বুধবার ২৯ জানুয়ারি, ২০২৫


ছবি: প্রতীকী।

 

মিত্রভেদ

করটক সাবধানী মানুষ। কিছুটা হলেও ধর্মবুদ্ধি তখনও রয়েছে তার মধ্যে। দমনকের এই কূটবুদ্ধিকে প্রচ্ছন্ন ভাবে সমর্থন করলেও তাকে কিছুটা বকেই সে বলল, এটা কিন্তু ভাই তুমি ঠিক করলে না। দু’জনে পরস্পর মিলেমিশে তারা বেশ ভালোই ছিল। তাদেরকে এ ভাবে ক্রোধ সমুদ্রের ফেলে দেওয়াটা একেবারেই উচিত হয়নি তোমার—এখন তারা কেবলই একে অপরকে সন্দেহ করবে আর নিজেদের মনের মধ্যে একে অন্যের প্রতি ক্ষোভ জমিয়ে রাখতে শুরু করবে। শাস্ত্রে বলে, সুখে-শান্তিতে জীবন-যাপন করছেন এমন নির্বিবাদী-নির্ঝঞ্চাট মানুষকেযে দুঃখ দেয় সেলোক জন্মজন্মান্তরেও সুখ পায় না। তাছাড়া তুমি এদের দু’জনের মধ্যে ভেদভাব তৈরি করে যে মজাটা পাচ্ছ সেটাও ঠিক নয়, কারণ একে অপরের মধ্যে বিরোধ তো সকলেই তৈরি করে দিতে পারে, কিন্তু সঠিকভাবে কাউকে উপকার করতে খুব কম মানুষই পারে। কারণ, নীচ অকর্মণ্য লোকেরা শুধু অন্যের কাজ বিগরাতেই ওস্তাদ, কোনও ভালো কাজ তাদের দ্বারা হয় না। যেমন বায়ু শুধু গাছকে ফেলে দিতেই পারে, সে গাছ আবার দাঁড় করাবার শক্তি কিন্তু তার নেই।

দমনক মুচকি হেসে করটককে একটু অবজ্ঞা করেই বলল, আসলে রাজনীতি-কূটনীতির কিছুই তোমার মাথায় ঢোকে না তাই তুমি এই সব কথা বলছো। যে লোক শুরুতে তার শত্রু কিংবা রোগের বিনাশ করে না, সে নিজে যথেষ্ট স্বাস্থ্যবান বা বলবান হলেও সেই শত্রু বা রোগই তাকে ধ্বংস করে।এই সঞ্জীবক, যে আমার মন্ত্রিত্বকে ছিনিয়ে নিয়েছে, তাকে নিশ্চয় তুমি আমার বন্ধু বলবে না। বন্ধুরা বন্ধুর জীবিকা কিংবা পদ ছিনিয়ে নেয় না। তাই আমার বিচারে এই বৃষ-সঞ্জীবক আমার শত্রু আর শত্রুকে আমি বাড়তে দিতে চাইনা। শাস্ত্রে বলে—
 

পিতৃপৈতামহ স্থানং যো যস্যাত্র জিগীষতে।
স তস্য সহজঃ শত্রুরুচ্ছেদ্যোঽপি প্রিযে স্থিতঃ।। (মিত্রভেদ, ৩৯৬)

বাপ-পিতামহের আমলের অর্জিত ভূমি বা পদ কেউ যদি ছিনিয়ে নিতে চায় বা মনে মনেও ছিনিয়ে নেওয়ার কথা চিন্তা করে তবে সে আমার অত্যন্ত প্রিয়জন হলেও আসলে সে আমার শত্রু। তাই এইরকম ভালোমানুষ সেজে থাকা শত্রুকে সমূলে নষ্ট করাই উচিত। ভুলে যেও না যে সেই সঞ্জীবককে আমিই প্রথম অভয় দিয়ে স্বামী পিঙ্গলকের কাছে নিয়ে আসি। তাঁকে নিয়ে আসার পিছনে কোনও রকম স্বার্থই ছিল না আমার। কিন্তু সে এসে আমাকে মন্ত্রীত্ব থেকে সরিয়ে দিল। সেই কথায় আছে না?—যদি কোনও ভালো মানুষ কোনও দুষ্ট লোককে নিজের স্থান ছেড়ে দেয়, তাহলে সেই দুষ্ট ব্যক্তি সেই ভালো মানুষের পদাধিকার ছিনিয়ে তাকেই বিনাশ করতে চায়। তাই বুদ্ধিমান ব্যক্তির উচিত নীচ স্বভাবের ব্যক্তিদের কোনও কাজে প্রবেশ করবার অবসরটুকুই না দেওয়ার; একটু ফাঁক পেলেই তারা প্রকৃত যোগ্য ব্যক্তিকে সরিয়ে নিজের অধিকার বলবৎ করে। সেই কথায় বলে না?—সুযোগ পেলে উপপতিও গৃহপতি হওয়ার চেষ্টা করে।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪৩: ভৃত্য যদি কোনও অপরাধ করেন, তার দণ্ড প্রভুকেই পেতে হয়

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৯: ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—ওড়া, কেওড়া, চাক কেওড়া ও কৃপাল

তাই আমি সেই সঞ্জীবককে হত্যা করবার যে পরিকল্পনা করেছি সেটা অকারণ নয়, আর মারতে না পারলেও এ দেশ থেকে যে সে পালাবে এটা নিশ্চিত। কিন্তু এই ব্যাপারটা তুমি ছাড়া দ্বিতীয় কেউ জানে না। আমি যা কিছু করেছি তা আমাদের দু’জনের স্বার্থসিদ্ধির জন্যেই করেছি—আমাদেরই ভালো হবে। পণ্ডিতরা বলেন, হৃদয়কে তলোয়ারের সমান তেজস্বী এবং মুখের কথাকে ছুরির মতন ধারলো আর শক্ত করে শত্রুতা করা উচিত। শত্রুতা যদি করতেই হয় তবে “শত্রুর এতোটা ক্ষতি করবো? নাকি করবো না?” এই সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব মনের থেকে সরিয়ে রেখে সরাসরিই শত্রুতা করা উচিত। তাছাড়া এই সঞ্জীবক মরলে সে আমাদের খাদ্যও হবে। তাই একে মারলে প্রথমত: শত্রুতার বদলা নেওয়া যাবে. দ্বিতীয়ত: মন্ত্রিপদ পুনরায় লাভ করা যাবে. আর একে খেয়ে তৃপ্তিও লাভ করা যাবে। একে মারতে পারলে তিন-তিনটে গুণ তো চোখের সামনে এখনই দেখতে পাচ্ছি। তাই অকারণে আমাকে দোষারোপ করো না। সেই গল্পটা জানো তো?—
 

পরস্য পীডনং কুর্বন্‌ স্বার্থসিদ্ধিং চ পণ্ডিতঃ।
মূঢবুদ্ধির্ন ভক্ষেচ্চ বনে চতুরকো যথা।। (ঐ, ৩৯৯)

রাজনীতির লোকেরা প্রয়োজনের অন্যকে কষ্ট দিয়ে হলেও নিজের স্বার্থসিদ্ধি করে নেয় আর মূর্খ লোকেরা তো নিজের খাবারটুকুও নিজে নিজে জোগাড় করতে পারে না।যেমন অবস্থা বনের সেই চতুরক শেয়ালটার হয়েছিল।
করটক বলল— “কথমেতৎ?” ব্যাপারটা ঠিক কেমন?
সে তখন বলতে শুরু করলো।

আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৩: বাবু ডাক্তার ও ‘ডাক্তারবাবু’

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬৩: মহাভারতে উল্লিখিত মিথ্যাশ্রয়ের প্রাসঙ্গিকতা কী আজও আছে?

 

১৬: সিংহ আর শেয়ালের গল্প

কোনও এক বনে বজ্রদংষ্ট্র নামে এক সিংহ বাস করতো। নাম শুনেই অনুমান করা যায় যে বজ্রের মতো কঠোর ছিল তার দাঁত কপাটি। একবার তার মুখে যে পড়তো তার আর নিস্তার নেই। সেই সিংহের চতুরক নামে এক শেয়াল আর ক্রব্যমুখ নামে এক নেকড়ে —এই দুই অনুগত ভৃত্য ছিল। একবার সেই সিংহ বনের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে আসন্নপ্রসবা এক উষ্ট্রীকে পেল। সে তখন প্রসব বেদনায় কাতরাচ্ছে। নিজের দলের সঙ্গে চলতে না পারার কারণে সে তখন দলছুট হয়ে একা-একা জঙ্গলের মধ্যে পড়ে পড়ে কষ্ট পাচ্ছে। বজ্রদংষ্ট সিংহ স্বনামধন্য। সেই আসন্নপ্রবসা উষ্ট্রীকে মেরে ওর পেটটা চিরতেই ভিতর থেকে জ্যান্ত একটা উটের ছানা বেরিয়ে এলো। সেই উষ্ট্রীর মাংস সপরিবারে তারা বেশ তৃপ্তি করেই খেলো কিন্তু সেই সদ্যোজাত বাচ্চাটাকে স্নেহবশে মারতে পারলো না। সিংহ হলেও মায়া-মমতা কিছুটা হয়তো ছিল। তাই সেই উটের বাচ্চাটাকে অতি যত্নে ঘরে এনে তাকে বলল, ওহে ভদ্র! তোমার এখন আর আমার থেকে আর কোনও ভয় নেই। তুমি এখন নির্ভয়ে স্বেচ্ছায় বনে-বনান্তে ঘুরে বেরাতে পারো। তোমার কান শঙ্কু বা কোণের মতন তাই তোমার নাম দিলাম শঙ্কুকর্ণ।

আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৯: বাইনাচ-গানেরও কদর ছিল ঠাকুরবাড়িতে

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২৩: তরু দত্ত— এক আনন্দ বিষাদের তরুলতা

ফলে সেই বজ্রদংষ্ট্র সিংহ, শেয়াল চতুরক, নেকড়ে ক্রব্যমুখ আর সেই শঙ্কুকর্ণ চারজনে একসঙ্গে থাকতে শুরু করলো। একসঙ্গে এক বন থেকে অন্য বনে তারা ঘুরে বেড়াতো। একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া গল্প-গুজব সবই চলতো—ঠিক যেমন এক পরিবারের লোকেদের মধ্যে চলে। সেই শঙ্কুকর্ণ সিংহ পরিবারেরই একজন হয়ে উঠলো ক্রমে। কালের নিয়মে সেই শঙ্কুকর্ণ একদিন যুবক হল— চেহারাতেও বেশ বড়সড় হল। সব সময় সিংহের পাশে পাশে থাকতো সে।

একদিন এক মত্তহাতির সঙ্গে সেই সিংহ বজ্রদংষ্ট্রের খুব লড়াই হল আর তাতে সেই সিংহ ভয়ঙ্কর ভাবে ঘায়েল হল। এমনই অবস্থা হল যে সে শিকার করতে পর্যন্ত অসমর্থ হয়ে গেল। তখন একদিন সে তার বাকি সঙ্গীদের ডেকে বলল, তোমরা কোনও এক জানোয়ার খুঁজে আমার কাছে নিয়ে এসো যাতে এই অবস্থাতেও আমি তাকে মেরে তোমাদের মুখে খাবার তুলে দিতে পারি।
আরও পড়ুন:

বদলে দিয়েছিলেন স্বাধীনতা-উত্তর নাটক এবং চলচ্চিত্রের ভাষা

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৯: বেশি ঘুম শরীরের পক্ষে ভালো?

সিংহের আশে পাশে এই নেকড়ে আর শেয়াল থাকেই এইজন্য যে সিংহের উচ্চিষ্ট খাবার তারা খেতে পারবে। কারণ এরা একার সামর্থে কোনও হরিণ বা মোষ শিকার করতে পারে না। সিংহ শিকার করে আর তারপর তার খাওয়ার পর যা কিছু অবশিষ্ট থাকে তাই তারা খায়। ফলে সিংহ শিকার করতে না পারা মানে সিংহের সঙ্গে সঙ্গে এদের দু’জনেরও উপোষ করা। সেদিক থেকে তৃণভোজী শঙ্কুকর্ণের খাবার কোনও অভাব নেই, বনের প্রান্তে গাছ-পালা বা কাঁটা ঝোপের অভাব নেই। সেই সব খেয়েই তার দিন চলে যায়।

সিংহের এমন অবস্থা দেখে তিনজনেই সকাল থেকে সন্ধ্যাকাল পর্যন্ত বনে বনে ঘুরে বেড়ালো পশুর সন্ধানে কিন্তু একটিও শিকার তারা পেলো না। খালি পেটে চারিদিকে এদিও-সেদিন ঘুরে-ফিরে দিনান্তে ক্লান্ত হয়ে বসে বসে চতুরক চিন্তা করলো, এই উট-শঙ্কুকর্ণটাকে যদি মারা যায় তাহলে আমাদের সকলের বেশ কয়েকদিনের খাবার-দাবারের আর চিন্তা থাকবে না। কিন্তু স্বামী-বজ্রদংষ্ট্রের সঙ্গে এর আবার চরম বন্ধুত্ব, তার উপর আবার সে স্বামীর আশ্রিত; মনে হয় না এই উটটাকে মারতে স্বামী খুব একটা রাজি হবে। কিন্তু এইভাবে খালি পেটে সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত যদি আবার কাল ঘুরে বেড়াতে হয় তাহলে আমাদের তিনজনের মৃত্যু নিশ্চিত। শঙ্কুকর্ণই একা বাঁচবে, কারণ কাটা-ঝোপের কমতি নেই এ জঙ্গলে। তাই সিংহ-বজ্রদংষ্ট্রকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে এমন কিছু একটা বুদ্ধি বের করতে হবে যাতে সেই শঙ্কুকর্ণকে হত্যা করা যায়। সত্যি বলতে এ জগতে এমন কোনও প্রাণী নেই যাকে বুদ্ধি প্রয়োগ করে মারা যায় না।—চলবে।
* পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি (Panchatantra politics diplomacy): ড. অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায় (Anindya Bandyopadhyay) সংস্কৃতের অধ্যাপক, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়।

Skip to content