রবিবার ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫


পরপার। চিত্র সৌজন্য: সত্রাগ্নি।

 

পরপার

স্বর্ণময়ী চিরকালই খুব শান্ত প্রকৃতির মানুষ। তাঁর কাছে তাঁর ঘর, তাঁর সংসারই তাঁর নিজস্ব জগৎ। বিনয়কান্তিকে ব্যবসার পেশাদারি কারণেই নানান সামাজিক অনুষ্ঠানে গিয়ে উপস্থিত হতে হতো। জীবনের একেবারে শুরুতে যখন বিনয়কান্তির সামনে কঠিন সংগ্রাম, তখন স্বর্ণময়ী সর্বদাই পাশে পাশে থাকতেন। কিন্তু তারপর বিজয়লক্ষ্মী সদয় হোন। বিনয়কান্তি সমাজে প্রতিষ্ঠিত হলেন। বসুন্ধরা গ্রুপ অফ কোম্পানিজ তার ডালপালা নিয়ে দেশ-বিদেশে কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ল। তারপর থেকে স্বর্ণময়ী আবার নিজেকে গুটিয়ে নিলেন বসুন্ধরা ভিলার অন্দরমহলে।

দুর্গাপুজো ছাড়া কখনওই বাইরে আসতেন না। পুজোপাঠ নিয়ে থাকতেন। আর অসুস্থ হবার আগে পর্যন্ত ক্রমাগত গল্প-উপন্যাসে ডুবে থাকতেন। নিজের ছেলের লেখা তো নিয়মিত পড়তেনই, তারপর সেজছেলে অমলকান্তি এবং সেজবৌমা মানে আমার মা সুরঙ্গমার কাছে জানতে চাইতেন শারদীয়া লেখায় কোনও গল্প বা উপন্যাসটা ভালো। বাবা বলতেন—
—তোমার ছেলের থেকে সক্কলেই ভালো লেখে মা। অত বাছাবাছি করো না। সব লেখা ভালো।
—তুই তো জানিস সেজখোকা আমার পছন্দটা চিরকালই একটু সেকেলে। আজকালকার আধুনিক লেখাপত্র পড়ে দেখেছি আমার কেমন তারকাটা মনে হয়। পড়তে পড়তে দুঃখে বা আনন্দে চোখে জল না এলে রাগে চোয়াল শক্ত না হয়ে গেলে সে আবার আমার পছন্দ হয় না।
শ্মশানে চেয়ারে বসে এইসব ভাবছিল সাহিত্যিক অমলকান্তি দত্ত।

কেওড়াতলা শ্মশানঘাটে আলাদা করে ম্যাটাডোরে প্লাস্টিকের চেয়ার নিয়ে গিয়েছিল ছোটকার লোকজন। বড় জ্যাঠামণি শবদাহের রীতিনীতি মেনে সেখানেই এসে বসেছেন। স্বর্ণময়ীকে আগুনের খাঁচায় ভরে দিয়ে এসেছেন বাড়ির সকলে। তবে এ বারে বসুন্ধরার মতো প্রসেশন করে বালিগঞ্জ প্লেস থেকে রাসবিহারী হয়ে কেওড়াতলা শ্মশানে আসা হয়নি। একটা নিঃশব্দ গাড়ির লম্বা কনভয়ের মাঝে ছিল স্বর্ণময়ীর শীতাতপনিয়ন্ত্রিত শববাহীগাড়ি। প্রথমে ঠিক ছিল আমি আর ছোটকা সেই গাড়িতে বসবো। ঠিক তার পেছনের গাড়িতেই থাকবেন আমার দাদু বিনয়কান্তি দত্ত আর আমার বোন সানন্দা। বিয়ের পরেও সানন্দা তার পদবি দত্ত-ই লিখতো, শেষে ব্রাকেটে দাশগুপ্ত। ডাক্তার হিসেবে কাগজপত্র সব কিছুতেই সানন্দা দত্ত পরিচিত নাম। বিবাহবিচ্ছেদের পর পিছনের ব্র্যাকেটটা আর ব্যবহার করে না।
আরও পড়ুন:

দুই বাংলার উপন্যাস: ৩য় খণ্ড, পর্ব-১৬: চলো তারক তোমার দিদিকে পরপারে পৌঁছে দিয়ে আসি…

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৬৪: জঙ্গল বিপদে আছে…

দাদু জানালেন তিনি সানন্দাকে নিয়ে ওই শববাহী গাড়ির সামনে বসবেন। তারকবাবু একবার বলার চেষ্টা করেছিলেন—
—বিকেডি, আমরা পিছনের গাড়িতে সঙ্গে সঙ্গেই যেতাম।
—তারক! তোমার দিদি বসুন্ধরা ভিলা থেকে একা কোনওদিন বের হয়নি। নয় মা, নয় আমি। নয়ত সেজবৌমা। তা না হলে সেজখোকা সঙ্গে থাকত। আজ তাকে কি একা ছেড়ে দিতে পারি?
আমার মা সুরঙ্গমা বলেছিলেন—
—বেশ আমি যাচ্ছি ও গাড়িতে। আমার সঙ্গে নয় সানন্দা উঠবে, না হলে সানন্দা আপনার সঙ্গে পিছনের গাড়িতে আসুক। ছোট্টু তুই আমার সঙ্গে মায়ের গাড়িতে আয়।

এই দমবন্ধ পরিবেশ দাদু যেন হালকা করে দিতে চাইলেন। বুঝতে পারলাম আমার বাবার এই অদ্ভুত ক্ষমতাটার উৎস আমার দাদু।
—না না সেজবৌমা, স্বর্ণ আমায় বলেছে তোমায় নিয়ে রাস্তাঘাটে বেরোনোর অনেক ঝঞ্ঝাট। এই এতবছর পরেও লোকেরা তোমায় হাঁ করে দেখতে দাঁড়িয়ে যায়।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৭: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—বাইন ও গর্জন

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪৪: সারদা মায়ের মানসিক দৃঢ়তা

মা অবাক হয়ে দাদুর দিকে তাকিয়ে আমাকে একবার দেখলেন, মা-ও বোধকরি আমার মতো একই কথা ভাবছিলেন। কিন্তু তারপরেই দাদু যে কথা বললেন সেটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
—সেজবৌমা তোমার খেয়াল আছে? মায়ের মৃত্যুর দিনে আমার সঙ্গে গাড়িতে তুমি ছিলে বসুন্ধরা ভিলা খালি করে আমার মা বসুন্ধরা দত্ত পরলোকে পা বাড়িয়েছিল। কিন্তু সেদিন বসুন্ধরা ভিলা আগলে ছিল স্বর্ণময়ী। আজ সেও বসুন্ধরা ভিলা ছেড়ে গেল। তুমি ঘরে থাকো সেজবৌমা। আমার শরীর নিয়ে ভেবো না। আমি ঠিক আছি। আমার সঙ্গে সানন্দা রইল। তুমি শান্তির খেয়াল রেখো। ডাক্তার নার্সদের বলো যা যা দরকার সে সব করতে।

বলা হয়নি আমার পিসিমণি শান্তিলতা কখনও কোনওদিন টেনশন নিতে পারেন না। পিসেমশাইয়ের আচমকা মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পর থেকে পিসিমণির এই সমস্যা শুরু হয়েছে। শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যায় প্রেশার ফল করে। বাবুদাদাকে যে দিন লালবাজারে ধরে নিয়ে গেল সেদিনও পিসিমণির এমন হয়েছিল। যেদিন ভোররাতে টেলিফোনে কীরা কাকিমা প্লেন ক্র্যাশে তন্ময়কান্তির মৃত্যুসংবাদ শুনিয়েছিলেন সেদিনও একই অবস্থা। আজ পিসিমণি নিচে আসতে পারেননি তিনতলার বারান্দার থেকে একবার তাঁকে মুখ বাড়িয়ে ঠাকুরদালানে শোয়ানো স্বর্ণময়ীকে দেখানো হয়েছিল।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৬: যন্ত্রণাদগ্ধ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ রাঁচিতে পেয়েছিলেন সান্ত্বনার প্রলেপ

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২১: গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী—এক শক্তির গল্প

স্বর্ণময়ীকে চুল্লিতে পৌঁছে দেওয়ার পর বিনয়কান্তি আর দাঁড়াননি। সানন্দাকে বলেছিলেন—
—চল মা আর আমার কিছু করণীয় নেই। তারক তুমি এদিকটা দেখে রেখো। আর শোনো এখানে খোকারা যেন স্নানটান না করে জলটা বড় নোংরা হয়ে আছে। এখানে নিয়মকানুন করে মায়ের বেলায় যেমন আমি বাবুঘাটে গিয়ে স্নান করেছিলাম, সেরকম ভাবেই ওদের স্নান করিয়ে বাড়ি নিয়ে এসো।—চলবে।
* জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’। এখন লিখছেন বসুন্ধরা এবং…এর ৩য় খণ্ড।
‘সময় আপডেটস’-এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন। বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন। ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না। গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com

Skip to content