজন্তঃপুরে প্রবেশ করতে পারবেন।
রাজপুত্র বললেন, এইটাই যদি পন্থা হয় তবে আমি তাই করবো।
রাজপুত্রের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করে সে ফিরে গেলো রাজকন্যা চন্দ্রাবতীর কাছে।
রাত্রি যখন গভীর হতে শুরু করলো তখন রাজপুত্র মনে মনে বিচার করতে শুরু করলেন, আরে! এ তো খুবই নিন্দিত একটি কাজ। কথায় বলে, গুরুর কন্যা, মিত্রের স্ত্রী এবং স্বামী ও সেবকের পত্নীর সঙ্গে যে ব্যক্তি সম্ভোগ করে তাকে ব্রহ্মঘাতী বলা হয়। অর্থাৎ সে ব্যক্তি ব্রহ্মহত্যার সমান পাপের ভাগী হন। এছাড়াও, যে কাজ করলে অপকীর্তির প্রচার হয় কিংবা অধোগতি প্রাপ্তি হয় সে কাজ কখনই করা উচিত নয়।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭৬: সুন্দরবনের পাখি—কুরচি বক

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৩: হৃদয়পুরের লক্ষ্যপূরণ ‘কঙ্কাবতীর ঘাট’

এইসব বিভিন্ন রকম চিন্তাভাবনা করে সেই রাজপুত্র রাত্রে চন্দ্রাবতীর কাছে গেলেন না। এদিকে ‘প্রাতব্যমর্থ’ ঘুরতে ঘুরতে রাজমহলের কাছে পৌঁছে সেখানে দড়ি ঝুলতে দেখে ভারি আশ্চর্য হল। মনের কৌতুহল মেটাতে সে সেই দড়ি ধরে উপরে উঠে এল। রাজকুমারী চন্দ্রাবতী তাঁকে সেই রাজকুমার মনে করে নিশ্চিন্ত হয়ে স্নানান্তে তাঁকে পান, ভোজন এবং বস্ত্র প্রভৃতি দিয়ে শয্যায় বসিয়ে তাঁর অঙ্গস্পর্শ করে রোমাঞ্চিত হতে হতে বললেন, তোমাকে দেখে আমি এতোটাই অনুরক্ত হয়ে গিয়েছি যে আমি নিজেকে তোমার কাছে সমর্পিত করে দিলাম। তোমাকে ছাড়া মনে মনেও আমি অন্য কাউকে নিজের পতি মানতে পারবো না। তুমি কেন আমার সঙ্গে কথা বলছো না?
সে উত্তরে সেই একই বুলি আওড়ালো, ‘প্রাপ্তব্যমর্থং লভতে মনুষ্যঃ’ —মানুষ যা পাওয়ার সেটাই পাবে।

রাজকুমারী বুঝলো সে ভিন্ন লোক—তাঁর ভুল হয়েছে। রাজপ্রাসাদ থেকে তাকে বের করে রাজকুমারী তাঁকে তখন রাস্তায় ছেড়ে দিল। সে তখন ভাঙাচোরা একটা মন্দিরের মধ্যে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
সেখানে দণ্ডপাশক নামে এক নগররক্ষক কোনও এক দুরাচারিণীর স্ত্রীর সঙ্কেত পেয়ে এসেছিল মিলিত হতে। কিন্তু সেখানে আগে থেকেই সেই বণিকপুত্রকে শুয়ে থাকতে দেখে নিজের পরিচয় তার কাছে গোপন রাখবার কন্য বলল, আপনি কে?
বণিকপুত্র উত্তরে বলল, প্রাপ্তব্যমর্থং লভতে মনুষ্যঃ।’
এই শুনে নগররক্ষক বললেন, এই দেবমন্দির নির্জন। তাই আমার জায়গায় গিয়ে শুয়ে থাকো। নগররক্ষকের কথা শুনে সেই বণিকপুত্র সেখান থেকে উঠে গিয়ে, যেখানে শোয়ার কথা নগররক্ষক বলেছিলেন, ভুল করে অন্যত্র শয্যায় গিয়ে শুয়ে পড়লেন। সেই শয্যায় সেই নগররক্ষকের রূপযৌবনসম্পন্না কন্যা বিনয়বতী অন্য কোনও এক পুরুষে অনুরক্ত হয়ে তাকে সঙ্কেত দিয়ে তার অপেক্ষায় শুয়ে ছিল।
আরও পড়ুন:

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-১৪: আমি তাইতে কি ভয় মানি!

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৪৬: আলাস্কার আকাশে অহরহ ব্যক্তিগত বিমান ওঠানামা করে

সেই কন্যা ‘প্রাপ্তব্যমর্থ’কে সেখানে আসতে দেখে অন্ধকারে বুঝতে না পেয়ে ‘এই ব্যক্তিই আমার প্রিয়’ —এই ভেবে তাকে ভোজন বস্ত্র প্রভৃতি দিয়ে তার সঙ্গে গান্ধর্ব বিধি মতে মিলিত হয়ে তার পাশে শয্যায় শুয়ে বিনয়বতী আবদারের সুরের প্রসন্ন মনে বললেন, আপনি এখনও নিশ্চিন্ত মনে আমার সঙ্গে কেন কথা বলছেন না?
বণিকপুত্র আবার বলল, “প্রাপ্তব্যমর্থং লভতে মনুষ্যঃ”।
বণিকপুত্রের কথা শুনে বিনয়বতী বুঝলো যে কাজ বিচার বিবেচনা না করেই করা হয় তার পরিণাম এমনই হয়। মনের দুঃখে সেই বণিকপুত্রকে বাইরে বের করে দিলো সে। সেই বণিকপুত্র যখন রাস্তার গলিপথে এসে পৌঁছল সেখানে তখন অন্যদেশে বসবাসকারী বরকীর্তি নামে ব্যক্তি বিবাহ করবার জন্য বরযাত্রী নিয়ে বর সেজে যাচ্ছিলেন বাজনা বাজিয়ে। সেই প্রাপ্তব্যমর্থ তাদের সঙ্গে চলতে শুরু করল।—চলবে।
* পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি (Panchatantra politics diplomacy): ড. অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায় (Anindya Bandyopadhyay) সংস্কৃতের অধ্যাপক, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়।

Skip to content