শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


‘বাবলি’ ছবির একটি দৃশ্যে আবীর এবং শুভশ্রী। ছবি: সংগৃহীত।

 

বাবলি

কাহিনি বৈশিষ্ট্য: রোম্যান্টিক (২০২৪)
মূল কাহিনি: বুদ্ধদেব গুহ
ভাষা: বাংলা
প্রযোজনা: রাজ চক্রবর্তী এন্টারটেইনমেন্ট
পরিবেশনা: পিভিআরইন বক্স পিকচার
সংলাপ: সৌভিক ভট্টাচার্য
চিত্রনাট্য ও নির্দেশনা: রাজ চক্রবর্তী
অভিনয়ে: আবির চট্টোপাধ্যায়, শুভশ্রী গঙ্গোপাধ্যায়, সৌরসেনী মৈত্র, কৌশিক ও রেশমিসেন, সোহিনী সেনগুপ্ত প্রমুখ
সময়সীমা: ১৩৪ মিনিট
রেটিং: ৬.০/১০

১৫ অগাস্টে মুক্তি পেয়েছে আবির চট্টোপাধ্যায় ও শুভশ্রী গঙ্গোপাধ্যায়ের জুটির প্রথম ছবি বাবলি। দূর্ভাগ্যবশত ৯ অগাস্ট থেকে সময়টা বড় কঠিন, আপামর মানুষের মন ভালো নেই। তাই বাবলিকে নিয়ে যে উন্মাদনা খুব স্বাভাবিক ছিল, তা হয়ত হয়নি।
বাবলি দেখার ইচ্ছে অনেকগুলো।

প্রথমত: বুদ্ধদেব গুহ’র অনবদ্য মিষ্টি প্রেমের উপন্যাস। আমাদের ছোটবেলায় বুদ্ধদেব গুহ’র বাবলি বা খেলা যখন বাড়িতে নয়, পাড়ার লাইব্রেরিতে থাকত। হার্ডবোর্ড কালচে মলাটের ওপর মার্কা থাকতো ‘বু/গু-২’ বা ‘বু/গু-৩’। তখন থেকে দময়ন্তী-অভিরূপ-ঝুমাদের চিনি। এতদিন পরে দেখা হবে।

দ্বিতীয়ত: আবির অভিরূপ আর শুভশ্রী বাবলি-এর চেয়ে যথাযথ চরিত্র নির্বাচন আজকের সময়ে বোধহয় আর হয় না। শুনলাম এটা নাকি লেখকেরই পছন্দ ছিল। ঝুমা অনেকেই হতে পারতেন। সৌরসেনী মৈত্র গুণী অভিনেত্রী।

তৃতীয়ত: মিনার রহমানের গান ‘ডুবে আছি’, বাবলি ছবিতে এই নেশালাগা গান কেমন লাগে তা দেখার লোভ ছিল। আর শেষ কারণ বুদ্ধদেব গুহ’র বাবলিকে রাজ চক্রবর্তী কেমন ভাবে দেখেছেন সেটা দেখার।
অভীর বেয়ারা-কাম-কুক-লোকাল গার্জেন কুলো সিং-কে আমরা দেখিনি কিন্তু বড় মেমসাহেবের ফোনটা এসেছিল। এরপর গল্প ধরেই গাড়ি চলল পাহাড়ি পথে। উল্টোদিক থেকে আসা গাড়ির বেয়াদপ ড্রাইভারকে অভি ‘শালা’ বলে ফেলে বাবলির মতো ভদ্রমহিলার সামনে বিব্রত হওয়াটুকু উপন্যাসে ছিল কিন্তু এখানে চিত্রনাট্যকার এবং অবশ্যই সংলাপ রচয়িতা বাবলির মুখে “আমি মহিলা, ভদ্রমহিলা নই” সংলাপ সংযোজন যথার্থভাবে বাবলির চরিত্রের আত্মবিশ্বাসী এবং কথায় কথায় মজা করার ধরণকে স্পষ্ট করে। যা সারা ছবি জুড়ে আরও স্পষ্ট হয়েছে। আর বাড়িতে অফিসে বা অভির সামনের এই চূড়ান্ত আত্মবিশ্বাস হঠাৎ চুরমার হয়ে যায় এয়ারহোস্টেস বান্ধবী ঝুমার ব্যাগে সুইমিংপুলে অভির খোলা শরীরের ছবি দেখে। তবে কী?
আরও পড়ুন:

মুভি রিভিউ: ফের একসঙ্গে দীপিকা-অমিতাভ, ‘দ্য ইন্টার্ন’-এর হিন্দি পুনর্নির্মাণে দেখা যাবে এই জুটিকে

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬৪: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—গিরা শাক ও যদু পালং

হ্যাঁ, এই “তবে কি অভি আর ঝুমা…” এই প্রশ্নটা এতদিনের আত্মবিশাসী মেয়েটাকে স্বার্থপর করে দিল, নিজের মোটাত্ব নিয়ে অনবরত নিজেকে ঠাট্টা করতে পারা কনফিডেন্সে চিড় খেয়ে গেল। চরিত্রের এই আলো আর অন্ধকারকে অনবদ্য দক্ষতায় ছবিতে এনেছেন অভিনেত্রী শুভশ্রী। আমার বিচারে অভিনেত্রী হিসেবে বাবলি শুভশ্রীর সবচেয়ে পরিণত কাজ।

হ্যাঁ, আমি মেহুল, মুন্নি বা ইন্দুবালা মল্লিক সকলকে দেখেই দময়ন্তী বা বাবলিকে সেরা বেছেছি। মেহুল, মুন্নি বা ইন্দুবালার মতো বাবলি’র চরিত্রে কোনও ড্রামাটিক বা সেন্টিমেন্টাল টুলস ছিল না। যেটা দিয়ে চরিত্রকে চালনা করা যায়। একট পড়াশোনায় ভালো মোটাসোটা মিষ্টি মেয়ে একটি সুপুরুষ ভদ্রছেলেকে ভালবেসে ফেলেছে। পরে আরও জেনেছে ছেলেটির অসাধারণ সব গুণের কথা, প্রেম গাঢ় হয়েছে। তার পরেই তাকে হারিয়ে ফেলার আশংকা। এখানে নাটক নেই, জীবনযুদ্ধ নেই, প্রতিশোধের আগুন নেই। ক্যানভাসে চড়া তেলরঙের জোরালো স্ট্রোক নেই, হালকা জলরঙে আঁকা আবছা অবয়বকে ফুটিয়ে তোলার চ্যালেঞ্জ ছিল বাবলি। অভিনেত্রী সসম্মানে উত্তীর্ণ।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩৯: ভারতের বিপ্লবী মেয়েরা এবং অন্তরে রবীন্দ্রনাথ

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৫২: পুলক রাখিতে নারি (কেল)

আবির অধুনা বাঙালির ম্যাটিনি আইডল। ষাট-সত্তর বা আশির দশক থেকে কাটাকাটা আঁকা মুখ নয়, অল্প ভোঁতা নাক, মোটা ঠোঁট, ভারি গাল নিয়েও যিনি বাঙালির কল্পনায় শেষ সুপুরুষ হয়ে এখনও ছেয়ে আছেন। কারও অমন ছেলে, অমন ভাই, দাদা বন্ধু প্রেমিক বা স্বামী হয়ে আজও তিনি সমান প্রাসঙ্গিক সেই উত্তমকুমারের সিংহাসন স্বসম্মানে ছেড়ে রেখেও গালে অল্পকাটা দাগ আর পদবীর মিল নিয়ে আজকের বাঙালির প্রিয় রোম্যান্টিক নায়ক আবির। হাঁকডাক চিৎকার-চেঁচামিচি না করেও সুকঠিন পুরুষ। এ পর্যন্ত অভিনীত তাঁর কোনও চরিত্রের ম্যানারিজমে আটকে না থেকে অক্লেশে যেকোনও চরিত্রের দেওয়াল ভেদ করে যেতে পারেন আবির। ঠিক যেমন অক্লেশে লন্ডনের কিংক্রস স্টেশনের ৯ আর ১০ নম্বর প্ল্যাটফর্মের মাঝে দেওয়ালের মধ্যে দিয়ে অক্লেশে ট্রলি নিয়ে পৌনে দশ নম্বর প্লাটফর্মে যেতে পারেন হ্যারিপটার ও তার হগওয়ার্টসের বন্ধুরা।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩

রহস্য উপন্যাস: হ্যালো বাবু!, পর্ব-৪৬: দুবেজিকে নিয়ে ধৃতিমানের অনুমান সত্যি

আবির অভিনীত অভিরূপ তাই ব্যোমকেশ, ফেলুদা, সোনাদা, নাসের আলি, দেব দাস, জিজো, প্যাট, অর্ক, অ্যাবি সেন, জয় চট্টোপাধ্যায়, বোধিসত্ব, বাচস্পতি, শিবু হালদার, পাবলো, দীপক চট্টোপাধ্যায়, মিনির বাবা, আইপিএস পঙ্কজ সিনহা বা রয়্যাল বেঙ্গলের আরেক অভিরূপের মতোই অসংখ্য বিপরীতমুখী বা খুব কাছাকাছি চরিত্রে সমান স্বাভাবিকতায় বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠতে পারেন। আগামীতে আরও চরিত্রের বহুরূপে এই অভিনেতাকে দেখবো তবে পুতুলনাচের ইতিকথায় শশী’র অপেক্ষায় আছি।

একইভাবে আমার ব্যক্তিগত বিচারে ‘বাবলি’ রাজ চক্রবর্তীর সবচেয়ে পরিণত ছবি। আগের করা ছবিগুলি ভালো, চ্যাম্প বা পরিণীতা বিশেষভাবে ভালো লেগেছিল কিন্তু বাবলির মেকিংয়ের মধ্যে কেমন একটা ভালোলাগা ছন্দ আছে যা রাজের আগের কোনও ছবিতে পাইনি। দৃষ্টিনন্দন লোকেশন বাহুল্যবর্জিত দৃশ্য ভাবনা আর অভির ডাকে সাড়া দিয়ে বাবলির দিল্লি থেকে ইম্ফল বিমানযাত্রায় মূলগল্প বলার চেষ্টাটা সুন্দর। না হলে ছবির ক্লাইম্যাক্স দৈর্ঘ্য শেষের আকর্ষণ সবকিছুর সঠিক সমাপতন হত না।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৮২: খটকা

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-১০: মর্ত্যে আনিল ধ্রুবতারকারে ধ’রে

তবে গল্পে রাজীবলোচন ও সাদা পাঁঠার গড়াগড়ি পড়ে যেমন মজা হয়েছিল। দৃশ্যে সে মজা পাইনি। বরং আমার ব্যক্তিগতভাবে পুরোছবির দূর্বলতম দৃশ্য বলে মনে হয়েছে। কালো লঙ্কা নিয়ে রাজীবের সংলাপ এই ছবির আভিজাত্যে অপ্রয়োজনীয় মনে হয়েছে অভিনয়েও একসময়ের অফিস থিয়েটারের কমেডির ছাপ।

এয়ারহোস্টেস ঝুমা বোস সুন্দর। নিমেশকাকা ও কাকিমার ভূমিকায় কৌশিক ও রেশমি সেন ভালো মানিয়েছেন। কয়েকটি গান বেশ ভালো। তবে “ডুবে আছি” বারবার শুনেও যেন আবারও শুনতে ইচ্ছে করে। এখনও কলকাতার প্রেক্ষাগৃহে এ ছবি প্রদর্শিত হলে অবশ্যই দেখে ফেলুন না হলে ওটিটির অপেক্ষায় থাকুন। স্বর্ণযুগের বাংলাছবির রোমান্টিক সুইমিং পুলে ডুবতে চাইলে বাবলি একবার দেখতেই হবে।
* জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। ‘বুমেরাং’ চলচ্চিত্রের কাহিনিকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’। এখন লিখছেন বসুন্ধরা এবং…এর ৩য় খণ্ড।

Skip to content