
মিত্রসম্প্ৰাপ্তি
হিরণ্যকের কথা শুনে লঘুপতনক তখন উড়ল আকাশ পথে চিত্রাঙ্গকে খুঁজতে। কিছু পথ যেতেই একটা ছোট ডোবার ধারে ব্যাধের জালে আটকে পড়া চিত্রাঙ্গকে দেখতে পেল সে। তাকে দেখেই অত্যন্ত ব্যাকুল হয়ে তার কাছে এসে লঘুপতনক বলল, ভদ্র চিত্রাঙ্গ! এ কী অবস্থা তোমার? লঘুপতনককে দেখে চিত্রাঙ্গ কিছুই বলতে পারল না উল্টে আরও বিমর্শ হয়ে পড়ল। পণ্ডিতেরা ঠিকই বলেন, বিপদের সময়ে প্রিয়জনকে দেখলে আবেগে প্রাণীর দুঃখ আরও যেন প্রবল হয়ে ওঠে। সত্যি বলতে সেই বিপদ চলে গেলেও, কোনও প্রিয়জন যখন সেই বিপন্ন মানুষের কাছে আসেন তখন তাঁকে দেখে বিগত সেই অসহনীয় সময়কে স্মরণ করে শোক যেন আবার নতুন ভাবে তাঁর কাছে ধরা দেয়।
একটু পরে কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে চিত্রাঙ্গ বায়স লঘুপতনককে বলল, মিত্র! আমি তো মরেই গিয়েছি বলে ধরে নাও। তাও শেষ বেলায় যে আপনার দেখা পেলাম এইটাই ভাগ্যের। লোকে বলে—
তদ্দ্বাভ্যাং সুখদং পশ্চাজ্জীবতোঽপি মৃতস্য চ।। (মিত্রসম্প্রাপ্তি, ১৭৫)
লঘুপনক তখন চিত্রাঙ্গকে আশ্বস্ত করে বলল, ওহে মিত্র! আমাদের মতো বন্ধুরা থাকতে তোমার এতো ভয় পাওয়ার প্রয়োজন নেই। আমি এখনই হিরণ্যককে নিয়ে ফিরে আসছি। কেবল একটাই কথা বলতে পারি যে বুদ্ধিমান পুরুষদের কিন্তু বিপদের সময়ে এইরকম ব্যাকুল হওয়া উচিত নয়। শাস্ত্রে বলে—
তং ভুবনত্রযতিলকং জনযতি জননী সুতং বিরলম্।। (ঐ, ১৭৭)

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৮৮: সুন্দরবনের পাখি — শালিক

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৭২: অপ্রিয় সত্য বলবার এবং শোনবার মানুষ জগতে দুর্লভ
এই কথা বলে লঘুপতনক চিত্রাঙ্গকে আশ্বাসন দিয়ে যেখানে মন্থরক এবং হিরণ্যক ছিল সেখানে ফিরে গেল। সেখানে গিয়ে চিত্রাঙ্গের যাবতীয় খবর তাদের দিল এবং তাঁকে ব্যাধের জাল থেকে মুক্ত করার জন্য ইঁদুর হিরণ্যককে পিঠে নিয়ে যতো দ্রুত সম্ভব ফিরে গেল চিত্রাঙ্গের কাছে।
হিরণ্যককে দেখে চিত্রাঙ্গের মনেও তখন একটু আশার আলো দেখা দিল। সে বলল, বিপদের হাত থেকে বাঁচতে বিদ্বান লোকেদের উচিত ভালো বন্ধু তৈরি করা। কারণ এই জগতে বন্ধুদের সাহায্য ছাড়া কেউই বিপদ থেকে মুক্ত হতে পারেন না। আমার সৌভাগ্য যে আমার তোমাদের মতন নির্মল মনের বন্ধু আছে।

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১০৩: গ্রহের ফের

উপন্যাস: আকাশ এখনও মেঘলা/৫
উত্তরে চিত্রাঙ্গ বলল, বন্ধুবর! এইটা বাদানুবাদের সঠিক সময় নয়। তাই সেই দুষ্ট ব্যাধ যতক্ষণ না এখানে এসে পৌঁছয় তার আগে দ্রুত আমার পায়ের এই ফাঁসটাকে কেটে দাও।
এই কথা শুনে হিরণ্যক হেসে বলল, আমি তো এসে পৌঁছে গিয়েছি। এখন আর ব্যাধকে কেন ভয় পাচ্ছো? আসলে নীতিশাস্ত্রের প্রতি এখন আর আমার ভরসা হচ্ছে না। না হলে তোমার মতো একজন নীতিজ্ঞলোকেরও কি করে এমন বিপদ হয়! এই জন্যেই তোমাকে প্রশ্ন করেছিলাম।
চিত্রাঙ্গ বলল, বন্ধু হে! ভাগ্য এমন একটা জিনিষ যে সেখানে বুদ্ধিও সবসময়ে কাজ করে না। বলা ভালো—
বুদ্ধযঃ কুব্জগামিন্যো ভবন্তি মহতামপি।। (ঐ, ১৭৯)
আসন্ন এবং অনিবার্য মৃত্যুপাশে কেউ যদি আবদ্ধ হন এবং দুর্ভাগ্যবশতঃ বাস্তব চিন্তাশক্তি যখন হ্রাস পায় তখন মহাপুরুষদেরও বুদ্ধি বাঁকা পথে চলতে শুরু করে। সবই হলো ভাগ্যের পরিহাস! বিধাতা কপালে যে অক্ষর পঙ্ক্তি লিখে দিয়েছেন কোনও পণ্ডিতের ক্ষমতা নেই তার অন্যথা করবার। তাই ভাগ্যে যদি বিপদ লেখা থাকে তাহলে তার থেকে বাঁচবার কোনও উপায় নেই। তাই ভাগ্যের কথা বেশি না বলাই ভালো। ভাগ্য আমাদের হাতে নেই। তাই ভাগ্যের দোহাই দিয়ে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকাও যায় না। মানুষকে নিজের কর্ম করতেই হয়।
দুজনের মধ্যে যখন এইসব কথাবার্তা চলছে সেই সময়ে লঘুপতনক দেখল দূরে মন্থরক ধীরে ধীরে এই দিকেই আসছে। তাকে দেখে লঘুপতনক বলল, “অহো! ন শোভনমাপতিতম্।” —এ তো মহা বিপদ।

গল্পবৃক্ষ, পর্ব-১৬: পূতিমাংসজাতক—শেয়ালের বুদ্ধি না ছাগলের বুদ্ধি?

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৬: জীবন নিয়ে কৌতুক আর ‘যৌতুক’
লঘুপতনক বলল, ব্যাধের কথা বাদ দাও। ওই দিকে চেয়ে দেখো মন্থরক আসছে। এইটা ও খুবই ভুল করে ফেলল। নীতিনিয়ম মানলো না। কারণ এখন যদি হঠাৎ দুষ্ট ব্যাধটা এসে উপস্থিত হয় তাহলে আমরা তো দ্রুত পালিয়ে যেতে পারবো কিন্তু এই মন্থরক তো তা পারবে না। আমি না হয় আকাশে উড়ে পালাবো; তুমি মূষিক, তাই জঙ্গলের মধ্যে সহজেই কোনও গর্তে লুকিয়ে হয়তো লুকিয়ে পড়বে; চিত্রাঙ্গও পালাবে লম্বা লাফ দিয়ে কিন্তু এই মন্থরক তো জলে থাকে। এই স্থলভাগে সে যাবে কোথায়? তার মন্থর গতির জন্য সেই ব্যাধের হাতেই ধরা পড়বে আর ওকে বাঁচাতে আমরা সকলেই তখন বিপদে পড়ব। এই জন্যেই আমি কিছুটা ব্যাকুল হয়েছি।
এই সব কথাবার্তার মাঝেই মন্থরক ধীরে ধীরে সেখানে এসে উপস্থিত হল।
হিরণ্যক তখন মন্থরককে বলল, “ভদ্র ন যুক্তমনুষ্ঠিতং ভবতা যদত্র সমাযাতঃ”—বন্ধু! এই কাজটা তুমি ঠিক করোনি। এ ভাবে এখানে চলে আসাটা ঠিক হয়নি তোমার। তাই সেই দুষ্ট ব্যাধ যতক্ষণ না আসছে তুমি যত দ্রুত সম্ভব এখান থেকে পালিয়ে যাও।

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১০১: অর্জুন প্রমাণ করলেন, রাজধর্ম পালনের ক্ষেত্রে মিথ্যাচারের কোনও স্থান নেই

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১১২: দারুণ এক গগনবিহারী খেলনা বানিয়েছিলেন গগনেন্দ্রনাথ
এদের মধ্যে যখন এই সব কথা বার্তা চলছে ঠিক সেই সময় কান পর্যন্ত ধনুকের জ্যা টেনে সেই শিকারী সেখানে এসে উপস্থিত হল। তাকে দেখেই ইঁদুর হিরণ্যক তো চিত্রাঙ্গের কাপড়ের বাঁধন কেটে দিল এবং চিত্রাঙ্গ নিমেষে একবার পিছন দিকে তাকিয়েই গভীর বনে পালালো। লঘুপতনক উড়ে গাছের মাথায় বসল আর হিরণ্যক পাশেই একটা গর্তের মধ্যে লুকালো।
এদিকে সেই শিকারীটি হরিণটাকে দূর থেকে পালিয়ে যেতে দেখে মনের দুঃখে মাটিতে বসে পড়ল। তখনই সে কূর্ম মন্থরককে দেখতে পেলো। সে তখন ধীর গতিতে পালাবার চেষ্টা করছিল। মনে মনে সে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিয়ে বলল, যদিও মৃগটাকে তিনি সরিয়ে নিলেন কিন্তু ব্যাধকে তিনি সম্পূর্ণ বঞ্চিত করেননি। আমার আজকে ভোজনের জন্য এই কচ্ছপটিকে অন্তত তিনি রেখে দিয়েছেন। আজ এরই মাংসে পরিবার পরিজনের খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
লঘুপতনকের আশঙ্কাই সত্য হল। মন্থরক পালাতে পারলো না। সেই ব্যাধটি একটি কুশঘাস দিয়ে মন্থরকে ধনুকের ডগায় বেঁধে তারপর সেই ধনুকটাকে কাঁধে লটকে বাড়ির পথে যেতে শুরু করল।—চলবে।