রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী।

 

মিত্রসম্প্ৰাপ্তি

দু’জন অভিন্ন হৃদয় বন্ধুর মধ্যে কিভাবে বিভেদ তৈরি করা যায় সেই কূটকৌশল নিয়ে পঞ্চতন্ত্রের প্রথম তন্ত্র ‘মিত্রভেদ’ শেষ করে আচার্য বিষ্ণুশর্মা এবার বলতে শুরু করলেন দ্বিতীয় তন্ত্র— ‘মিত্রপ্রাপ্তি’র কৌশল। যাদের মধ্যে চিরকালের শত্রুতা তাদের মধ্যে কিভাবে বন্ধুত্ব তৈরি করা যায় এই তন্ত্রের গল্প সেই নিয়েই। তাঁর নিজস্ব ভঙ্গীতে প্রথম শ্লোকেই এই তন্ত্রের কাহিনির একটা রূপরেখা দিয়ে তিনি বললেন—

অসাধনা অপি প্রাজ্ঞা বুদ্ধিমন্তো বহুশ্রুতাঃ।
সাধযন্ত্যাশু কার্যাণি কাকাখুমৃগকূর্মবৎ।। (মিত্রসম্প্রাপ্তি, ১)

জগৎ-সংসার সম্পর্কে বাস্তব বুদ্ধি যাঁর আছে, এমন পড়াশুনা করা বহুশ্রুত, প্রতিভাশালী মানুষ যদি কোনও কার্য সাধনে নিরুপায়ও হন। তাহলেও তাঁর মৈত্রীবন্ধন বা বন্ধুদের সহায়তা যদি সঠিক থাকে তাহলে কাক, ইঁদুর, হরিণ আর কচ্ছপের মতন তারা যেকোনও কাজ অনায়াসে সম্পন্ন করতে পারেন।

স্বাভাবিকভাবেই এ শ্লোক শুনে শিশু রাজপুত্ররা আমাদের মতনই একটু নড়েচড়ে বসে বলল, সেটা আবার ঠিক কিরকম?

আচার্য বিষ্ণুশর্মা তখন বলতে শুরু করলেন—
এইরকম শোনা যায় যে দাক্ষিণাত্য জনপদে মহিলারোপ্য নামে এক নগর ছিল। সেই নগরের উপকণ্ঠেই ছিল এক বিশাল বটবৃক্ষ। নানা দিক থেকে পাখিরা এসে বাসা বেঁধেছিলো সেই বিশাল বটগাছের ডালে। বটের ফল খেয়েই দিন গুজরান হতো তাদের। নানা কীটপতঙ্গেরও বাস ছিল সেই বটের কোটরে। তার সুবিশাল ঘন ছায়ায় কতো দেশবিদেশের পথিকেরা আশ্রয় নিতো। নির্জন দুপুরে ক্লান্ত হরিণের দলও আসতো সেখানে বিশ্রাম নিতে। গাছের বড় বড় পাতার আড়ালে বাসা বাঁধতো পাখিদল। ধূর্ত ধীবরেরা তাই খুঁজে পেতো না তাদের গাছের তলায় দাঁড়িয়েও এমনই ঘন পাতায় ভরা ছিল সেই গাছ।
বাঁদরের দলও থাকতো তার শাখা-প্রশাখায়। ফুলের গন্ধে ভ্রমরের দলও এসে জুটতো সারাটা দিন ভন্‌ ভন্‌ শব্দে মুখরিত হয়ে থাকতো সেই বটগাছটা। প্রকাণ্ড সেই বৃক্ষটি তার সমস্ত অঙ্গ দিয়ে প্রাণীদের আশ্রয় দিতো, তাদের রক্ষা করতো। সেই গাছেই লঘুপতনক নামে এক কাক বাস করতো। পাঠকদের ‘লঘুপতনক’ নামটিকে খেয়াল করতে বলবো। ‘লঘু’ শব্দের অর্থ হল হাল্কা আর যেটি হাল্কাভাবে পতিত হয় তাই ‘লঘুপতনক’। যে পাশে এসে পতিত হলে বা নামলে কোন শব্দই পাওয়া যায় না; নিঃশব্দে যে আপনার পাশে উড়ে এসে বসবে কিন্তু তার অস্তিত্ব আপনি কিছুই জানতে পারবেন না আর পাশ থেকে দরকারী কোনও জিনিস বা খাবার-দাবার কিছু তুলে নিয়ে গেলেও আপনার বুঝতে কিছুক্ষণ সময় লেগে যাবে—সেই হল ‘লঘুপতনক’। মানে কাক। সে দিনের বেলায় প্রতিদিনের মতো খাবার খুঁজতে যখন বেরোলো তখন দেখে জাল হাতে ভয়ঙ্কর দেখতে এক লোক আসছে।

নিকষ-কালো তার শরীর, চুলগুলো সব খাঁড়া-খাঁড়া। দেখে মনে হয় সাক্ষাৎ মৃত্যুর দেবতা যমরাজের সেবক সে। তাঁর বুঝতে একটুও দেরী হলো না যে সেই লোকটি একটা লুব্ধক অর্থাৎ শিকারী। জাল হাতে আসছে সেই বটগাছে বসবাসকারী প্রাণীদেরই ধরতে। না জানি বটবাসী প্রাণীদের কি দুর্ভোগ কপালে লেখা আছে ভাবতেই প্রাণ কেঁপে উঠল লঘুপতনকের। দ্রুত সে আবার ফিরে গেলো সেই বটবৃক্ষের শাখায়। সমস্ত পাখীদের ডেকে বলল, ওহে বন্ধুগণ! এক দুষ্ট শিকারী জাল হাতে তণ্ডুল নিয়ে এদিকেই আসছে। নিশ্চয়ই জাল বিছিয়ে সেই তণ্ডুল বা চাল ছড়িয়ে আমাদের ধরার মতলব করেছে। তাকে একেবারেই বিশ্বাস করবে না। সেই ছড়ানো চালগুলোকে একেবারে কালকূট বিষ ভেবে পরিত্যাগ করবে না হলেই নিশ্চিত মৃত্যু।

আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৪: স্বার্থান্বেষীকেও চিনতে শেখায় এই গ্রন্থ

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬২: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— সুখদর্শন ও হুড়ো

লঘুপতনক ঠিক যেমনটি আশঙ্কা করেছিল বাস্তবে হলোও তাই। সেই শিকারীটি ওই বটগাছটার কাছে এসেই মাটিতে জাল বিছিয়ে তার উপর বেশ কিছুটা সাদা সাদা বড় বড় দানার চাল ছড়িয়ে দূরে একটু আড়লে গিয়ে লুকিয়ে রইল। গাছের পাখিরা সবটাই দেখল কিন্তু লঘুপতনকের সাবধানবাণী তাদের যেন একেবারে পায়ে শিকল পরিয়ে রেখেছিলো। কেউই গেল না সেই ছড়ানো চাল খেতে। সবাই চুপ করে যে যার বাসায় বসে ব্যাপারটা দেখতে লাগল।

ঠিক এই সময়েই পরিবারের হাজার সদস্য নিয়ে কপোতরাজ চিত্রগ্রীব খাবারে খোঁজে ঠিক সেখান দিয়েই উড়ে যাচ্ছিল। আকাশ পথে যেতে যেতে দূর থেকে মাটিতে ছড়িয়ে থাকা সেই সাদা বড় বড় চালের দানা দেখতে পেল তারা। লঘুপতনক তাঁদেরকে হাজার বারণ করলো কিন্তু তারা কিছুই শুনলো না। সেই বলে না? লোভে পাপ আর পাপে মৃত্যু।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩৪: সরলাদেবী—নির্ভীক এক সরস্বতী

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩৬: আহা শ্রীরাধিকে চন্দ্রাবলী কারে রেখে কারে ফেলি

সকলে তারা সেই চাল খেতে সেখানে নেমে এল আর সপরিবারে লুব্ধকের জালে ধরা পড়ল। সেই বলে না! যে লোক লোভী হয় তাদের অবস্থা জলের মাছের মতো হয়। বিপদ যে কখন তাদের কাছে কোথা থেকে এসে উপস্থিত হয় কেউ জানে না। তাই লোভ খুব মারাত্মক জিনিষ। তাছাড়া কারো ভাগ্য যদি প্রতিকূল হয় তাহলেও এমন হয়। তাতে সেই ব্যক্তিকে দোষ দেওয়া যায় না। পণ্ডিতেরা দৃষ্টান্ত দেখিয়ে বলেন, পুণ্যশ্লোক ঋষি পুলস্তের পরিবারের জাত পৌলস্ত্য লঙ্কাধিপতি রাবণ কি জানতেন না যে অন্যের স্ত্রীকে হরণ করাটা অপরাধ? কিংবা সোনার হরিণ যে বাস্তবে হয় না শ্রীরামচন্দ্রও কি আর জানতেন না? জুয়া খেললে যে অনর্থ ঘটে জ্যেষ্ঠপাণ্ডব যুধিষ্ঠিরের মতো ধর্মপ্রাণ মানুষ কি জানতেন না? জানতেন তারা সবই; কিন্তু “প্রত্যাসন্নবিপত্তিমূঢমনসাং প্রাযো মতি ক্ষীযতে” —বিপদ যখন এসে সামনে উপস্থিত হয় তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় পুরুষের অধিকাংশ সময়েই বুদ্ধিনাশ হয়। এমনকি মৃত্যুও যখন শিয়রে এসে উপস্থিত হয় তখন মহাপুরুষদেরও ভাগ্যবিপর্যয় হয়; তাঁদেরও বুদ্ধি কাজ করে না। সহজ বুদ্ধি তখন তাঁদের অপথে-কুপথে চালিত করে “বুদ্ধযঃ কুব্জগামিন্যো ভবন্তি মহতামপি”।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৭০: জন্মান্তরের সুরসাধক আরডি বর্মন

এদিকে পায়রার দলটিকে জালে আটকে পড়তে দেখে সেই শিকারীটি তখন গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে বড় একটা লাঠি নিয়ে এগিয়ে চললো তাদেরকে মারবার জন্য। কপোতরাজ চিত্রগ্রীব তখন নিজেকে আর সেইসঙ্গে পরিবারের সকলকে জালে সেই শিকারীর জালে আটকে পড়তে দেখে সকলকে ডেকে বলল, “অহো ন ভেতব্যম্‌” —বন্ধুরা! আপনারা কেউ ভয় পাবেন না। পণ্ডিতরা বলেন, যেকোনও বিপদে যার বুদ্ধিনাশ হয় না সে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সেই বুদ্ধির প্রভাবেই সে সমস্তরকম বিপদ থেকে রক্ষা পায়। প্রকৃতির দিকেও তাকিয়ে দেখুন—
সম্পত্তৌ চ বিপত্তৌ চ মহতামেকরূপতা।
উদযে সবিতা রক্তো রক্তশ্চাস্তমযে তথা।। (ঐ, ৭)


উদয়কাল এবং অস্তকাল—উভয় সময়েই সূর্যদেব একই রকম রক্তবর্ণ ধারণ করে থাকেন। স্থিতধী মহান লোকেরা এমনই হন। তাঁরা আনন্দে কিংবা বিপদে একই রকম অচঞ্চল থাকেন। তাই এই বিপদের সময়ে আমাদের স্থির থাকাটা একান্ত প্রয়োজন। সকলে আমাদের এখন একজোট হয়ে এই জাল নিয়ে আকাশে উড়ে যেতে হবে। আমার বিশ্বাস সেটা আমরা অনায়াসেই করতে পারবো। যখন এই দুষ্ট শিকারী আমাদের চোখের আড়ালে যাব তখন কিছু একটা উপায় করে আমরা মুক্ত হবো। আপনারা যদি এখন সকলে প্রাণভয়ে ব্যাকুল হয়ে যান তাহলে কিন্তু এই জালটিকে নিয়ে অনায়াসে আমরা উড়ে যেতে পারবো না। আমাদের একজোট হতে হবে। শাস্ত্রে বলে —
তনবোঽপ্যাযাতা নিত্য তন্তবো বহুলাঃ সমাঃ।
বহূন্‌ বহুত্বাদাযাসান্‌ সহন্তীত্যুপমা সতাম্‌।। (ঐ, ৮)
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৯: হারিয়ে যাওয়ার ‘জীবন তৃষ্ণা’

এক-একটি তন্তু বা সুতো খুব সূক্ষ্ম আর লম্বা হলেও যদি অনেকগুলো একসঙ্গে জোড়া যায় তবে তা বহু ভার সহ্য করতে পারে। সজ্জনগণের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। অর্থাৎ তাঁরা স্বয়ং নির্বল হলেও যদি তাঁরা অন্যের সহায় লাভ করেন তাহলে যেকোনো বিপদ থেকেই মুক্ত হতে পারেন।
কপোতরাজের কথা শুনে অতি উত্সাহে সকলে মিলে জাল নিয়ে উড়তে শুরু করল আকাশ পথে। শিকারীটিও দৌড়াতে শুরু করলো তাদের পিছন পিছন। মনের আশা তখনও তার যায়নি। নিশ্চয় কখনও না কখনও তারা নিচে নামবে আর তখনই তাদের দলটাকে ধরবে সে। কারণ যতক্ষণ পাখীগুলো একজোট হয়ে আছে ততক্ষণ তারা উড়তেই থাকবে, কিন্তু যখনই তারা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-ঝাঁটি শুরু করবে তখনই ওরা জাল সমেত নিচে এসে পড়বে — “যাবচ্চ বিবদিষ্যন্তে পতিষ্যন্তি ন সংশযঃ।” —চলবে।
* পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি (Panchatantra politics diplomacy): ড. অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায় (Anindya Bandyopadhyay) সংস্কৃতের অধ্যাপক, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়।

Skip to content