আকাশ ভরা মেরুজ্যোতি। ছবি: অঙ্কনা চৌধুরী।
আলাস্কার আকাশে মেরুজ্যোতি দেখা যাবে কিনা সেটা বোঝা যায় ‘কেপি ইনডেক্স’ বলে একটি ধ্রুবকের সাহায্যে। এটা আসলে সৌরঝড় পরিমাপ করার একটি ধ্রুবক। এর মান ‘০’ থেকে ‘৮’ এর মধ্যে পরিবর্তিত হতে থাকে। শূন্য হওয়ার অর্থ কোনও সৌরঝড় নেই। অর্থাৎ মেরুজ্যোতি দেখারও কোনও সম্ভাবনা নেই। আর আট হওয়ার অর্থ প্রবল সৌরঝড়; অর্থাৎ মেরুজ্যোতি দেখার সম্ভাবনা প্রবল। অবশ্যই ওই কেপি ইনডেক্স ধ্রুবকটি আটের যত কাছাকাছি থাকে মেরুজ্যোতি তত স্পষ্ট দেখা যায়। তার সর্পিল গতি তত তীব্র হয়। তাতে রঙের পরিমাণও বাড়তে থাকে।
মুঠোফোনের একটি অ্যাপ অথবা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট থেকে এই ধ্রুবকটির তাৎক্ষণিক মান জানা যায়। আমরা সেই মান দেখেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ি ক্যামেরা হাতে নিয়ে। আমার অভিজ্ঞতা অনুযায়ী কেপি ইনডেক্স ১ থেকে ২ হলে তাকে প্রায় দেখাই যায় না। খুব অন্ধকার, চারিদিক খোলা জায়গা থেকে দেখা গেলেও তাকে দেখতে হয় সাধারণ একটা লম্বা সাদা মেঘের রেখার মতো। ৩ থেকে ৪ এর মধ্যে হলে মেরুজ্যোতি হয় উজ্জ্বল সবুজ রঙের। ঠিক যেন মনে হয় আকাশের ওই প্রান্ত থেকে কেউ প্রচণ্ড জোরালো গ্যাসলাইটের আলো জ্বালিয়েছে যা সারা আকাশে ছড়িয়ে পড়ছে।
আরও পড়ুন:
রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-২৫: গোপন প্রেমিকার মতোই সে রোজ কিছুক্ষণের জন্য দেখা দিয়েই চলে যায়
এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-৩: ত্রিপুরা সমৃদ্ধিতে রাজা বিজয় মাণিক্যের ভূমিকা অপরিসীম
কেপি ইনডেক্স ৪ থেকে ৬ মধ্যে হলেই প্রত্যক্ষ করা যায় মেরুজ্যোতির সর্পিল গতি। এই সময়ে সবুজের সঙ্গে মিশে থাকে লালচে বেগুনি। এই সময় থেকেই তার রূপ হয়ে ওঠে অসাধারণ। আমরা কেপি ইনডেক্স ৩ থেকে ৬ এর মধ্যে এলেই বেরিয়ে পড়ি বাড়ি থেকে মেরুজ্যোতিকে ক্যামেরাবন্দি করার উদ্যেশ্যে। আর এরও ওপরে গিয়ে ৮ ছুঁলে সে যেন এক স্বর্গীয় অনুভূতি। ক্যামেরাবন্দি করে তার রূপ বোঝানো যায় না। আমি এ যাবৎ কাল একদিনই দেখেছি কেপি ইনডেক্স-এর মান ৮ হতে। সেই গল্পই বলবো এবার।
আরও পড়ুন:
হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৩৫: ঘুম ঘুম চাঁদ ঝিকিমিকি তারা
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬২: প্রথম রবীন্দ্রজীবনী
তবে তার আগে বলে নিই মেরুজ্যোতি দেখার প্রত্যহিকী, মানে প্রতি রাতে মেরুজ্যোতি আমরা কীভাবে দেখি। সে এক মজার ব্যাপার। আমার সহধর্মিনী এই ব্যাপারে আমার থেকেও বেশি উৎসাহী। সে আবার ওসব অ্যাপ বা ওয়েবসাইটের ওপর অত নির্ভর করে না। প্রতিদিনই রাতে খাওয়া দাওয়া শেষ হলেই নিয়ম করে একবার ঘরের জানলা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে নেয়। একবার বললে অবশ্য ভুল বলা হবে; মানে থেকে থেকেই একবার করে ঘরের জানলা দিয়ে দেখে আসে যে আকাশে কিছু দেখা যাচ্ছে কিনা।
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩৮: অভিভাবিকা মা সারদা
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫৫: ধর্ম, অর্থ, কাম—এই ত্রিবর্গের সাধন, ভীমসেনের আচরণে কী প্রতিফলিত হয়েছে?
আমাদের বাইরের ঘরের জানলার পূর্বমুখী আর তার সামনেটা পুরো ফাঁকা। সেখান দিয়ে আকাশের অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। আর ওই আকাশে দূরে কোথাও একটু সবুজ আলো দেখা গেলেই হই হই শুরু যায় বাড়িতে। সবুজের ছিটে টুকু দেখা গেলেও তার সঙ্গে সঙ্গে হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে পড়া চাই। মাঝে মধ্যে তো এমন ও হয়েছে যে শহরের কোনও নীলচে সবুজ আলোর মেঘে প্রতিফলন দেখে তাকে মেরুজ্যোতি ভেবে সে বেরিয়ে পড়েছে ছবি তুলতে।
আইস আইস আলাস্কা। ছবি: অঙ্কনা চৌধুরী।
সে যাই হোক, এই জিনিস আজ যতদিন হল সে এখানে এসেছে প্রতি শীতের রাতেই নিয়ম করে করে যাচ্ছে। প্রথম দিকে, মানে সবে সবে যখন কলকাতা থেকে এসেছে, তখন তাও ওই ঋণাত্মক ৩০-৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ঠান্ডার মধ্যে বেরোতে একটু ভয় পেত। তবে সেসব ভয়-ডর প্রথম দু-মাসের মধ্যেই চুকে গিয়েছে। এখন তো দেখি মাঝে মধ্যেই বেরিয়ে যাচ্ছে কোনওরকমে একটা শীতবস্ত্র গায়ে চাপিয়ে; তারপর প্রায় মিনিট দশেক ধরে বাইরে ছবি তুলে শেষে ফিরছে ঠান্ডায় হি হি করতে করতে, হাত পা সব জমিয়ে। তারপরে ছুটতে ছুটতে ঘরে ঢুকেই ঘর গরম করার হিটারটা একদম জোরে করে দিয়ে তার সামনে বসে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে আরও আধঘণ্টা কাটাতে হয়।—চলবে।
* রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা (Mysterious Alaska) : ড. অর্ঘ্যকুসুম দাস (Arghya Kusum Das) অধ্যাপক ও গবেষক, কম্পিউটার সায়েন্স, ইউনিভার্সিটি অব আলাস্কা ফেয়ারব্যাঙ্কস।