বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী।

 

মিত্রভেদ

ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে ক্রব্যমুখ পালিয়ে গেলেও বজ্রদংষ্ট্র এখনও পথের কাঁটা। উটের মাংসটা একা সমস্তটা ভোগ করতে গেলে সিংহ বজ্রদংষ্ট্রকে কি করে সরানো যায়—চতুরক যখন এইসব চিন্তা করছে, ঠিক সেই সময়েই একটা বড় উটের দল সেখান দিয়ে যাচ্ছিল। তার মধ্যে প্রথম উটটির গলায় একটা বড় ঘণ্টা বাঁধা ছিল। সেই ঘণ্টার শব্দ দূর থেকে খুবই বিচিত্র আর ভয়ঙ্কর শোনাচ্ছিল। সিংহ-বজ্রদষ্ট্র সেই ঘণ্টার আওয়াজ শুনে ভয় পেয়ে চতুরককে বলল, ওহে চতুরক! শীঘ্র গিয়ে দেখো তো এই বিচিত্র আওয়াজটা কোথা থেকে আসছে? এমন আওয়াজ তো শুনিনি কখনও।

সিংহের আদেশ পেয়ে চতুরক বনে-বনান্তে ধীরে সুস্থে কিছুক্ষণ ঘুরে ফিরে বেরিয়ে দ্রুত হাঁপাতে হাঁপাতেফিরে এল। কপট উত্তেজনা নিয়ে বজ্রদংষ্ট্রের কাছে এসে বলল, হে রাজন্‌! যদি পালাতে পারেন তো এখনই পালিয়ে যান।

বজ্রদংষ্ট্র ভয় পেয়ে বলল, “ভদ্র কিমেবং মাং ব্যাকুলয়সি? তৎ কথয কিমেতৎ”—হে ভদ্র! কেন আমাকে এমনভাবে ব্যাকুল করে তুলছো? তাড়াতাড়ি বলো কি হয়েছে? কেন এমন করে পালিয়ে যেতে বলছো আমাকে?

চতুরক বলল— হে রাজন্‌! ধর্মকে মধ্যস্থ করে এই উষ্ট্র-শঙ্কুকর্ণকে আশ্বস্ত করে আপনি যে কপটভাবে অকালে তাকে হত্যা করলেন, ধর্মরাজ স্বয়ং তাতে অত্যন্ত কুপিত হয়েছেন। তাই আপনার সেই অপরাধের হাজার গুণ প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য একটা বিরাট উটের দল তিনি পাঠিয়েছেন, যে দলের প্রথম উটটির গলায় এক ভয়ানক ঘন্টা বাঁধা। এই উটের বাপ-দাদাদের সঙ্গে নিয়ে স্বয়ং ধর্মরাজ যম এখানে উপস্থিত হয়েছেন আপনাকে শাস্তি দিতে।

এই কথা শুনে স্বাভাবিকভাবেই খুব ভয় পেয়ে গেল সিংহ-বজ্রদংষ্ট্র। ভেবে দেখুন, দোষটা করল রাজার অনুচরেরা কিন্তু রাজার ঘাড়ে দোষের বোঝাটা চাপিয়ে দিতে এতোটুকু দ্বিধা করল না তারা। রাজাকে এইটাও স্মরণে রাখা উচিত যে নিজের অনুগতদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারলে তাদের কুকর্মে দায় রাজাকেই নিতে হয়, এইটাই জগতের নিয়ম।

চতুরকের মুখে এমন বিচিত্র সংবাদ শুনে দূর থেকে যখন সেই উটের বিরাট দলটাকে সে দেখতে পেলো তখন দ্রুত সে সেখান থেকে পালিয়ে গেল।
 

১৬শ কাহিনি সমাপ্ত

আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪৫: রাজনীতি স্বার্থ সিদ্ধির জন্য বারে বারে টেনে আনে ধর্মকে, আর এতেই প্রাণ যায় ধর্মভীরু সাধারণদের

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫১: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—পশুর, ধুধুল ও হাবল

দমনক চলে গেলে সঞ্জীবক চিন্তা করতে শুরু করল। অনেক বিচার-বিবেচনা করে সে বুঝলো যে তৃণভোজী হয়ে মাংসাশী প্রাণীদের সেবক হয়ে মোটেও ঠিক কাজ করেনি সে। বলা ভালো, যে ব্যক্তি সেবা করার অযোগ্য পুরুষের সেবা করেন কিংবা যার কাছে আশ্রয় অনুচিত নয়, এমন ব্যক্তির আশ্রয় গ্রহণ করেন। সেই ব্যক্তির মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। ঠিক যেমন খচ্চরীর গর্ভধারণ করে নিজেই নিজের মৃত্যুর কারণ হয়। পশুবিজ্ঞানীরাও বলেন যে খচ্চর প্রজাতির প্রাণীরা ঘোড়ার গর্ভে জন্মায় বলে ঘোড়ার থেকে ৩২টি এবং গাধার থেকে ৩১টি ক্রোমোজোম লাভ করে। ফলে খচ্চরি বা শুদ্ধভাষায় যাকে অশ্বেতরী বলা হয় তাদের মোট ৬৩টি ক্রোমোজোম থাকে। খচ্চর ও খচ্চরির মধ্যে মিলনে তাই ক্রোমোজমের মিল হয় না বলে খচ্চরিরা সাধারণত গর্ভবতী হতে পারে না; আর ঘটনাচক্রে তারা গর্ভবতী হলেও তাদের মৃত্যুর হয়ে থাকে। বিবিসি (British Broadcasting Corporation)-এর তরফ থেকে একটি সমীক্ষায় জানা গিয়েছে, ১৫২৭ থেকে ২০০২ পর্যন্ত প্রায় এই ৫০০ বছরের মধ্যে ৬০টি ঘটনা পাওয়া গিয়েছে যেখানে দেখা গিয়েছে যে খচ্চরিরা সন্তানের জন্ম দিতে সক্ষম হয়েছে। তবে এই ঘটনাগুলিকে পশু বিজ্ঞানীরা নিতান্তই ব্যতিক্রমী বলে উল্লেখ করেন।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৫: সুর হারানো হারানো সুর

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯০: সাহেবের বেশ না-পরে ফিরেছিলেন সাহেবের দেশ থেকে

সঞ্জীবক চিন্তা করল, তাহলে এখন আমার ঠিক কী করা উচিত? কী করলে এই মানসিক অস্থিরতা থেকে আমি একটু শান্তি পাব? নাকি সেই পিঙ্গলক সিংহের কাছেই যাব? তাঁর শরণাগত হলে রক্ষা মিললেও তো মিলতে পারে? এইটাই হয়তো প্রাণে বাঁচবার একমাত্র উপায়। শাস্ত্রে বলে—
এই সংসারে উচিত কাজ করবার সময় যদি দৈববশতঃ মাঝে কোনও বিপদও এসে উপস্থিত হয়, তাহলেও ভালো কাজ যাতে হতে পারে তার জন্য বুদ্ধিমান মানুষের সেই বিপদ বিশেষ ভাবে কাটানোর জন্য প্রয়োজনে অনুনয় বিনয়ের সাহায্যও নেওয়া উচিত। কারণ কথায় আছে— “দগ্ধানাং কিল বহ্নিনা হিতকরঃ সেকঃ”

দগ্ধ জায়গায় আগুনের গরম সেঁক দেওয়াটাই ক্ষতের পক্ষের হিতকর। তাই পিঙ্গলক সিংহের হৃদয় আমার প্রতি বিরূপ হলেও হৃদয়গ্রাহী উষ্ণ ভালো কথায় তাঁকে প্রসন্ন করতে পারলে হয়তো প্রাণে বাঁচবার সম্ভাবনা আছে। দার্শনিক ঋষিরা বলেন, এই সংসারে শরীরধারী যে সব প্রাণীরা আছে তাদের সকলকেই নিজকর্মের জন্য ফল ভোগ করতে হয়। সে কর্মফল শুভ হোক বা অশুভ। এছাড়া যেটা হওয়ার সেটা হবেই। তাই ভবিষ্যতে কি হবে সেই সব নিয়ে বেশী চিন্তাভাবনা না করাই উচিত। অন্য কোথাও পালিয়ে গেলেও যে অন্য কোন মাংসাশী প্রাণী আমাকে হত্যা করবে না এর কি নিশ্চয়তা আছে? তার চেয়ে চেনা শত্রু সিংহের সঙ্গে লড়াই করে মরাটাই শ্রেয়; হতেও তো পারে যে আমাকে দেখে তার চিন্তাভাবনায় পরিবর্তন এলো।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২৫: অরু দত্ত— এক অভিশপ্ত গান্ধর্বী

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৩: এক্সপায়ারি ডেটের ওষুধ খাবেন?

কথায় বলে—
মহতোঽপি ক্ষযং লব্ধা শ্লাঘ্যং নীচোঽপি গচ্ছতি।
দানার্থী মধুপো যদ্বদ্‌ গজকর্ণসমাহতঃ।। (মিত্রভেদ ৪০৫)


অর্থাৎ মহান মানুষদের সঙ্গে স্পর্ধা করে বিরোধে গেলে যদি বিপত্তিও হয় তাহলেও সেটা ভালো। যেমন পাহাড়ের গায়ে আঘাত করতে করতে দাঁত ভেঙে গেলেও সেই অসম যুদ্ধে হাতির মর্যাদাহানী হয় না। ব্যাপারটা অনেকটা সেইরকম যে নিজের থেকে অনেক শক্তিশালী বাঘের সঙ্গে লড়াইয়ে করে শেষ পর্যন্ত যদি কারো মৃত্যুও হয় তাও সেই ব্যক্তিকে বীরের মতনই সম্মানকরা হয়। তাছাড়াও নীচ প্রাণী যদি মহান লোকের হাতে মৃত্যুবরণ করে তাহলেও সে সম্মানের পাত্রে পরিণত হয়ে যায়। ভুললে চলবে না যে মহামায়া দুর্গার হাতে মৃত্যুবরণ করার জন্যেমহিষাসুরকেও দুর্গা প্রতিমার সঙ্গেই পূজা করা হয়।

এই সব মনে মনে চিন্তাভাবনা করতে করতেই অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে সঞ্জীবক ধীরে ধীরে সিংহ পিঙ্গলকের বাসস্থানের দিকে এগিয়ে গেল। মনের মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। ঘরের মধ্যে সাপ লুকিয়ে থাকলে বা মদমত্ত হাতি বা দুর্দান্ত সিংহে ভরা জঙ্গলে এবং কুমিরে ভরা সুন্দর পদ্মবনে মানুষ খুবই কষ্টে এবং ভয়ে ভয়ে প্রবেশ করে। রাজভবন এমনই এক দুর্গম স্থান। সেখানে দুষ্ট, অসত্যবাদী এবং দুরাচারী মানুষ চারিদিকে ঘুরে বেরায়। তাই রাজভবনে প্রবেশ করাটাও কম ভয়ের নয়।
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩৩: এখনও সারেঙ্গিটা বাজছে

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬৫: রাজা যযাতির উপাখ্যান—পৌরবদের বর্ণ বিপর্যয় না উত্তরণের কাহিনি?

এই সব চিন্তা করতে করতে সঞ্জীবক যখন পিঙ্গলকের গুহার কাছে এসে পৌঁছল তখন দমনক ঠিক যেমন যেমন লক্ষণের কথা বলেছিল সিংহ পিঙ্গলকে ঠিক তেমন ভাবেই দেখতে পেলো সে। চোখ দুটো তার ক্রোধে তখন রক্তবর্ণ। ভ্রুকুটি কুটিল করে দূর থেকে সে তখন সঞ্জীবককে লক্ষ্য করছে আর মাঝে মাঝে জিহ্বা দিয়ে অধরোষ্ঠের প্রান্তভাগ লেহন করছে। তাই দেখে সঞ্জীবক আর তার কাছে গেল না, এমনকি তাকে প্রণামও নিবেদন করতে সাহস করল না। পিঙ্গলকের থেকে কিছুট দূরত্ব বজায় রেখে সে বসে পড়লো।আর এদিকে তাঁরপ্রতি সঞ্জীবকের এইরকম অবজ্ঞা দেখে সিংহ পিঙ্গলক এবার সত্যি-সত্যিই খুব আশ্চর্য হয়ে গেল। তারপর দমনক ঠিক যেমন যেমন লক্ষণের কথা তাকে বলেছিল সঞ্জীবকের মধ্যে সবগুলো দেখতে পেল পিঙ্গলক।

দমনকের কথা সত্যি ভেবে সিংহ-পিঙ্গলক প্রবল পরাক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়ল বৃষ-সঞ্জীবকের উপর। সিংহের তীক্ষ্ণ নখের আঘাতে পিঠ ফেটে গেলো সঞ্জীবকের। তখন কোনওক্রমে তার তীক্ষ্ণ শিং দিয়ে সঞ্জীবক সিংহের পেটে আঘাত করে নিজেকে ছাড়িয়ে আর দূরে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর শিং বাগিয়ে দিয়ে আবার তার সঙ্গে যুদ্ধ করবার জন্য প্রস্তুত হল। দু’জনের শরীর থেকেই তখন রক্ত ঝরে পড়ছে। পঞ্চতন্ত্রকার বলছেন, এদের দু’জনের চেহরা তখন পুষ্পিত পলাশবৃক্ষের মতন লোহিত বর্ণ; পরস্পর পরস্পরকে হত্যা করতে তখন উদ্যত।

ইন্দিরা গান্ধী।

তাদের দু’জনকে এই অবস্থায় দেখে করটক তখন দমনককে বলল, ওরে মূর্খ! তুমি এই দুজনের মধ্যে বিরোধ তৈরি করে ঠিক করোনি। রাজনীতির তুমি কিছুই বোঝো না। পণ্ডিতরা বলেন, যে ব্যক্তি অত্যন্ত উগ্র দণ্ড এবং সাহসী কষ্টসাধ্য যুদ্ধকে প্রেম এবং সাম-দান-ভেদ-দণ্ড প্রয়োগ করে শান্ত করতে পারেন সেই প্রকৃত মন্ত্রী। আর যে নিরর্থক কারণে শুধু ভেদ নীতি প্রয়োগ করে অন্যায় ভাবে যুদ্ধের পথে রাজাকে নিয়ে যান সে মন্ত্রী কুমন্ত্রী। সেইরকম কুমন্ত্রীদের কুমন্ত্রণা অনুযায়ী কাজ করতে থাকলে রাজা এবং তাঁর রাজলক্ষ্মী দুজনেরই বিপদ নিশ্চিত।

এখন যদি এই বৃষ-সঞ্জীবকের সঙ্গে যুদ্ধে স্বামী পিঙ্গলকের মৃত্যু হয় তাহলে তোমার এতো মন্ত্রবুদ্ধি প্রয়োগ করে লাভটা কি হল? আর এখন সঞ্জীবকও যদি না মরে তাহলেও ব্যাপারটা খুবই খারাপ হবে, কারণ আজ না হয় কাল সে কিন্তু পিঙ্গলকের এই আঘাতের প্রতিষোধ নেবেই; ফলে স্বামী পিঙ্গলকের প্রাণসংশয় থেকেই যাবে। তাই সঞ্জীবকের বধ হওয়াটা আবশ্যিক। তাই ওহে মূর্খ! ভেদ নীতি তো অনেক দেখালে; এ বার সামনীতির কিছু জ্ঞান এখনও যদি কিছু অবশিষ্ট থাকে তাহলে এদের মধ্যে সন্ধি-টন্ধি করিয়ে নিজের মন্ত্রীপদটাকে রাখার ব্যবস্থা করো।—চলবে।
* পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি (Panchatantra politics diplomacy): ড. অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায় (Anindya Bandyopadhyay) সংস্কৃতের অধ্যাপক, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়।

Skip to content