মঙ্গলবার ৩ ডিসেম্বর, ২০২৪


ছবি : প্রতীকী।

প্রতিভাময়ী এবং সুন্দরী ভার্জিনিয়া উলফের জীবন ঝঞ্ঝা-সঙ্কুল ও বন্ধুর। অনেক ওঠা নামা, মানসিক অসুস্থতা, বার কয়েক আত্মহননের চেষ্টা, এ সব নিয়ে ভার্জিনিয়ার জীবন। কিন্তু তার সৃষ্টিশীল সত্ত্বা বিকশিত হয়ে উঠেছে তার স্বামী লিওনার্ড-এর সাহচর্য এবং ত্যাগের ভিত্তিতে। ভার্জিনিয়াকে এগিয়ে দিতে গিয়ে লিওনার্ড নিজেকে বিকশিত করতে পারেননি। তার বিখ্যাত রচনা সৃষ্ট ও প্রকাশিত হয়েছে ভার্জিনিয়ার মৃত্যুর পর। স্ত্রীর জন্য স্বামীর এমন ত্যাগ সাহিত্যের ইতিহাসে বিরল।
ভার্জিনিয়ার মানসিক অসুস্থতার শিকড় তার শৈশবে। সৎ ভাই জর্জ ডাকওয়ার্থ-এর যৌন হেনস্থার শিকার হন মাত্র ছ’ বছর বয়সে। তারপর আবার মায়ের মৃত্যুর পর সমবেদনা জানানোর অছিলায় ভার্জিনিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হন জর্জ। পরবর্তীকালে তার জীবনীকার এই মনোবেদনার কথা লিখেছেন। বারবার জীবনের দুর্বল মুহূর্তে, বাবা ও মা এর মৃত্যুর সময় জর্জ তাকে যৌন হেনস্থা করেছে। ভার্জিনিয়ার মনে হয়েছে যে, বিকশিত হওয়ার আগেই জর্জ তার জীবন নষ্ট করে দিয়েছে।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩

গল্পবৃক্ষ, পর্ব-৩: ভাবিয়া করিও কাজ

এ সব ঘটনার পর থেকে তার মনে যৌন জীবন সম্মন্ধে এক আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতার জন্ম হয়। মৃত্যু, ঘৃণা, লজ্জা এবং ভয় মিশ্রিত তার প্রথম জীবনের অভিজ্ঞতা। পরবর্তীকালে ভার্জিনিয়ার মানসিক অবসাদ ও অসুস্থতা, বিবাহিত যৌন জীবনে ঔদাসীন্যর কারণ হিসেবে অনেকটাই জর্জ দায়ী। তাঁর জীবনীকার ‘Quentin Bell’ বাবার মৃত্যুর তিন মাস পর তার সাময়িক ক্ষিপ্ততার এক পুঙ্খানুপঙ্খ বিবরণ দিয়েছেন। যে সময়টিতে ভার্জিনিয়ার মানসিক অসুস্থতা দেখা দিত তখন তিনি আশেপাশের সবাইকে সন্দেহ করতেন, তার বোন ভ্যানেসা, তার নার্সদের।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৮৬: সুযোগ্য প্রশাসকের মৃত্যুর অভিঘাত

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৬৯: শ্রীমার সন্তানস্নেহ

মনে হতো এরা সব শয়তান, মনে হত ভিতর থেকে তাকে কেউ অপরাধ করতে আদেশ করছে। কোনও কারণ খুঁজে পেতেন না এমন চিন্তার। ভাবতেন বেশি খেয়ে ফেলার জন্য এমন অবস্থা হচ্ছে। খাওয়া বন্ধ করে দিতেন। বুঝতে পারছেন ভিতরে কোনও অসুবিধে কিন্তু নিজের ওপর তার কোনও নিয়ন্ত্রণ থাকতো না। খুব অসহায় হয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতেন। বোন ভ্যানেসা এরকম এমারর্জেন্সিতে ভার্জিনিয়াকে তার বাড়ি বার্নহাম উড-এ নিয়ে গেলেন। এখানেই প্রথমবার তিনি আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। বোনের বাড়ির জানালা দিয়ে লাফিয়ে পরেন। সৌভাগ্যবশত জানালা বেশি উঁচু ছিল না। তাই বেঁচে যান।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭১: সুন্দরবনের পাখি: সবুজ বক

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫১: সেই ‘পৃথিবী আমারে চায়’

এ অবস্থা থেকে যখন মুক্ত হতেন তখন ভার্জিনিয়ার মনে হত যেন পুনর্জন্ম হত। যেন অন্য এক জীবনে ছিলেন এতদিন। তার সৃজনী শক্তি ফিরে আসত, শরীরে ফিরে আসত এক অপরূপ স্বর্গীয় লাবণ্য। ছিপছিপে সুন্দর চেহারা, ভাসা ভাসা আয়ত নীল চোখ, সাদা লম্বা পোশাক ও বড় হ্যাট, যেন স্বর্গভ্রষ্ট এক দেবকন্যা। লিওনার্ড যখন স্টিফেন সিস্টার দের কেমব্রিজ কলেজ এ দেখেন তখন চমকিত হয়ে তার বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। তারপর তার সাথে আলাপচারিতায় আরেক চমক। এত বুদ্ধিদীপ্ত ,ধীর স্থির তার কথা! চিত্রকর ডোরা কারিংটন, তাদের পারিবারিক এক বন্ধু ভার্জিনিয়ার এতটাই গুণমুগধ যে, তাঁর মতে পৃথিবীর আদিকাল থেকে ধরলে খুব কম মহিলাই রূপে ও বুদ্ধিমত্তায় ভার্জিনিয়া র তুল্য।

ভার্জিনিয়ার সৌন্দর্যে কেমব্রিজ কলেজে অনেকেই আকৃষ্ট হয়েছিলেন এবং প্রেম নিবেদনও করেন। লিটন স্ট্রেচি, আইনজীবী হিলটন, শিক্ষক ওয়াল্টার ল্যাম, বুদ্ধিজীবী সিডনি ওয়াটারলো এরা সবাই প্রেম নিবেদন করেন। তবে শেষ পর্যন্ত ভার্জিনিয়া-জয়ের মুকুটটি যায় লিওনার্ড উলফ এর মাথায়।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪২: যোগমায়া দেবী—এক প্রতিবাদী নারী

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

লিওনার্ড এক বিশিষ্ট ব্যারিস্টার এর ছেলে। ১৮৯৯ সালে ভার্জিনিয়ার ভাই থবির সঙ্গে ট্রিনিটি কলেজে পড়তে আসেন। লিওনার্ড খুব ধীরস্থির, বুদ্ধিমান এবং যুক্তিবান। ১৯০৪ সালে ভার্জিনিয়া যখন প্রথমবার আত্মহত্যার প্রচেষ্টার পর সুস্থ হচ্ছেন, লিওনার্ড তখন চাকরি নিয়ে শ্রীলঙ্কায় পাড়ি দিয়েছেন। গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদে ছিলেন তিনি। দীর্ঘ সাত বছর তিনি নির্বাসনে থাকার মতো শ্রীলঙ্কায় একা ছিলেন। সেখান থেকে ফিরে কেমব্রিজ কলেজে অপরূপা ভার্জিনিয়াকে দেখে মুগ্ধ হন। তাঁকে প্রেম নিবেদন করেন। ভিনদেশে লিওনার্ড-এর অভিজ্ঞতার ব্যাপ্তি, গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন আবার তারই সঙ্গে লেখালেখি, এসবই তার বিবাহযোগ্যতার মাপকাঠি হল ভার্জিনিয়ার কাছে। ভার্জিনিয়া লিখেছেন, “Leonard ruled India, hung black men, shot tigers…and had written a novel.” তাই অবশেষে বরমাল্যখানি এলো লিওনার্ড-এর গলায়।—চলবে।
* ড. দুর্গা ঘোষাল (Durga Ghoshal), প্রাক্তন অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content