ছবি: প্রতীকী।
মিত্রসম্প্ৰাপ্তি
০৩: শবর আর শূকরের কাহিনি
কোনও এক বনের ধারে এক ভীল থাকত। শিকার করে মাংস বিক্রি করেই জীবন কাটত তার। প্রতিদিনের মতো একদিন সে পাপবৃদ্ধির জন্যেই শিকার করতে বনে ঢুকল। এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে শুরুতেই সে কালো পাহাড়ের নিচে এক বিরাট শূকর দেখতে পেল। তাকে দেখেই ধনুকের জ্যা কান পর্যন্ত টেনে এক তীক্ষ্ণ বাণ ছুড়ল সেই ভীল। বাণের আঘাতে আহত হয়ে সেই ক্রুদ্ধ বন্য শূকরটি একাদশীর চাঁদের মতো ধারাল দাঁত দিয়ে দৌড়ে এসে ভীলটির ফেট ফাটিয়ে দিল। দেখতে দেখতে ভীলটি সেখানেই ছটফট করতে করতে মরে গেল। বাণের আঘাতে শূকরটিও মারা পড়ল কিছুক্ষণের মধ্যেই। কিছুক্ষণ পরেই সেখানে এক শেয়াল এসে উপস্থিত হল।
সম্ভত মরণের টানেই এসেছিল সে সেখানে। অনেকদিন ধরে কিছু না খেয়ে খাদ্যের সন্ধানে এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে পাশাপাশি দুটো মৃত শরীর পেয়ে সে তো আনন্দে তখন পুলোকিত। সেই ভীল আর শূকরের দেহ দুটোকে পেয়ে সে তখন চিন্তা করল, বিধি আজ অত্যন্ত অনুকূল আমার। তাই জন্যেই অকস্মাৎ এমন ভোজন প্রাপ্তি। অথবা বলা ভালো, চেষ্টা না করতেই ভাগ্যে এইরকম খাবার জুটে যাওয়া মানে এটা বিধিরই প্রেরণা। পূর্বজন্মের কৃত শুভ বা অশুভ কর্মেরই ফল এইসব। পণ্ডিতেরা বলেন, পূর্ব জন্মে যে স্থানে, যে সময়ে, যে বয়সে মানুষ যা যা ভালোমন্দ কর্ম করে, পরজন্মে সেই রকম শুভাশুভ ফল সে সেই স্থানে, সেই সময়ে এবং সেই বয়সেই লাভ করে। তাই এদুটো রেখে রেখে এমন ভাবে খাব যাতে অনেকদিন এগুলো দিয়েই আমার জীবন যাত্রা চলে যায়।
রসাযনমিব প্রাজ্ঞৈর্হেলযা ন কদাচন।। (মিত্রসম্প্রাপ্তি, ৮৩)
রসালো দ্রব্য মানুষ যেমন ধীরে ধীরে তার স্বাদ নিতে নিতে খায় ঠিক তেমনই ভাবে বুদ্ধিমান লোকেরও উচিত নিজের উপার্জিত ধনসম্পত্তিকেও ধীরে ধীরে ভোগ করা। এই স্থির করে ধনুকের অগ্রভাগটা মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে মনের আনন্দে স্নায়ু দিয়ে তৈরি জ্যা-টা চেবাতে লাগলো সে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই জ্যা-বন্ধনটা ছিড়ে যেতেই ধনুকের কো-দণ্ডটা সোজা হয়ে সরাসরি সেই শেয়ালের মাথার মধ্যে ডুকে গেলো আর মুহূর্তে তার মৃত্যু হল।
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৬৩: চোর-ডাকাতও যদি দান-ধ্যান করে, তবে লোকে ‘তাকে’-ও ভগবানের মতোই শ্রদ্ধা করে
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ
৩য় কাহিনি সমাপ্ত
কাহিনি শেষ করে ব্রাহ্মণ বলল, এই কারণেই আমি বলেছিলাম ‘অতিতৃষ্ণা ন কর্তব্যা’ — অতি লোভ করা উচিত নয়। তারপর আবার বলল, ওহে ব্রাহ্মণী এটা কি জানো না যে আয়ু, কর্ম, ধন, বিদ্যা এবং মৃত্যু — এই পাঁচটিই গর্ভকাল থেকেই বিধাতা মানুষের জন্য ঠিক করে দেন। তাই ধনসম্পদের কথা বেশী চিন্তা করে লাভ নেই। সেটা যদি আসবার হয় এমনিই আসবে। বরং পুণ্যসঞ্চয়ের দিকে মন দেওয়া উচিত।
ব্রাহ্মণ এইভাবে অনেক বোঝালে পরে ব্রাহ্মণী তখন বলল, তাই যদি হয় তাহলে আমার ঘরে কিছু তিল আছে। সেটা ধুয়ে খোসা ছাড়িয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে সেই তিলচূর্ণ দিয়েই ব্রাহ্মণ ভোজন করাবো। এই কথা শুনে সেই ব্রাহ্মণ নিশ্চিন্ত হয়ে গ্রামান্তরে যাত্রা করল।
সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭৩: সুন্দরবনের পাখি—কোঁচ বক
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৭০: ভানুপিসি ও শ্রীমার ভক্ত
বৃহৎস্ফিঙ্ বলল, এরপর আমি যে বাড়িতে সেদিন ভিক্ষা করতে গিয়েছিলাম সেই বাড়িতেই দেখি সেই ব্রাহ্মণীও এসে উপস্থিত হয়েছে সেই কুকুরের মূত্রলাগা খোসা ছাড়ানো তিল নিয়ে বিক্রয় করবার জন্য। গৃহকর্ত্রীকে গিয়ে সে বলল, মাগো! খোসা সহিত তিলের পরিবর্তে খোসা ছাড়ানো পরিস্কার তিল নেবে নাকি?
বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-১০: ভার্জিনিয়া ও লিওনার্ড উলফ—উন্মাদনা ও সৃষ্টি /২
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫১: সেই ‘পৃথিবী আমারে চায়’
২য় কাহিনি সমাপ্ত
কাহিনী শেষ করে বৃহৎস্ফিঙ্ বলল, এই কারণেই আমি বলছিলাম—অকারণে কেউ অন্যের ভালো করতে যায় না। কোনো কাজই লোকে অকারণে করে না। সকল কর্মের পিছনেই কোনও না কোনও কারণ অবশ্যই আছে। তাই ইঁদুরটা যে এইভাবে একটা অস্বাভাবিক লাফ দিতে পারছে এর পিছনেও কোনও না কোনও কারণ অবশ্যই থাকবে।
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪৩: প্রফুল্লময়ী— একটি বইয়ের লেখক এবং একটি জীবন ভরা ডিপ্রেশন
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৮৭: যুগধর্মের সমর্থনহীন ধর্মচিন্তার স্থান কোথায়?
তাম্রচূড় বলল, সেটা আমার জানা। কারণ সে কখনও একাকী যায় না। অগণিত দলবল-আত্মীয় পরিজন নিয়ে সে আমার সামনে ঘোরা ফেরা করে, আসে আবার চলেও যায়। অভ্যাগত সেই সন্ন্যাসী বৃহৎস্ফিঙ্ বলল, ‘অস্তি কিঞ্চিৎ খনিত্রম্?’ —মাটি খোড়বার মতো কিছু আছে কি?
— সবটা লোহার তৈরি একটা স্বহস্তিকা মানে কোদাল বা খুরপি আছে।
— বেশ! তাহলে আগামীকাল সক্কাল-সক্কাল উঠে, মাটিতে এদের পায়ের চিহ্ন মুছে যাওয়ার আগেই এর গর্ত খোঁজার চেষ্টা করব।
ইঁদুর হিরণ্যক তখন বলল, আমি তখন তাঁদের দুজনের কথা শুনে একটু চিন্তিত হলাম। এবার যে আমার বিনাশ হওয়ার পালা সেটা বেশ বুঝতে পারলাম। আমার গুপ্তধনের ব্যাপারে এ যখন জানে তার মানে আমার বিলদুর্গ খুঁজতেও এর বেশী সময় লাগবে না। সত্যি বলতে সেই বৃহৎস্ফিঙ্কে দেখেই বুঝতে পেরেছি যে এর পক্ষে অসম্ভক কিছুই নয়। বুদ্ধিমান লোক একবার কাউকে দেখলে বা কারো সঙ্গে মিশলেই তার ক্ষমতা সম্পর্কে বুঝে যান, ঠিক যেমন অভিজ্ঞ ব্যবসায়ী যেকোনো জিনিষ হাতে নিয়েই তার ওজন বলে দিতে পারেন। আসলে মানুষের ভালোমন্দ ইচ্ছাটাকেও পূর্বজন্মে কৃত শুভ-অশুভ কর্মের ফলই নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। ঠিক যেমন কলাপ বা পেখমের চিহ্ন না দেখা দিলেও, ময়ূর শিশুকাল থেকেই নয়নাভিরাম চলবার ঢঙ্টি সহজেই আয়ত্ব করে নেয়। তাই পরদিন ভয়ভীত হয়ে আমি আমাদের রোজকারের যাতায়াতের রাস্তাটা বাদ দিয়ে অন্য রাস্তা দিয়ে চলাচল করা শুরু করলাম। কিন্তু বিপদটা হল সেইখানেই। —চলবে।