ছবি: প্রতীকী।
মিত্রভেদ
ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে ক্রব্যমুখ পালিয়ে গেলেও বজ্রদংষ্ট্র এখনও পথের কাঁটা। উটের মাংসটা একা সমস্তটা ভোগ করতে গেলে সিংহ বজ্রদংষ্ট্রকে কি করে সরানো যায়—চতুরক যখন এইসব চিন্তা করছে, ঠিক সেই সময়েই একটা বড় উটের দল সেখান দিয়ে যাচ্ছিল। তার মধ্যে প্রথম উটটির গলায় একটা বড় ঘণ্টা বাঁধা ছিল। সেই ঘণ্টার শব্দ দূর থেকে খুবই বিচিত্র আর ভয়ঙ্কর শোনাচ্ছিল। সিংহ-বজ্রদষ্ট্র সেই ঘণ্টার আওয়াজ শুনে ভয় পেয়ে চতুরককে বলল, ওহে চতুরক! শীঘ্র গিয়ে দেখো তো এই বিচিত্র আওয়াজটা কোথা থেকে আসছে? এমন আওয়াজ তো শুনিনি কখনও।
সিংহের আদেশ পেয়ে চতুরক বনে-বনান্তে ধীরে সুস্থে কিছুক্ষণ ঘুরে ফিরে বেরিয়ে দ্রুত হাঁপাতে হাঁপাতেফিরে এল। কপট উত্তেজনা নিয়ে বজ্রদংষ্ট্রের কাছে এসে বলল, হে রাজন্! যদি পালাতে পারেন তো এখনই পালিয়ে যান।
বজ্রদংষ্ট্র ভয় পেয়ে বলল, “ভদ্র কিমেবং মাং ব্যাকুলয়সি? তৎ কথয কিমেতৎ”—হে ভদ্র! কেন আমাকে এমনভাবে ব্যাকুল করে তুলছো? তাড়াতাড়ি বলো কি হয়েছে? কেন এমন করে পালিয়ে যেতে বলছো আমাকে?
এই কথা শুনে স্বাভাবিকভাবেই খুব ভয় পেয়ে গেল সিংহ-বজ্রদংষ্ট্র। ভেবে দেখুন, দোষটা করল রাজার অনুচরেরা কিন্তু রাজার ঘাড়ে দোষের বোঝাটা চাপিয়ে দিতে এতোটুকু দ্বিধা করল না তারা। রাজাকে এইটাও স্মরণে রাখা উচিত যে নিজের অনুগতদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারলে তাদের কুকর্মে দায় রাজাকেই নিতে হয়, এইটাই জগতের নিয়ম।
চতুরকের মুখে এমন বিচিত্র সংবাদ শুনে দূর থেকে যখন সেই উটের বিরাট দলটাকে সে দেখতে পেলো তখন দ্রুত সে সেখান থেকে পালিয়ে গেল।
১৬শ কাহিনি সমাপ্ত
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪৫: রাজনীতি স্বার্থ সিদ্ধির জন্য বারে বারে টেনে আনে ধর্মকে, আর এতেই প্রাণ যায় ধর্মভীরু সাধারণদের
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫১: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—পশুর, ধুধুল ও হাবল
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৫: সুর হারানো হারানো সুর
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯০: সাহেবের বেশ না-পরে ফিরেছিলেন সাহেবের দেশ থেকে
এই সংসারে উচিত কাজ করবার সময় যদি দৈববশতঃ মাঝে কোনও বিপদও এসে উপস্থিত হয়, তাহলেও ভালো কাজ যাতে হতে পারে তার জন্য বুদ্ধিমান মানুষের সেই বিপদ বিশেষ ভাবে কাটানোর জন্য প্রয়োজনে অনুনয় বিনয়ের সাহায্যও নেওয়া উচিত। কারণ কথায় আছে— “দগ্ধানাং কিল বহ্নিনা হিতকরঃ সেকঃ”
দগ্ধ জায়গায় আগুনের গরম সেঁক দেওয়াটাই ক্ষতের পক্ষের হিতকর। তাই পিঙ্গলক সিংহের হৃদয় আমার প্রতি বিরূপ হলেও হৃদয়গ্রাহী উষ্ণ ভালো কথায় তাঁকে প্রসন্ন করতে পারলে হয়তো প্রাণে বাঁচবার সম্ভাবনা আছে। দার্শনিক ঋষিরা বলেন, এই সংসারে শরীরধারী যে সব প্রাণীরা আছে তাদের সকলকেই নিজকর্মের জন্য ফল ভোগ করতে হয়। সে কর্মফল শুভ হোক বা অশুভ। এছাড়া যেটা হওয়ার সেটা হবেই। তাই ভবিষ্যতে কি হবে সেই সব নিয়ে বেশী চিন্তাভাবনা না করাই উচিত। অন্য কোথাও পালিয়ে গেলেও যে অন্য কোন মাংসাশী প্রাণী আমাকে হত্যা করবে না এর কি নিশ্চয়তা আছে? তার চেয়ে চেনা শত্রু সিংহের সঙ্গে লড়াই করে মরাটাই শ্রেয়; হতেও তো পারে যে আমাকে দেখে তার চিন্তাভাবনায় পরিবর্তন এলো।
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২৫: অরু দত্ত— এক অভিশপ্ত গান্ধর্বী
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৩: এক্সপায়ারি ডেটের ওষুধ খাবেন?
দানার্থী মধুপো যদ্বদ্ গজকর্ণসমাহতঃ।। (মিত্রভেদ ৪০৫)
অর্থাৎ মহান মানুষদের সঙ্গে স্পর্ধা করে বিরোধে গেলে যদি বিপত্তিও হয় তাহলেও সেটা ভালো। যেমন পাহাড়ের গায়ে আঘাত করতে করতে দাঁত ভেঙে গেলেও সেই অসম যুদ্ধে হাতির মর্যাদাহানী হয় না। ব্যাপারটা অনেকটা সেইরকম যে নিজের থেকে অনেক শক্তিশালী বাঘের সঙ্গে লড়াইয়ে করে শেষ পর্যন্ত যদি কারো মৃত্যুও হয় তাও সেই ব্যক্তিকে বীরের মতনই সম্মানকরা হয়। তাছাড়াও নীচ প্রাণী যদি মহান লোকের হাতে মৃত্যুবরণ করে তাহলেও সে সম্মানের পাত্রে পরিণত হয়ে যায়। ভুললে চলবে না যে মহামায়া দুর্গার হাতে মৃত্যুবরণ করার জন্যেমহিষাসুরকেও দুর্গা প্রতিমার সঙ্গেই পূজা করা হয়।
এই সব মনে মনে চিন্তাভাবনা করতে করতেই অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে সঞ্জীবক ধীরে ধীরে সিংহ পিঙ্গলকের বাসস্থানের দিকে এগিয়ে গেল। মনের মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। ঘরের মধ্যে সাপ লুকিয়ে থাকলে বা মদমত্ত হাতি বা দুর্দান্ত সিংহে ভরা জঙ্গলে এবং কুমিরে ভরা সুন্দর পদ্মবনে মানুষ খুবই কষ্টে এবং ভয়ে ভয়ে প্রবেশ করে। রাজভবন এমনই এক দুর্গম স্থান। সেখানে দুষ্ট, অসত্যবাদী এবং দুরাচারী মানুষ চারিদিকে ঘুরে বেরায়। তাই রাজভবনে প্রবেশ করাটাও কম ভয়ের নয়।
ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩৩: এখনও সারেঙ্গিটা বাজছে
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬৫: রাজা যযাতির উপাখ্যান—পৌরবদের বর্ণ বিপর্যয় না উত্তরণের কাহিনি?
দমনকের কথা সত্যি ভেবে সিংহ-পিঙ্গলক প্রবল পরাক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়ল বৃষ-সঞ্জীবকের উপর। সিংহের তীক্ষ্ণ নখের আঘাতে পিঠ ফেটে গেলো সঞ্জীবকের। তখন কোনওক্রমে তার তীক্ষ্ণ শিং দিয়ে সঞ্জীবক সিংহের পেটে আঘাত করে নিজেকে ছাড়িয়ে আর দূরে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর শিং বাগিয়ে দিয়ে আবার তার সঙ্গে যুদ্ধ করবার জন্য প্রস্তুত হল। দু’জনের শরীর থেকেই তখন রক্ত ঝরে পড়ছে। পঞ্চতন্ত্রকার বলছেন, এদের দু’জনের চেহরা তখন পুষ্পিত পলাশবৃক্ষের মতন লোহিত বর্ণ; পরস্পর পরস্পরকে হত্যা করতে তখন উদ্যত।
ইন্দিরা গান্ধী।
এখন যদি এই বৃষ-সঞ্জীবকের সঙ্গে যুদ্ধে স্বামী পিঙ্গলকের মৃত্যু হয় তাহলে তোমার এতো মন্ত্রবুদ্ধি প্রয়োগ করে লাভটা কি হল? আর এখন সঞ্জীবকও যদি না মরে তাহলেও ব্যাপারটা খুবই খারাপ হবে, কারণ আজ না হয় কাল সে কিন্তু পিঙ্গলকের এই আঘাতের প্রতিষোধ নেবেই; ফলে স্বামী পিঙ্গলকের প্রাণসংশয় থেকেই যাবে। তাই সঞ্জীবকের বধ হওয়াটা আবশ্যিক। তাই ওহে মূর্খ! ভেদ নীতি তো অনেক দেখালে; এ বার সামনীতির কিছু জ্ঞান এখনও যদি কিছু অবশিষ্ট থাকে তাহলে এদের মধ্যে সন্ধি-টন্ধি করিয়ে নিজের মন্ত্রীপদটাকে রাখার ব্যবস্থা করো।—চলবে।