রঘুরামণ
শ্রীরাধার উপরে তিন দাদা ছিল। রঘুরামন মেজো। তনিমা এই প্রথমবার গেলেও শ্রীরাধা আর তার মায়ের কাছে বাড়ির আত্মীয়-স্বজন এবং বাড়ির বর্ণনা এতবার শুনেছে যে তার কাছে পুরোটাই ভীষণ চেনা। বাড়ির লোকজন তনিমাকে এই প্রথম দেখলেও তার সম্বন্ধে আগেই বহু গল্প শুনেছে। ছবিও দেখেছে। ফলে তনিমা সে বাড়িতে সহজেই মিশে গেল।
শ্রীরাধা আর তনিমা ডোভার লেন পোস্ট অফিসের কাছে থাঙ্কমণি কুট্টির কলামন্ডলমে ভারতনাট্যম শিখতো। বসুন্ধরা ভিলার দুর্গাপুজোর অনুষ্ঠানে দুই বন্ধুতে নাচের প্রোগ্রামও করেছে। শ্রীরাধাদের হায়দরাবাদের বাড়িতে নাচগানের খুব কদর ছিল। নেচে-গেয়ে আশেপাশে নানান জায়গায় বেড়িয়ে কটাদিন ঝড়ের মতো কেটে গিয়েছিল। তারপর কলকাতায় ফেরা। তার পরে রেজাল্ট বেরোবার সঙ্গে সঙ্গেই সকলে মিলে ঝাঁপিয়ে পড়ে অনিরুদ্ধ সঙ্গে তনিমার বিয়ে দিয়ে দিল।
ফিরে আসার পর ওদের হায়দরাবাদে ছুটি কাটানোর ছবিগুলো নিয়ে এসেছিল শ্রীরাধা। রঘুরামনের তোলা ছবি। বেড়ানোর ছবি, নাচের ছবি— সবকটা ছবিতেই দারুণ সুন্দর দেখাচ্ছে। বাড়িতে তনিমার আগে তোলা ছবি ছিল। কিন্তু সে ছবিতে তাকে এত সুন্দর লাগছে না। অনিরুদ্ধদের বাড়িতে তার থেকেই দুটো ছবি বেছে পাঠিয়ে দেওয়া হল। বলা বাহুল্য এক কথায় পছন্দ।
সেই ছবিগুলোর মধ্যে একটা ছবি শ্রীরাধা সেদিন দেয়নি। দিয়েছিল পরে। তখন তনিমার বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে। সেই ছবির পিছনে লাল কালিতে লেখা ছিল—উইথ লাভ ফ্রম রঘু। তনিমা ব্যাপারটা আন্দাজ করেছিল কিন্তু খুব একটা নিশ্চিত ছিল না। একটা অদ্ভুত সংকোচ তাকে এ বিষয়ে তার এতদিনের বন্ধু শ্রীরাধাকেও কেউ কিছু বলতে আটকে দিয়েছিল। বলা হয়ে ওঠেনি রঘুর, বলা হয়ে ওঠেনি তনিমার। আর এ বিষয়টা আন্দাজ করেও কিছু বলতে পারেনি শ্রীরাধা পাছে তনিমা তাকে ভুল ভেবে বসে। একটা অদ্ভুত সংকোচ, ভুল ধারণা, ভুল বোঝাবুঝি এভাবেই জীবনের একটা উচিত সম্পর্ককে গড়ে উঠতে দিল না। শ্রীরাধা তনিমার বিয়েতে থাকতে পারেনি। বিয়ের অনেক আগেই শ্রীরাধার বাবা রিটায়ার্ড হয়ে গিয়েছিল। তারপর তো আর কলকাতায় থাকার কোনও মানে হয় না। পরিস্থিতি অন্যরকম হলে সময়টা হয়তো শ্রীরাধা নিজেই থেকে যেত তার প্রাণের বন্ধুর বিয়েতে। কিন্তু সে হয়তো ইচ্ছে করেই থাকতে চায়নি।
তনিমা ভেবেছিল তেলেগু বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া একরকম। কিন্তু ধ্যানধারণা আচারব্যবহারে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি পরিমণ্ডলে মানিয়ে নিতে পারাটা খুব শক্ত। শ্রীরাধা বা তার বাবা-মাকে বহুদিন ধরে দেখছে তনিমা, কিন্তু হায়দরাবাদে জেটি কাকিদের নিয়ে বিরাট যৌথ পরিবার। কাছাকাছি মামা-মামি তাদের ছেলেমেয়েরাও থাকে। সেখানে গিয়ে তনিমার পক্ষে আজীবন মানিয়ে চলাটা কতখানি সম্ভব? আসলে বাড়ির কাছে বিয়ের ঠিক হওয়ার পর, নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করতেই বোধহয় তনিমা এই সমস্ত ভাবনা মনের মধ্যে গড়ে তুলেছিল।
কিন্তু তার মনের ভুল ভেঙে গেল। ভেঙে গেল বড্ড দ্রুত। শ্বশুরবাড়িতে মানিয়ে নিতে অসুবিধা হয়, কিন্তু এখানে পরিস্থিতি একেবারেই উল্টো। তার শ্বশুরবাড়ির প্রত্যেকে তাকে আপন করে নিয়েছিল। শুধু তার স্বামী অনিরুদ্ধ ছাড়া। অনিরুদ্ধকে সে একবার একলা ঘরে সরাসরি প্রশ্ন করেছিল—
—তুমি যদি একটা সম্পর্কে ছিলে তাহলে বিয়ে করে একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করলে কেন?
অনিরুদ্ধ কোনও জবাব দেয়নি। অনিরুদ্ধর মধ্যে কোনও প্রতিক্রিয়া ছিল না। সে পাথরের মতো নিথর মুখে সব কথা শুনতো, কিন্তু কোনও জবাব দিত না। যে রাগারাগি করে চিৎকার করে ঝগড়া করে তার মনটাকে স্পষ্ট অনুভব করা যায়। ভালো খারাপ যাই হোক তার উপস্থিতির উত্তাপটুকু স্পর্শ করে। কিন্তু যে ভাবলেশহীন নিরুত্তাপ, সে তো অস্তিত্বহীন।
তনিমা তার এই মানসিক টানাপড়েনের কথা সুপ্রিয়া বৌদি, ঋতু, এমনকি তার মা আমার বড় জেঠিমা আরতিকেও বলেনি। তার সব সমস্যার কথা আমার মা সুরঙ্গমার কাছে খুলে বলেছে। তনিমা কাঁদেনি। হা-হুতাশও করেনি। স্পষ্টভাবে জানিয়েছে, তার পক্ষে অনিরুদ্ধ চক্রবর্তীর স্ত্রী হিসেবে বাকি জীবনটা বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। সেই সঙ্গে তনিমা আরও স্পষ্ট করে জানায়, বিবাহবিচ্ছিন্না বেচারি হয়েও সে বেঁচে থাকতে চায় না। শ্রীরাধার দাদা রঘুরামনকে সে পছন্দ করে। রঘুরামনও তাকে পছন্দ করে। কিন্তু কেউ কাউকে বলতে পারেনি। এই সম্পর্কটা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করার আগেই বাড়ি থেকে জোর করে অনিরুদ্ধ চক্রবর্তীর সঙ্গে তার বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। সে রঘুরামনের সঙ্গে কথা বলতে চায়। রঘুর আপত্তি না থাকলে, রঘুকেই সে বিয়ে করতে চায়।—চলবে।
* জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’। এখন লিখছেন বসুন্ধরা এবং…এর ৩য় খণ্ড।
‘সময় আপডেটস’-এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন। বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন। ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না। গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com