শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


প্রতিমাদেবী।

একটি মেয়ের গল্প না বললে সরস্বতীর লীলাকমল বিভাগটি অসম্পূর্ণ। আসলে প্রতিমাদেবী ছিলেন আদতেই রূপে লক্ষ্মী গুণে সরস্বতী। বিশ শতকের মেয়েদের আধুনিক করতে তাঁর অবদান ছিল অসীম। লেখালিখির চেয়ে অনেক বেশি কর্মমুখর ছিল তাঁর জীবন। তবু তাঁর লেখনিও বিশ শতকের সম্বল। প্রতিমা নামের মেয়েটির তখন এগারো বছর বয়স। অবনীন্দ্রনাথ আর গগনেন্দ্রনাথের ছোট বোন বিনয়িনী দেবী এবং শেষেন্দ্রভূষণ চট্টোপাধ্যায়ের কন্যা প্রতিমা। তাঁর বিয়ে হয় গুণেন্দ্রনাথের বোন কুমুদিনীর নাতি নীলানাথের সঙ্গে। তখন পিরালি ঘরে এমন কাছাকাছি সম্পর্কে বিয়ে হতো।

কিশোরী প্রতিমাও নিয়ম মেনে শ্বশুরবাড়ি গেলেন। কিন্তু ভাগ্যের বিড়ম্বনায় দিনকয়েকের মধ্যে গঙ্গায় সাঁতার কাটতে গিয়ে জলে ডুবে মৃত্যু হয় নীলানাথের। সুলক্ষণা মেয়েটি ‘অপয়া’ অপবাদ নিয়ে ফিরে আসেন পিতৃগৃহে। আর পাঁচটি বিধবা মেয়ের মতোই হয়তো তাঁর দিন কেটে যেত, কিন্তু এগিয়ে এলেন রবীন্দ্রনাথ। প্রতিমা দেবীর জন্মের পর, ফুটফুটে মেয়েটিকে নিজের ছেলের বউ করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন কবিপত্নী মৃনালিনী। কিন্তু নিয়তি কাউকে ছাড়ে না। তাই অকালে চলে গেলেন মৃনালিনী।

প্রতিমা দেবীর বিয়ের সময় এগিয়ে এল। মৃনালিনীর কথা মনে করে প্রতিমা দেবীর অভিভাবকদের তরফ থেকে রথীন্দ্রনাথ আর প্রতিমা দেবীর বিয়ের প্রস্তাব আসে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তখন কিশোর ছেলের বিয়ে দিতে চাননি। অগত্যা প্রতিমা দেবীর অন্যত্র বিবাহ হয়ে যায়। তারপর পাঁচবছর বৈধব্যজীবনের পর রবীন্দ্রনাথের উদ্যোগে প্রতিমাদেবী আবার প্রবেশ করেন রঙিন জীবনে। এবার তিনি কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথের অর্ধাঙ্গিনী। অনেকে বলেন, ঠাকুরবাড়িতে এই প্রথম বিধবাবিবাহ।
চিরায়ত সংস্কারের কারণে প্রতিমা দেবী এবং তাঁর মা বিনয়িনী দেবী নাকি এই বিয়েতে রাজি ছিলেন না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছে এবং গগনন্দ্রনাথের উদ্যোগে রথীন্দ্রনাথ ও প্রতিমাদেবীর শুভবিবাহ সুসম্পন্ন হয় ১৯১০ সালের ২৭ জানুয়ারি। নবদম্পতি নতুন সংসার পাতেন শিলাইদহে, অপূর্ব প্রাকৃতিক পরিবেশে। স্বপ্নের মতোই সুন্দর ছিল তাঁদের জীবনের প্রথম বছরটি।

তিমাদেবীকে পেয়ে রথীন্দ্রনাথ ঠিক কতটা খুশি ছিলেন, তা অনুমান করা যায় ভগ্নিপতি নগেন্দ্রনাথকে লেখা রথীন্দ্রনাথের একটি চিঠি থেকে। রথীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘প্রতিমা এখন আমার …সে কী চমৎকার মেয়ে কী করে লিখি। আমি যদি তাঁর গুণের বর্ণনা করতে যাই তো সবকথা বিশ্বাস করবে না বা আমাকে Lunatic ভাববে।’ এমনই মুগ্ধতা আর আবেশে যে সম্পর্ক শুরু হয়েছিল, সেই সম্পর্ক ধীরে ধীরে ভাঙনের পথে চলবে। জীবনের অপরাহ্ণবেলায় প্রতিমা দেবী গভীর একাকিত্বকে মেনে নিয়ে শান্তিনিকেতনে, রাঙামাটির দেশে রয়ে যাবেন। যেন এক একলা শিল্পী, জীবনের বেদনা ফুটিয়ে তুলছেন তাঁর শিল্পে।

আর রথীন্দ্রনাথ? কর্মব্যস্ত জীবনে স্ত্রীকে কাছে পাবেন না। প্রৌঢ় বয়সে বন্ধু নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী মীরা চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে চলে যাবেন দেরাদুনে। একদিকে রথীন্দ্রনাথ বা মীরাদেবী কেউই নিজেদের দাম্পত্য সম্পর্ক ভাঙবেন না। অন্যদিকে জীবনের মূল্যবান প্রহরগুলি থেকে বঞ্চিত করবেন প্রতিমাদেবী এবং মীরাদেবীর স্বামী নির্মলচন্দ্রকে। প্রতিমাদেবী অতি বড় বেদনায় এবং অপমানেও স্থির ছিলেন। শুধু যখন বিশ্বভারতীর উপাচার্য রথীন্দ্রনাথকে নিয়ে অপবাদ ও গুঞ্জন শুনছেন, তখন একবার বলেছিলেন, ‘ওনার সমস্ত ব্যক্তিত্ব ওই মেয়ে গ্রাস করে নেবে।’ প্রথম বিবাহের পর স্বামীর মৃত্যু এবং দ্বিতীয় বিবাহের পর স্বামীর অন্য নারীতে আসক্তি—প্রতিমাদেবীর একাকিত্বই ছিল দাম্পত্যের ললাটলিখন। তবু, নিয়তির পরিহাসকে অতিক্রম করে প্রতিমাদেবী স্বতন্ত্রভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করলেন। এইখানেই তিনি অনন্যা!
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩৩: মিলাডা—বিদেশিনীর হরফ

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-৫: আজি এ কোন গান নিখিল প্লাবিয়া

অসাধারণ ছবি আঁকতেন প্রতিমাদেবী। অবন ঠাকুরের ভাগ্নী উত্তরাধিকার সূত্রেই এই প্রতিভা অর্জন করেছিলেন। বিয়ের পর ইতালিয়ান শিক্ষক গিলহার্ডির কাছে ছবি আঁকতে শিখেছিলেন প্রতিমাদেবী। তারপর শান্তিনিকেতনে থাকার সময় নন্দলাল বসুর সঙ্গেও কাজ করেছেন। সব থেকে বড় প্রাপ্তি তাঁর ‘বাবামশায়’ রবীন্দ্রনাথের সাহচর্য। প্রতিমাদেবী রবীন্দ্রনাথের ছবি বিষয়ে মূল্যবান আলোচনা করেছিলেন ‘গুরুদেবের ছবি’ রচনায়। রীতিমতো চিত্রসমালোচকের মতো সে সমালোচনা। ইন্দোনেশিয়ায় গিয়ে বাটিকের কাজ শিখে শান্তিনিকেতনে তার প্রচলন করেছিলেন । ফ্রান্স থেকে শেখা সেরামিকসের কাজ শিখিয়েছিলেন শ্রীনিকেতনে। রবীন্দ্রনাথের করা কাঠ ও চামড়ার কাজে বিদেশি নকশা মিশিয়ে তৈরি করতেন ট্রে, ফুলদানি, ল্যাম্পশেড আরো কত কী! বলা যায়, শান্তিনিকেতনের যে বিশেষ স্টাইল তা প্রতিমাদেবীর জন্যই বিশিষ্ট হয়ে উঠেছিল।

রবীন্দ্রনৃত্যে একটি বড় ভূমিকা রয়েছে প্রতিমাদেবীর। শান্তিনিকেতনে প্রতিমাদেবী মূলত ভাবনৃত্য শিখিয়েছিলেন। বিয়ের কিছুদিন পরে ‘লক্ষ্মীর পরীক্ষা’ নাটকে ক্ষীরির চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন প্রতিমাদেবী। এরপর রবীন্দ্রনাথ তাঁর অনুরোধেই ‘পূজারিণী’ কবিতার নৃত্যনাট্যরূপ লিখে দেন। নাম দেন—‘নটীর পূজা’। প্রতিমাদেবী শান্তিনিকেতনের মেয়েদের দিয়ে কবির জন্মদিনে, ‘নটীর পূজা’র নৃত্যনাট্যরূপ অভিনয় করিয়েছিলেন। ‘চিত্রাঙ্গদা’ বা ‘পরিশোধ’ লেখার সময় রবীন্দ্রনাথ প্রথমে ভাবেননি তার নৃত্যরূপের কথা। প্রতিমাদেবী প্রায় চোদ্দ বছরের পরিশ্রমের পর রাবীন্দ্রিক গীতিনাট্যের স্থায়ী রূপ তৈরি করেছিলেন ‘চিত্রাঙ্গদা’য়। এর আগে ‘শাপমোচন’ আর ‘চণ্ডালিকা’র নৃত্যনাট্যরূপও তৈরি হয়। মিশ্রতাল ও ভঙ্গির সংমিশ্রণে তিনি নৃত্যকলায় বৈচিত্র্য এনেছিলেন।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৭৪: রাজা দশরথ, রাম, লক্ষ্মণ, সীতা সকলেই কি এক একটি জীবনবোধের প্রতীক?

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৩: রাজনীতিতে উন্নতির জন্য নিন্দা বা প্রশংসা ব্যক্তিগত পরিসরে করাই শ্রেয়, সভায় নয়

কুশীলবদের পোশাক এবং মঞ্চসজ্জা নিয়েও ভাবনাচিন্তা করতেন প্রতিমাদেবী। পোশাকের ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতেন শালীন সৌন্দর্য নিয়ে। ‘মায়ার খেলা’ নাটকের নতুন রূপ দিয়েছিলেন। গল্পগুচ্ছের ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, ‘দালিয়া’, ‘সামান্য ক্ষতি’ ইত্যাদি গল্পের ট্যাবলো ধরণের মূকাভিনয়ের আকার দেওয়া হয়েছিল প্রতিমা দেবীর উদ্যোগে। তাঁর কর্মোদ্যোগের আরেকটি হল ‘আলাপিনী সমিতি’। আশ্রমের মেয়েরা গ্রামে গিয়ে গ্রামের অশিক্ষিতা মেয়েদের স্বাস্থ্যকর খাবার তৈরি, হাতের কাজ শেখানো ইত্যাদি বিষয় সচেতন করে আসতেন।

কল্পিতাদেবী ছদ্মনামে প্রবাসী পত্রিকায় অনেক কবিতাও লিখেছিলেন প্রতিমাদেবী। তাঁর লেখা ‘স্বপ্নবিলাসী’ পড়ে রবীন্দ্রনাথ মুগ্ধ হয়ে লিখেছিলেন ‘মন্দিরার উক্তি’। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কবিতা লেখার চর্চা করতেন প্রতিমাদেবী। তাঁর লেখা ‘নির্বাণ’ বইতে রবীন্দ্রনাথের জীবনের শেষ বছরের বর্ণনা আছে। এছাড়াও ‘স্মৃতিচিত্র’, ‘নৃত্য’, ‘চিত্রলেখা’ ইত্যাদি বইও লিখেছিলেন প্রতিমাদেবী। প্রতিটি বইই সেই সময়কার দলিল। প্রতিমাদেবী লেখাপড়ার চর্চাও করেছিলেন বিয়ের পরেই। সেই সময় বাপের বাড়ি আর শ্বশুরবাড়ির ভাবের বদল চোখে পড়েছিল প্রতিমাদেবীর। তখন তাঁর বয়স মাত্র ষোলো।

বিয়ের পর থেকে ‘বাবামশায়’ রবীন্দ্রনাথের সেবায় নিমগ্ন ছিলেন প্রতিমাদেবী এবং রথীন্দ্রনাথ। দীর্ঘজীবনের বিচিত্র কর্মপ্রবাহের সহায়ক হিসেবে রবীন্দ্রনাথ সঙ্গে পেয়েছিলেন পুত্র ও পুত্রবধূকে। রথীন্দ্রনাথ নিজেও একজন গুণী মানুষ ছিলেন। কিন্তু বাবার প্রখর সূর্যালোকের মতো প্রতিভার তেজের পাশে অনালোচিতই রয়ে গেলেন তিনি। বিদেশ সফরে রবীন্দ্রনাথের দেখাশোনার জন্য অনেকসময় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে থাকতেন প্রতিমাদেবী। আসলে স্ত্রী, কন্যাসন্তানদের হারিয়ে প্রতিমাদেবীর মধ্যে গৃহলক্ষ্মীর খোঁজ পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর উপর নির্ভর করতেন। প্রতিমাদেবী ছিলেন রবীন্দ্রনাথের স্নেহের ‘মা-মণি’, ‘ব্রাইড মাদার’, ‘বৌমা! রথীন্দ্রনাথ আর প্রতিমাদেবীর নিঃসন্তান জীবনের সবটুকু মনোযোগ অধিকার করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। একথা অস্বীকার করার জায়গা নেই।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৭৭: কথা কিছু কিছু

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫৭: উপবাস নিয়ে শ্রীমায়ের দৃষ্টিভঙ্গি

প্রতিমাদেবীর প্রতিভা বিকশিত হল। রবীন্দ্রনাথের অকৃত্রিম স্নেহ পেলেন। জীবনের অর্থ খুঁজে পেলেন। কিন্তু রথীন্দ্রনাথ আর প্রতিমাদেবীর যৌথজীবন এক গভীর অসুখের মতো কষ্ট দিয়ে গেলো দুজনকেই। পালিতা কন্যা পুপেও সেই দূরত্ব মেটাতে পারলো না।তার জন্য হয়তো নিজের অজান্তেই দায়ী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বিয়ের পর শিলাইদহে মাত্র একবছরের সহজ দাম্পত্য ছিল রথীন্দ্রনাথ প্রতিমাদেবীর। শিলাইদহের কুঠিবাড়ি, চারিদিকের গোলাপবাগিচা, পদ্মানদী, সুখদুঃখের কাহিনিমোড়া বজরা এবং দাম্পত্যে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় দু’জনের নিজস্ব অবসর! এইসব ছেড়ে রবীন্দ্রনাথের ডাকে কর্তব্যের ভুবনে প্রবেশ করতে হয় নবদম্পতিকে। ধীরে ধীরে বিরহ আর দূরত্ব তাঁদের দুই অন্য পৃথিবীর বাসিন্দা করে তোলে। রথীন্দ্রনাথ একটি চিঠিতে প্রতিমাদেবীকে লিখেছিলেন, ‘কতদিন বোলপুরের মাঠে একলা পড়ে কেঁদেছি, কেউ জানে না। তুমিও না!’ একাকিত্ব প্রতিমাদেবীরও ছিল। নাহলে ওই বিপুল কর্মপ্রবাহে একটি মেয়ে নিজেকে ভাসিয়ে দিতে পারে না।

বন্ধু নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী মীরা চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে একটি আশ্চর্য সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন প্রৌঢ় রথীন্দ্রনাথ। এই নিয়ে শান্তিনিকেতনে গুঞ্জন থেকে গুজব কিছু কম ছিল না। পম্পা সরোবরের ধারে রথীন্দ্রনাথের চারুকাজের স্টুডিয়ো ‘গুহাঘর’ এর উপরতলায় ছিল প্রতিমাদেবীর স্টুডিয়ো ‘চিত্রভানু’। ওই গুহাঘরেই থাকতেন রথীন্দ্রনাথ। সেখানেই নীরবে শিল্পচর্চা করতেন প্রতিমাদেবী। অভিমানের আগুন কখনো প্রতিমাদেবীর কাজের পথে দাহ তৈরি করতে পারে নি।

রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর রথীন্দ্রনাথ তখন বিশ্বভারতীর উপাচার্য । এইসময় তাঁকে, তাঁর কাজের পদ্ধতি ও নির্মলচন্দ্রের স্ত্রী মীরাদেবীকে নিয়ে এতরকম চর্চা হচ্ছিল যে রথীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতী ছেড়ে দেরাদুনে চলে যান। সেইসময় নাকি জওহরলাল নেহেরু নির্দেশ পাঠিয়েছিলেন চট্টোপাধ্যায় দম্পতিকে শান্তিনিকেতন থেকে সরিয়ে দেবার জন্য। কিন্তু রথীন্দ্রনাথ নিজেই সরে গেলেন। প্রতিমাদেবী রয়ে গেলেন শান্তিনিকেতনে, কোনার্ক ভবনে!রথীন্দ্রনাথের সঙ্গে গেলেন মীরা চট্টোপাধ্যায়। রথীন্দ্রনাথের মৃত্যু পর্যন্ত সঙ্গে ছিলেন মীরা। এই সম্পর্কের চর্চা না করেই প্রতিমাদেবীর একাকিত্বের কথা ভাবলে অবাক হতে হয়। সেইসঙ্গে মুগ্ধ হতে হয় তাঁর জীবনচর্যার পরিশীলনে।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৬: স্রোতস্বিনী পদ্মায় লাফিয়ে কবির কটকি চটি-উদ্ধার

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৬: বার্নার্ড শ ও শার্লটি —তবে কেন মিছে ভালোবাসা/২

দেরাদুন যাওয়ার সময় প্রতিমাদেবীকে লেখা চিঠিতে রথীন্দ্রনাথ লিখে গিয়েছিলেন, ‘আমি লুকিয়ে চুরিয়ে যাচ্ছি না। এখানে সবাইকে জানিয়েই যাচ্ছি মীরা আমার সঙ্গে যাচ্ছে।’ এই সিদ্ধান্তের পর সত্যি কি কিছু বলার থাকে? তাই প্রতিমাদেবী নিজের কাজের পৃথিবীতেই রয়ে গিয়েছিলেন, শান্তিনিকেতনে! শিল্পীদের সাধনার জন্য জীবন তাদের একাকিত্ব আর বিষাদ উপহার দেয়। প্রতিমাদেবী নাকি রথীন্দ্রনাথকে বলেছিলেন,‘ভালো আছ এই খবর পেলেই খুশী হব।’ কুশল সংবাদ আসতো পত্রের আকারে, দেরাদুন থেকে! কিন্তু মানুষটা তখন অন্য কারো।

একবার রবীন্দ্রনাথের কনিষ্ঠা কন্যার সঙ্গে মুসৌরি যাওয়ার পথে প্রতিমাদেবী রথীন্দ্রনাথের দেরাদুনের বাড়ির দিকে চেয়েছিলেন। বারান্দায় তখন ঝুলে আছে অন্য কারো নতুন শাড়ি! যে কিশোরী মেয়ের প্রেমে নিজেকে ‘Lunatic’ পর্যন্ত বলেছিলেন রথীন্দ্রনাথ সে তখন সামাজিক ভাবেই শুধু রথীন্দ্রনাথের স্ত্রী। চিত্রা দেব ‘ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল’ এ লিখেছেন যে প্রতিমাদেবী রথীন্দ্রনাথের সঙ্গে শান্তিনিকেতন ছাড়তে রাজি হননি। রথীন্দ্রনাথের মীরাদেবীর প্রতি আকর্ষণ সম্পর্কে জানার পরেও কি তা সম্ভব? ১৯৬০ সালে রথীন্দ্রনাথ একটি চিঠিতে প্রতিমাদেবীকে লিখেছিলেন,‘আমরা দুজনেই এখন জীবনের সীমান্তে এসে পড়েছি। এখন আর কারো প্রতি রাগ বা অভিমান পুষে রাখা শোভনীয় হয় না। সেইজন্য জেনো আমার মনে কোনো রাগ নেই— আমি সব ঝেড়ে ফেলেছি। আমাদের মধ্যে প্রীতি সম্বন্ধ অক্ষুণ্ণ থাকে , এই নতুন বছরে তাই কামনা করি।’

জীবন বড় রহস্যময়। একদিন ষোলো বছরের প্রতিমাকে রবীন্দ্রনাথ আশীর্বাদ করেছিলেন তাঁর সংসারকে পবিত্র জীবনের দ্বারা দেবমন্দির করে তোলার জন্য। প্রতিমাদেবীর ব্যক্তিগত জীবনচর্যায় এই পবিত্র সৌন্দর্য অবশ্যই লক্ষ করা গিয়েছে। হয়তো রথীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রতিমাদেবীর সপ্তপদী একটা সময়ের পর তাঁকে একাকিত্ব দিয়েছে। হতে পারে তাঁদের সংসারের ভাঙনে দুজনেরই কিছু ভূমিকা ছিল। কিন্তু রবিঠাকুরের সংসার অনেক বড়। জোড়াসাঁকো বা শান্তিনিকেতনের চৌহদ্দি পেরিয়ে যে বিরাট সংস্কৃতির ক্ষেত্র, সেখানে প্রতিমাদেবী ‘নির্মল হস্তে পুন্যপ্রদীপটি জ্বালাবার জন্য’ এসেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের এই আশীর্বচন সত্যই ছিল। প্রতিমাদেবীর কর্মজীবন তার সাক্ষ্য দেয়। সময়ের স্রোত সব আবেগ, সব যণ্ত্রণা মুছে দেয়। রয়ে যায় শুধু কর্মের কোলাহল। প্রতিমাদেবীরও সেই কর্মী পরিচয় জেগে থাকবে অবিচলিত ভঙ্গিতে। একজন লেখক হিসেবেও তাঁর যেটুকু অবদান তাকেও গ্রহণ করতে হবে সশ্রদ্ধ চিত্তে।

ঋণ
ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল , চিত্রা দেব
আপনি তুমি রইলে দূরে,সঙ্গ নিঃসঙ্গতা ও রথীন্দ্রনাথ, নীলাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়
উইকিপিডিয়া
* ড. মহুয়া দাশগুপ্ত, শিক্ষক এবং লেখক। রবীন্দ্রনাথের দেবলোক, জোড়াসাঁকোর জার্নাল, আমি নারী আমি মহীয়সী, কথানদীর কূলে, লেডিজ স্পেশাল, পথে পুরুষ বিবর্জিত, পরীক্ষায় আসবে না এবং ভুবনডাঙার বাউল তাঁর লেখা একক বই। বাংলা কথকতা নিয়ে একক ভাবে কাজ করছেন।

Skip to content